অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় ঋণখেলাপির হার কমাতে তুন আদেশ জারি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এখন থেকে ৯০দিন কিস্তি না দিলেই ঋণখেলাপি হবে। আগে এই সময় ছিল ১৮০ দিন। গতকাল বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপনে এ তথ্য জানা গেছে। নতুন এ নির্দেশনা আগামী বছরের ১ এপ্রিল থেকে কার্যকর হবে।
জানা গেছে, বকেয়া ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বাড়িয়ে ৮ বছর করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। দীর্ঘমেয়াদি ঋণমান কমায় আন্তর্জাতিক রেটিং এজেন্সি মুডিসের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে বলা হয়েছে, গৃহিত নতুন নতুন পদক্ষেপের ফল পেতে আরও সময় লাগবে। এতে সব ধরনের ঋণ শ্রেণিকরণের ক্ষেত্রেই এই বিধান প্রযোজ্য হবে। বর্তমানে ঋণ ভেদে ৩ মাস বা ৬ মাস পর ঋণখেলাপি হচ্ছে। ৩ মাস কমানোর ফলে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। আগে ঋণের ধরন অনুযায়ী বিভিন্ন সময়ে খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত করা হতো। এখন সব ধরনের ঋণই ৩ মাস মেয়াদোত্তীর্ণ থাকার পর পরিশোধিত বা নবায়ন করা না হলে তা খেলাপি হয়ে যাবে। বর্তমানে মেয়াদি ঋণসহ কিছু ঋণ খেলাপি হচ্ছে মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার ৬ মাস পর। ফলে ঋণখেলাপি হওয়ার সময় ৩ মাস কমে গেল।
এদিকে, বাংলাদেশের খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা নিয়ে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ), বিশ্বব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো আপত্তি করে আসছে। কারণ আন্তর্জাতিকভাবে কোনো ঋণ পরিশোধের দিন থেকে ৩ মাসের মধ্যে শোধ করা না হলে তাকে খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু গত সরকারের সময়ে খেলাপি ঋণ কমিয়ে দেখাতে বাংলাদেশে এটি ৬ মাস করা হয়েছিল। মেয়াদি ঋণের ক্ষেত্রে ৯ মাস করা হয়েছিল। পরে আইএমএফের আপত্তির কারণে কিছু ঋণের ক্ষেত্রে ৩ মাস করা হলেও কৃষি ও মেয়াদি ঋণের ক্ষেত্রে ৬ মাস করা হয়।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, চলমান ঋণ, কৃষি ঋণ, মেয়াদি ঋণসহ সব ধরনের ঋণ বা ঋণের কিস্তি ১ এপ্রিল থেকে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পরিশোধিত না হলে পরদিন থেকেই তা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে গণ্য হবে। নতুন সংজ্ঞায় মেয়াদোত্তীর্ণের তিনটি ধাপ সৃষ্টি করা হয়েছে। আগে ছিল একটি ধাপ। ঋণটি যাতে চূড়ান্তভাবে খেলাপি না হয় সে জন্য ব্যাংকগুলোকে তদারকি বাড়াতে এইসব ধাপ বাড়ানো হয়েছে। মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার প্রথম ধাপ হবে পরিশোধের নির্ধারিত দিনের পর দিন থেকে ১ মাস পর্যন্ত। দ্বিতীয় ধাপ হবে ১ মাসের বেশি থেকে ২ মাস পর্যন্ত। তৃতীয় ধাপ ঋণটি বিশেষ হিসাবে স্থানান্তর হয়ে যাবে। অর্থাৎ ঋণটি খেলাপি হওয়ার আগের ধাপে চলে গেল। কিস্তি পরিশোধের নির্ধারিত দিন থেকে ২ মাসের বেশি থেকে ৩ মাস পর্যন্ত বিশেষ হিসাবে থাকবে। এর মধ্যে ঋণ পরিশোধিত বা নবায়ন না হলে ৩ মাসের পর থেকে তা খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত হবে। খেলাপি ঋণের তিনটি ধাপ রয়েছে। খেলাপি হওয়ার পর ৩ মাস থেকে ৬ মাস পর্যন্ত নিম্নমান, ৬ মাস থেকে ১২ মাস পর্যন্ত সন্দেহজনক এবং ১২ মাসের বেশি সময় খেলাপি থাকলে তা মন্দ ঋণ বা আদায় অযোগ্য ঋণ হিসাবে চিহ্নিত হবে। সার্কুলারে কিছু ঋণের ক্ষেত্রে প্রভিশনের হারও বাড়ানো হয়েছে। সব ধরনের নিয়মিত ঋণের বিপরীতে এক শতাংশ হারে প্রভিশন রাখতে হবে। আগে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ঋণের বিপরীতে দশমিক ২৫ শতাংশ প্রভিশন রাখার বিধান ছিল। ফলে ব্যাংকগুলোর প্রভিশন রাখার পরিমাণ বাড়বে। কোনো ঋণ বিশেষ হিসাবে চলে গেলে ওইসব ঋণের বিপরীতে ৫ শতাংশ হারে প্রভিশন রাখতে হবে। কোনো ঋণখেলাপি হলে প্রথম ধাপে বা নিম্নমান হিসাবে শ্রেণিকৃত থাকলে তার বিপরীতে ২০ শতাংশ, সন্দেহজনক হলে তার বিপরীতে ৫০ শতাংশ এবং মন্দ হিসাবে শ্রেণিকৃত হলে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হবে।
সার্কুলারে বলা হয়, এর আওতায় সুবিধা নিতে হলে ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তাদের আগামী বছরের ৩১ মার্চের মধ্যে সংশ্লিষ্ট বাণিজ্যিক ব্যাংকের কাছে আবেদন করতে হবে। কোনো ঋণখেলাপি এ সুবিধা পাবেন না। এ সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে বড় অঙ্কের ঋণসীমা অতিক্রম করা যাবে না। ব্যাংকগুলোকে গ্রাহক ডলারের দাম বাড়ার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কি না, সেটি নিশ্চিত হয়ে নিতে হবে। এতে আরও বলা হয়, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধে বিশেষ সুবিধা চান উদ্যোক্তারা। ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধির কারণে এ খাতে বাড়তি ঋণের যে দায় তৈরি হয়েছে, তা নিয়মিত ব্যাংক ঋণের বাইরে রেখে ১৬ বছরে কিস্তিতে পরিশোধের সুযোগ দেওয়ার দাবি করেছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক আট বছরের সময় দিয়েছে। ওদিকে, গত সপ্তাহে বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি ঋণমান কমায় আন্তর্জাতিক রেটিং এজেন্সি মুডিস।
এর প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, বর্তমান সরকার অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। এসব পদক্ষেপের ফল পেতে আরও সময় লাগবে। এক বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা জানায় বাংলাদেশের আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানটি।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, দেশের অর্থনীতি একটি বড় রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সরকার এরইমধ্যে নানা কর্মকৌশল হাতে নিয়েছে। এসব পদক্ষেপের ইতিবাচক ফল পেতে অপেক্ষা করতে হবে। রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সমর্থন অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের গতি বাড়াবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আশা, দ্রুত ঢাকা সফর করে সার্বিক দিক মূল্যায়ন করবে মুডিস। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনার পরই সরকারের নেওয়া নীতি ও উন্নয়নের সঠিক মূল্যায়নে সক্ষম হবে আন্তর্জাতিক রেটিং সংস্থাটি। মুডিস গত সপ্তাহে বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি ঋণমান কমায়। বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই ঋণমান যাচাইকারী সংস্থাটি সরকারের ইস্যুয়ার ও সিনিয়র আনসিকিউরড রেটিংস ‘বি১’ থেকে ‘বি২’-এ নামিয়ে আনে। একই সঙ্গে দেশের অর্থনীতির পূর্বাভাসে পরিবর্তন এনে স্থিতিশীল থেকে ঋণাত্মক করেছে। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতির কারণে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে মুডিস।
ভোরের আকাশ/ সু
মন্তব্য