করদাতা হয়রানি কমানো ও কর ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ‘রাজস্ব কমিশন’ নামে স্বাধীন সংস্থা গঠনের সুপারিশ করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সংস্কারবিষয়ক পরামর্শক কমিটি। সম্প্রতি অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে সংস্কারবিষয়ক পরামর্শক কমিটির প্রধান ড. আব্দুল মজিদ অন্তর্র্বর্তী প্রতিবেদন জমা দেন। ওই প্রতিবেদনে স্বাধীন রাজস্ব কমিশন গঠনের সুপারিশ করা হয়। ব্যবসায়ী, অর্থনীতিবিদ ও হিসাবরক্ষকসহ এ খাতের অংশীজনদের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে রাজস্ব নীতি প্রণয়নের ওপর সম্পূর্ণ মনোযোগ দিতে কমিশন গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে।
পরামর্শক কমিটির অন্তর্র্বর্তী প্রতিবেদনে স্বল্প মেয়াদের সংস্কার হিসেবে, পুনর্গঠিত এনবিআরের কাঠামোকে শক্তিশালী করতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড আদেশ-১৯৭২ এর পুনঃসংশোধন করা এবং অর্থমন্ত্রীর অধীনে এনবিআরকে স্বতন্ত্র বিভাগ করার পাশাপাশি বোর্ডে কর্মরত সদস্যসহ ঊর্ধ্বতন পদের মর্যাদা বৃদ্ধি এবং নতুন পদ সৃষ্টি করার সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, অর্থ বিভাগ ও লেজিসলেটিভ বিভাগ প্রস্তাবিত রাজস্ব কমিশন গঠনের কাজ করবে বলে পরামর্শ দেয়া হয়েছে সংস্কার প্রতিবেদনে। মধ্যমেয়াদে আয়কর, ভ্যাট ও শুল্ক সংক্রান্ত আইন ও বিধি-বিধান সংশোধনের পরামর্শও দিয়েছে সংস্কার কমিটি। করদাতাদের হয়রানি কমিয়ে ন্যায্য নীতি তৈরি করার লক্ষ্যে রাজস্ব আদায় ও নীতি প্রণয়নকে আলাদা করতে নব গঠিতব্য এ কমিশন সরাসরি অর্থমন্ত্রীর অধীনে কাজ করবে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়ছে।
রাজস্ব সংক্রান্ত আইন প্রণয়নে অংশীজনদের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করতে কমিশনে একটি স্থায়ী উপদেষ্টা পরিষদ করার প্রস্তাব করেছে সংস্কারবিষয়ক পরামর্শক কমিটি। এ উপদেষ্টা পরিষদে হিসাববিদ, প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী নেতা, থিংক ট্যাংক, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, শিল্প মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, অর্থ বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক, ট্যারিফ কমিশনের প্রতিনিধিরা থাকবেন। পরিষদের দায়িত্ব হবে অংশীজনদের সাথে আলাপ-আলোচনা ও আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চার ভিত্তিতে প্রণীত নীতিমালার আলোকে ন্যূনতম ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে রাজস্ব কমিশনকে নিয়মিত পরামর্শ দেয়া। এছাড়া করদাতা ও কর আদায়কারী সংস্থার মধ্যে উদ্ভূত বিরোধ নিরসনে আপিলাত ট্রাইব্যুনাল, করদাতাদের হয়রানি হওয়ার অভিযোগ আমলে নিয়ে কাস্টমস ও ভ্যাট আপিলাত ট্রাইব্যুনাল এবং আয়কর আপিলাত ট্রাইব্যুনালকে এনবিআরের প্রভাবমুক্ত রাখতে প্রস্তাবিত রাজস্ব কমিশনের অধীনে রাখার সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিটি।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ২০০৮ সালে ফখরুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাজস্ব নীতি ও প্রশাসন বিভাগ পৃথক করার আদেশ জারি করলেও ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ সরকার তা বাস্তবায়ন করেনি। তবে অর্থনীতিদিরা বলছেন, কমিশন প্রধান সাধারণ রাজস্ব কর্মকর্তা না হয়ে এমন একজন হওয়া উচিত যার সামগ্রিক অর্থনীতি নিয়ে সাম্যক ধারণা আছে; পাশাপাশি সামগ্রিক প্রশাসন চালানোরও অভিজ্ঞতা আছে। এতে করে কমিশনে ব্যালান্স (সাম্যতা) আসবে।
এনবিআর সংস্কারবিষয়ক পরামর্শক কমিটির একাধিক রিপোর্ট দেওয়ার কথা রয়েছে উল্লেখ করে এনবিআরের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা জানান, এটি পরামর্শক কমিটির প্রথম রিপোর্ট ছিল। পরবর্তী রিপোর্টগুলোতে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. আব্দুল মজিদের নেতৃত্বাধীন সংস্কারবিষয়ক পরামর্শক কমিটি রাজস্ব কমিশনের কর্ম পরিধি, এনবিআরের জনবল ব্যবস্থাপনা ও করদাতা হয়রানি ও কর আদায় বাড়ানোর ব্যাপারে বিভিন্ন পরামর্শ দিতে পারে। এছাড়া কর নীতি সংক্রান্ত সেবা গ্রহণে অংশীজনদের যাতায়াত সহজসাধ্য রাখতে সচিবালয় ও রাজস্ব ভবনের বাইরে রাজস্ব কমিশনের অফিস স্থাপন করা যুক্তিযুক্ত হবে। রাজস্ব নীতি সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন আয়কর ও কাস্টমস ক্যাডারের দক্ষ, নিষ্ঠাবান ও সৎ জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এই কমিশন প্রধানের দায়িত্ব পাবেন-যার পদ মর্যাদা সচিব বা সিনিয়র সচিব হবে বলে জানান তারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান মাশরুর রিয়াজ বলেন, রাজস্ব আইন প্রণয়ন একটি টেকনিক্যাল কাজ। এরজন্য প্রয়োজন উপযুক্ত ও দক্ষ কর্মকর্তা । তিনি বলেন, প্রস্তাবিত কমিশনের প্রধান এমন একজন হওয়া উচিত, যার অর্থনৈতিক বিষয়গুলোর ওপর গভীর জ্ঞান এবং আইন প্রয়োগ ও জনসেবা বিষয়ে অভিজ্ঞতা রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ দুটো কাজ একটি প্রতিষ্ঠানকে একসাথে করতে হয় বিধায় নীতি-নির্ধারক বা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে নীতি প্রণয়নে বেশি সময় দিতে হয়। এতে প্রত্যাশিত রাজস্ব আদায় হচ্ছে না এবং প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য পর্যাপ্ত কার্যক্রম নেয়া যাচ্ছে না বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। রাজস্ব কমিশন সরকারের উন্নয়নের নীতি কৌশল, অংশীজনদের প্রস্তাব-পরামর্শ ও আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চার ভিত্তিতে নীতি প্রণয়নের কাজ করবে। আয়কর, ভ্রমণ কর, দানকর, আমদানি-রপ্তানি শুল্ক, নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক, সম্পূরক শুল্ক, ভ্যাট, আবগারি শুল্কসহ অন্য শুল্ক-কর হার নির্ধারণ করবে এই কমিশন। এছাড়া এই কমিশন প্রয়োজনে শুল্ক-কর সংক্রান্ত বিধি-বিধান প্রণয়ন, সংশোধন ও পরিবর্তন করবে। প্রযোজ্য ক্ষেত্রে কর অব্যাহতি দেবে। পাশাপাশি আইন ও বিধি, প্রজ্ঞাপনের ব্যাখ্যা প্রদান করবে।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য