তারল্য সংকটে থাকা ছয় ব্যাংক সংকট কাটিয়ে উঠতে পারছে না। সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংক ধার দিলেও স্বাভাবিক হচ্ছে না লেন-দেন। ফলে বিরূপ প্রভাব পড়ছে ব্যাংকিং খাতে। ব্যাংকগুলো শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত। সব মিলিয়ে ব্যাংকগুলো নিয়ে বিপাকে পড়েছে সরকার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, দেশের দুর্বল ব্যাংকগুলোর প্রায় সব সূচকে অবনতি ঘটেছে। আমানতও কমেছে, তারল্যও কমেছে। গত তিন মাসে ব্যাংকগুলোর তারল্য কমেছে ৯৮ শতাংশ। এ অবস্থার জন্য ব্যাংকগুলোতে সুশাসনের অভাব ও অনিয়মকে দায়ী করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর এই ব্যাংকগুলো হলো ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, কমার্স ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক ও আইসিবি ইসলামী ব্যাংক।
এই সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পরপরই প্রাথমিকভাবে দেশের ৬টি ব্যাংককে ২২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা দেওয়া হয়। এর মধ্যে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক পায় ৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। আর ৫ হাজার কোটি টাকা পায় এক্সিম ব্যাংক। সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংক পায় ৪ হাজার কোটি টাকা করে। চতুর্থ প্রজন্মের ইউনিয়ন ব্যাংক ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক পায় ২ হাজার কোটি টাকা।
অথচ এই কয় মাসেই প্রচলিত সংজ্ঞায় খেলাপি ঋণ বেড়ে ২ লাখ ৮৮ হাজার কোটি টাকা হয়েছে। আগামী এপ্রিল থেকে খেলাপি ঋণের আন্তর্জাতিক মানের সংজ্ঞা কার্যকর হবে। তখন জুন প্রান্তিকে গিয়ে খেলাপি ঋণ আরও বেড়ে যাবে। এরমধ্যে গত সরকারের আমলে লুটপাট হওয়া ব্যাংকগুলোতেই খেলাপি ঋণ বেশি বাড়ছে। অনেক ঋণ এখনো মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পর খেলাপি করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, দুর্বল ব্যাংকগুলো বর্তমানে যে তারল্য সংকট মোকাবিলা করছে তার অন্যতম কারণ হচ্ছে, ব্যাংকগুলোতে ঘটে যাওয়া কিছু অনিয়ম ও সুশাসনের অভাব। সুতরাং দুর্বল ব্যাংকগুলোতে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। এটি করা হলে ব্যাংকের প্রতি গ্রাহকদের আস্থা বাড়বে। তখন বিদ্যমান সংকট মোকাবিলা করাও সহজ হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক গ্রাহকদের আস্থা অর্জনে ব্যাংকগুলোকে মনোযোগী হতে পরামর্শ দিয়েছে। প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, গত জুনে দুর্বল ব্যাংকগুলোর আমানতের স্থিতি ছিল ৪৪ হাজার ৩১ কোটি টাকা। গত সেপ্টেম্বরে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৪৩ হাজার ৬৬৭ কোটি টাকা। তিন মাসের ব্যবধানে আমানত কমেছে ৮ হাজার ৪২ কোটি টাকা বা প্রায় ২ শতাংশ। বিনিয়োগের স্থিতি বেড়েছে মাত্র দশমিক ৪২ শতাংশ। আগে আরও বেশি হারে বাড়তো। বিনিয়োগ কমায় আমানত ও বিনিয়োগের অনুপাত কমে দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৬৭ শতাংশ।
গত জুনে অতিরিক্ত তারল্য ছিল ১০ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বরে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১৬১ কোটি টাকা। তিন মাসে অতিরিক্ত তারল্য কমেছে ১০ হাজার ২২৯ কোটি টাকা বা সাড়ে ৯৮ শতাংশ। তবে রপ্তানি আয়, রেমিট্যান্স ও আমদানি বেড়েছে। ফলে ব্যাংকগুলো বৈদেশিক বাণিজ্যে ভালো করছে। বাড়তি দামে ডলার কেনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর তদারকির আওতায় পড়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি সবল ব্যাংকও রয়েছে।
এদিকে আর্থিক দুর্বলতার কারণে শরিয়াহভিত্তিতে পরিচালিত ব্যাংকগুলো প্রচলিত ব্যাংকগুলোর তুলনায় পিছিয়ে পড়ছে। এসব ব্যাংকের বেশির ভাগই দুর্বল ব্যাংকের আওতায় পড়েছে। এ ছাড়া আইন সংশোধন করে খেলাপিদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা এবং পাচার করা টাকা ফিরিয়ে আনা বেশ সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। এতদিন দুর্বল ব্যাংকগুলোকে টিকিয়ে রাখা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জন্য বড় চ্যালেঞ্জিং। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন আইন করতে যাচ্ছে, ব্যাংক ভালোভাবে না চালালে বা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিধানের আওতায় সূচকের উন্নতি না হলে সেগুলোকে অন্য ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করে দেবে। এদিকে ব্যাংক একীভূত করার বিষয়ের ক্ষেত্রেও ভালো অভিজ্ঞতা নেই। কারণ, এর আগের সরকারের সময়ে নির্দিষ্ট কয়েকটি ব্যাংক একীভূত করার ঘোষণা দেওয়ার ফলে গ্রাহকদের আমানত তুলে নেওয়ার হিড়িক পড়ে যায়।এতে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো আরও বেশি ক্ষতির মুখে পড়ে।
এদিকে, আগামী বছরের শুরু থেকে দুর্বল ব্যাংকগুলোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক চালু করতে যাচ্ছে ‘প্রমোট কারেক্ট অ্যাকশন প্ল্যান’। ২০০৩ সালের শেষ দিকে এ বিষয়ে নীতিমালা জারি করা হয়েছে। এর আওতায় যেসব ব্যাংক নির্ধারিত সূচকে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারবে না তাদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবে। এর মধ্যে ঋণ বিতরণ বন্ধ করা, আমানত সংগ্রহ কমিয়ে দেওয়া উল্লেখযোগ্য। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, এসব ব্যাংক কোনোভাবেই আমানত সংগ্রহ বাড়াতে পারছে না। গত তিন মাসে ব্যাংকগুলোর তারল্য ৯৮% পর্যন্ত কমে গেছে। ২০২৩ সালের জুনে যেখানে আমানতের স্থিতি ছিল ৪৪ হাজার ৩১ কোটি টাকা, সেপ্টেম্বরে তা নেমে এসেছে ৪৩ হাজার ৬৬৭ কোটি টাকায়। দুর্বল ব্যাংকগুলোতে সুশাসনের অভাবই সংকটের মূল কারণ বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সুশাসন নিশ্চিত করতে পারলে গ্রাহকদের আস্থা ফিরে আসবে এবং সংকট মোকাবিলা সহজ হবে।
যদিও ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটে ভুগছে, তবুও বৈদেশিক বাণিজ্যে কিছু উন্নতি দেখা যাচ্ছে। রপ্তানি আয়, রেমিট্যান্স এবং আমদানির পরিমাণ বেড়েছে। তবে উচ্চমূল্যে ডলার কেনার কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কড়া তদারকির মুখোমুখি হচ্ছে অনেক ব্যাংক, এমনকি সবল ব্যাংকগুলোরও একটি অংশ। এই পরিস্থিতিতে দুর্বল ব্যাংকগুলোর পুনর্গঠন ও তারল্য সংকট কাটাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে দীর্ঘমেয়াদি কৌশল গ্রহণ করা ছাড়া বিকল্প নেই।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য