-->

টাকা ছাপানোর পরও সংকট কাটছে না

সাজেদা হক
টাকা ছাপানোর পরও সংকট কাটছে না

তারল্য সংকটে থাকা ব্যাংকের গ্রাহক ভোগান্তি কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা চেয়েছিল বেশ কয়েকটি ব্যাংক। অবশেষে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে ২২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ছাপিয়ে ৬ ব্যাংককে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গেল সপ্তাহে এই টাকা ব্যাংকগুলোতে পৌঁছায়। তবে সংকট কাটছে না। এখনও গ্রাহক চাহিদা মতো টাকা তুলতে পারছেন না। গতকাল সোমবারও ৫ থেকে ১০ হাজার টাকার বেশি তুলতে পারেননি ৫ ব্যাংকের গ্রাহকরা। তবে ন্যাশনাল ব্যাংকের গ্রাহকদের বেশ কয়েকজন এক লাখ টাকা পর্যন্ত তুলতে পেরেছেন। তারল্য সংকটের নামে নেওয়া টাকাগুলো গেল কোথায়—এমন প্রশ্ন তুলেছেন গ্রাহকরা। একই সঙ্গে কর্মকর্তাদের ভূমিকায় চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তারা। সার্বিক পরিস্থিতিতে অস্বস্তিতে থাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, তিনি বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন।

তারল্য-সহায়তা পাওয়া ছয় ব্যাংক হচ্ছে—ন্যাশনাল ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংক। এর মধ্যে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক পেয়েছে ৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। আর ৫ হাজার কোটি টাকা পেয়েছে এক্সিম ব্যাংক। সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংক পেয়েছে ৪ হাজার কোটি টাকা করে। চতুর্থ প্রজন্মের ইউনিয়ন ব্যাংক ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংককে ২ হাজার কোটি টাকা করে দেওয়া হচ্ছে। এর আগেও দুর্বল সাত ব্যাংককে ৬ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকার সহায়তা দিয়েছে সবল ৯ ব্যাংক। এ সময় সবচেয়ে বেশি সহায়তা পেয়েছে ইসলামী ব্যাংক। সাতটি ব্যাংক থেকে তারা পেয়েছে ২ হাজার ৯৫ কোটি টাকা। সবল ব্যাংকগুলো থেকে চাওয়া হয়েছিল ১১ হাজার ১০০ কোটি টাকা। সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ছয় ব্যাংক থেকে ১ হাজার ১৭৫ কোটি টাকা, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ছয় ব্যাংক থেকে ১ হাজার কোটি, ন্যাশনাল ব্যাংক ৯২০ কোটি, এক্সিম ব্যাংক ৭০০ কোটি, ইউনিয়ন ব্যাংক ৪০০ কোটি এবং গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক পেয়েছে ২৯৫ কোটি টাকা।

সব মিলিয়ে ন্যাশনাল ব্যাংক পেয়েছে ৪ হাজার ৯শ ২০ কোটি টাকা, এক্সিম ব্যাংক পেয়েছে ৫ হাজার ৭০০ কোটি টাকা, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক পেয়েছে ৫ হাজার ১৭৫ কোটি টাকা, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক পেয়েছে ৬ হাজার ৫০০ কোটি, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক পেয়েছে ২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা এবং ইউনিয়ন ব্যাংক পেয়েছে ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। অথচ রোববার ও সোমবার এসব ব্যাংকে গিয়ে চাহিদা মোতাবেক আমানত তুলতে পারেননি বহু গ্রাহক। রোববার ন্যাশনাল ব্যাংক তার গ্রাহকদেরকে সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা দিতে পারলেও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক (এসআইবিএল), ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকে বেশিরভাগ শাখা থেকে গ্রাহকরা পাঁচ হাজার টাকার বেশি তুলতে পারেননি।

যাদের হিসাব মতিঝিলের দিলকুশা শাখায়, তাদের মধ্যে এসআইবিএল গ্রাহকরা সর্বোচ্চ ২০ হাজার, ফার্স্ট সিকিউরিটি ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের গ্রাহকরা ১০ হাজার টাকা করে তুলতে পেরেছেন।

ঢাকার বাইরে থেকে আসা ব্যবসায়ী মনির বললেন, টাকার অভাবে আমি ব্যবসা করতে পারছি না। ওরা আমার সঙ্গে চোরের মতো ব্যবহার করে। আমি ৫ হাজার টাকা পাই না আর ম্যানেজার আড়াই লাখ টাকা বেতন নেয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসিয়ে রাখে আমাদের।

টাকা তুলতে জামালপুর থেকে ঢাকায় এসে শুনলেন পাবেন ৫ হাজার টাকা। জামালপুরের সৌরভ রহমান সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের গ্রাহক। জামালপুর শাখায় তার হিসাবে ৭ লাখ টাকা, কিন্তু তুলতে পারছেন না। ভেবেছিলেন ঢাকায় এসে টাকা পাবেন। কিন্তু এই দীর্ঘ যাত্রায় কোনো লাভ হয়নি। সৌরভ বলেন, জেলায় টাকা পাওয়া যায় না। তাই মতিঝিল শাখায় এসেছি। এখানেও একই অবস্থা। সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা দিচ্ছে। একই ব্যাংকের গ্রাহক আমেনা খাতুন এক লাখ টাকার চেক নিয়ে আসলে তাকেও জানানো হয় ৫ হাজার টাকা দেওয়া যাবে। তার হিসাব এই শাখায় থাকলে ২০ হাজার টাকা দেওয়া যেত বলে ক্যাশ কাউন্টার থেকে জানানো হয়।

ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকেরও একই চিত্র। এই ব্যাংকের মিরপুর শাখার গ্রাহক আব্দুল হাকিম দিলকুশা শাখায় ৫০ হাজার চেক নিয়ে জমা দিলে তাকে বলা হয়, দেওয়া যাবে ৫ হাজার। হাকিম বলেন, মিরপুর শাখা থেকেই আমাকে মতিঝিল আসতে বলেছে। তারা বলেছিল এ শাখায় পাওয়া যাবে। এ শাখায় এসেও হতাশ হয়ে ফিরছেন ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের যে গ্রাহকরা।

ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের গ্রাহক রায়হান চৌধুরীর হিসাব মহাখালী শাখায়। গভর্নরের কথায় আস্থা রেখে তিনি চেক নিয়ে ব্যাংকে গেলে বলা হয়, সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা দেওয়া যাবে। দিলকুশা শাখায় গেলে পুরো টাকা পাবেন, জেনে এখানে আসার পর তাকে বলা হয় ৫ হাজারের বেশি দেওয়া সম্ভব না।

গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংকের গ্রাহকদেরও একই ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। তবে ব্যাংক দুটির মতিঝিল শাখায় কেউ এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। যোগাযোগ করা হলে কথা বলতে রাজি হননি ন্যাশনাল ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তারাও।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর বলেন, ফার্স্ট সিকিউরিটি ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকে টাকা দেওয়া হয়েছে। তারা চাহিদা মোতাবেক কেন টাকা দিতে পারছে না তা আমি জানি না, তবে বিষয়টি নিয়ে আমি দেখব। তবে গ্লোবাল আর ইউনিয়নে টাকা দেওয়া হয়নি সেভাবে।

অথচ এর আগে গভর্নরের দায়িত্ব নিয়েই আহসান এইচ মনসুর বলেছিলেন, দুর্বল ব্যাংকগুলোকে তারা কোনো সহায়তা দেবেন না। ব্যাংকগুলোতে নিজেদের মতো করে চলতে হবে। আর আওয়ামী লীগ সরকার ৬০ হাজার কোটি টাকা ছাপানোয় মূল্যস্ফীতি বেড়েছে বলে মন্তব্য করে বলেছিলেন, অন্তর্বর্তী সরকার এভাবে টাকা ছাপাবে না। কিন্তু চার মাস যেতে না যেতেই এই অবস্থান থেকে সরেছে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

 

ভোরের আকাশ/রন

মন্তব্য

Beta version