ঋণ জালিয়াতিতে আলোচিত আরও পাঁচ ব্যাংকের এমডিকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গতকাল রোববার তাদের ছুটিতে পাঠানোর নির্দেশ দেয়া হয়।
ব্যাংকগুলো হলো- এক্সিম, গ্লোবাল ইসলামী, এসআইবিএল, আইসিবি ইসলামিক ও ইউনিয়ন ব্যাংক। এর আগে, গত শনিবার ফার্স্টসিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের এমডিকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়। তাকে আগামী তিন মাসের জন্য ছুটিতে পাঠানো হয়। এ সময়ে ভারপ্রাপ্ত এমডির দায়িত্ব পালন করবেন ব্যাংকটির অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু রেজা মো. ইয়াহিয়া।
সূত্র বলছে, ৬ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের নিয়ে জরুরি বৈঠক করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সেখানে এসব ব্যাংকে অধিকতর তদন্ত করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়ার লক্ষ্যে এস আলম ঘনিষ্ঠ ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়; যাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক নিরীক্ষা সংস্থাগুলো নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারে। ব্যাংক সংস্কারের জন্য গঠিত ব্যাংকিং ট্রান্সফরসের পরামর্শে এমন সিদ্ধান্ত এসেছে বলেও নিশ্চিত করেছেন সংশ্লিষ্টরা। এরই ধারাবাহিকতায় ফার্স্টসিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের এমডিকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়। ফার্স্টসিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলম মাসুদ। সরকার পরিবর্তনের পর গত ১ সেপ্টেম্বর ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে পুনর্গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ইসলামী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবদুল মান্নানকে। অন্য ব্যাংকগুলোর উচ্চ পদে শিগগিরই পরিবর্তন আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তবে বাধ্যতামূলক ছুটির তালিকায় আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের এমডির নাম থাকলেও পর্ষদে পরিবর্তনের পর গত অক্টোবরে ইসলামিক আইসিবি ব্যাংকের এমডি মোহাম্মদ শফিক বিন আবদুল্লাহর পুনঃনিয়োগ অনুমোদন আটকে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মজিবুর রহমানকে এ দায়িত্ব দেওয়া হয়।
এমডিদের ছুটির বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র নির্বাহী পরিচালক হুসনে আরা শিখা সাংবাদিকদের বলেন, ছয় ব্যাংকের এমডি ছুটিতে থাকবেন, এটা ছয় ব্যাংকের পর্ষদের সিদ্ধান্ত। এমন সিদ্ধান্তের কারণ তুলে ধরে তিনি বলেন, এটা এজন্য করা হয়েছে কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব ব্যাংকগুলোতে অ্যাসেট কোয়ালিটি রিভিউয়ের আওতায় আনবে। কারণ এসব ব্যাংকে অডিট পরিচালনা করার একটি পরিকল্পনা রয়েছে। তারা যাতে কোনো রকমের অযাচিত হস্তক্ষেপ করতে না পারেন, অর্থাৎ প্রক্রিয়াটিকে স্বচ্ছ রাখার জন্য তাদের সাময়িকভাবে ছুটিতে যেতে বলা হয়েছে।
নিরীক্ষায় যদি তাদের (এমডি) কোনো রকমের অন্যায়ের সঙ্গে জড়িত না থাকার প্রমাণ পাওয়া না যায়, তারা আবার চাকরিতে এসে যোগদান করতে পারবেন। যদি কোনো কিছু পাওয়া যায় তখন অন্য রকম চিন্তা করতে হবে। এটা আন্তর্জাতিক রীতি মেনে করা হয়েছে।
গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নুরুল আমিন বলেন, এসব ব্যাংকের ফরেনসিক অডিট করা হবে। তাই গভর্নর ছয়টি ব্যাংকের ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের ছুটিতে পাঠানোতে সম্মতি দিয়েছেন। এছাড়া সব পক্ষ থেকেই এমডিদের ছুটিতে পাঠানোর আলোচনা চলছিল।
তিনি বলেন, স্বচ্ছভাবে নিরীক্ষার কাজ করতে প্রতিবেদন তৈরির জন্যই তাদের ছুটিতে পাঠানোর সিদ্ধান্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সম্মতি দিয়েছে। রোববার আবার গভর্নরের সঙ্গে বৈঠক হয়। এতে অডিট নিরীক্ষার বিষয়ে আলোচনা হয়; যাতে ফরেনসিক অডিটররাও অংশ নেন।
জালিয়াতি ও ঋণ কেলেঙ্কারিতে এসব ব্যাংক বেশ কিছু দিন থেকে ধুঁকছে। তারল্য সংকটে গ্রাহকদের টাকা দিতে পারছে না। এমন প্রেক্ষাপটে খাদের কিনারায় যাওয়া এ ছয় বেসরকারি ব্যাংকে ‘ফরেনসিক অডিট’ চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ব্যাংক খাত সংস্কারে গঠিত টাক্সফোর্স।
এ ছয় ব্যাংকের মধ্যে ইসলামিক আইসিবি ছাড়া বাকি পাঁচটির পর্ষদ দীর্ঘদিন ধরে আলোচিত ব্যবসায়ী এস আলম ও তার পরিবারের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এতে ব্যবস্থাপনা ও নিয়োগের সবকিছুও তারা নিরঙ্কুশভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন বলে অভিযোগ ছিল। ব্যাংকগুলো থেকে নামে ও ভিন্ন নামে এস আলম ঋণের নামে টাকা বের করে নেন। দীর্ঘদিন অপরিশোধিত থাকায় সেগুলো খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে।
ক্ষমতার পালাবদলের পর এসব ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ এস আলমের বাইরে চলে যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব নেওয়ার পর আহসান এইচ মনসুর এসব ব্যাংকে নতুন পরিচালনা বোর্ড গঠন করেন।
পর্ষদ পুনর্গঠনের পর ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পাওয়া ফার্স্টসিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান আব্দুল মান্নান বলেন, আমরা অডিটকে স্বাগত জানাই। নতুন দিনের একটি অধ্যায় শুরু করতে যাচ্ছি, ব্যাংকটিকে জনগণের স্বার্থে ব্যবহার করা হবে। এজন্য অডিট খুবই কাজে লাগবে।
এমডিকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানোর কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, এমডি যেহেতু সে সময়ে (আগের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সময়ে) ছিলেন, তাই তাকে দায়িত্বে রেখে অডিট প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। কোনো বির্তক যাতে না ওঠে, নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে তাকে তিন মাসের ছুটিতে পাঠানো হয়েছে।
একটি নির্দিষ্ট সময়ে হওয়া সব ধরনের লেনদেন যাচাই-পর্যালোচনা ও কোনো তথ্য মুছে ফেলা হয়েছি কি না, তা দেখতে এই ফরেনসিক অডিটের সিদ্ধান্ত নিয়েছে টাক্সফোর্স। সেই সিদ্ধান্তে একমত হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকও। বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা বলেন, ব্যাংকগুলোতে যদি এস আলমের সময়ের কর্মকর্তারা থাকেন, তাহলে অডিটে ম্যানুপুলেশন হওয়ার সম্ভবনা থাকতে পারে। তাই বাংলাদেশ ব্যাংক ও ব্যাংকগুলোর সিদ্ধান্ত এমন যে এস আলমের সময়কার কর্মকর্তাদের প্রভাবমুক্ত রেখে সঠিকভাবে এসব ব্যাংকের নিরীক্ষা করা।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য