-->
শিরোনাম
অনলাইন ক্লাসে আগ্রহ নেই, প্রয়োজন বিশেষ শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠানের

শিক্ষায় পিছিয়ে যাচ্ছে বিশেষায়িত শিশুরা

ইফফাত শরীফ
শিক্ষায় পিছিয়ে যাচ্ছে বিশেষায়িত শিশুরা

নিশু (ছদ্মনাম)। সারাক্ষণ ছোটাছুটি-দুষ্টুমিতে ব্যস্ত সময় পার করছে শিশুটি। করোনায় স্কুল বন্ধ থাকায় অনলাইনে ক্লাস চলছে। তবে মা তাকে কোনোভাবেই ক্লাস করানোর জন্য বসাতে পারছেন না। অনলাইন ক্লাসে বসলেই সে চিৎকার-চেঁচামেচি করে। এতে মা মাঝেমধ্যে খানিকটা বিরক্ত হলেও শেষ পর্যন্ত মনকে বুঝিয়ে সান্ত্বনা খোঁজার চেষ্টা করেন। কারণ তার বাচ্চা অন্যসব স্বাভাবিক বাচ্চার মতো নয়।

নিশুর শেখার অক্ষমতা বা লার্নিং ডিজেবিলিটি নামক একটি রোগ আছে। এ রোগের ফলে সে কোনো কিছু ভালো করে মনে রাখতে পারে না। বইয়ের অক্ষরগুলোকে তার কাছে উল্টো মনে হয়। তাই পড়াশোনায় মন নেই। অনলাইন ক্লাসকে সে বিরক্ত মনে করে। তবে তাকে যদি যতেœর সঙ্গে কিছু বোঝানো যায়, সে ভালোভাবে মনে রাখতে পারে। অনলাইনে ক্লাস হওয়ায় তাকে বসানো যাচ্ছে না। ফলে এতদিন নিশু যা শিখেছে, তা ধীরে ধীরে ভুলতে বসেছে। নিশুর মতো এমন অবস্থা বেশিরভাগ বিশেষ শিশুর। করোনা পরিস্থিতিতে বন্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তবে অনলাইন ক্লাস চালু রয়েছে।

কিন্তু বিশেষ শিশুদের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক বাচ্চার মতো অনলাইনে ক্লাস করাটা অনেক কঠিন বলে জানিয়েছেন অভিভাবকরা। এসব শিশু কম্পিউটার বা মোবাইলের সামনে বসে ক্লাস করতে চায় না। বিরক্ত মনে করে। রাজধানীর বেশ কয়েকটি পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অনেক মা-বাবা কর্মক্ষেত্রে সারা দিন ব্যস্ত থাকেন। আবার অভিভাবকদের অনেকে প্রযুক্তির ব্যবহার জানেন না। এজন্য প্রতিবন্ধী অনেক শিশু পড়াশোনা থেকে পিছিয়ে যাচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ হলো, এ স্পেশাল শিশুদের কোনোকিছু হাতে-কলমে শিক্ষা দিতে অনেক সময়ের প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে অনলাইনে শিক্ষা দিতে দ্বিগুণ সময় লাগে। এতে করে অনেক অভিভাবকরা বিরক্ত হন এবং বাচ্চাদের ভালোভাবে সময় দিতে পারেন না। এক্ষেত্রে অভিভাবকদের বোঝা উচিত, এরা অন্যসব বাচ্চার মতো নয়, তারা স্পেশাল। তাদের যত যত্ন সহকারে এবং ধীরে-সুস্থে বোঝানো যাবে, তারা ততই ভালো বুঝবে।

খোঁজ নিয়ে জানা জায়, যদিও করোনা পূর্ববর্তী সময় দেশের স্পেশাল স্কুলগুলোয় যে পরিমাণ শিক্ষার্থী ছিল, তা করোনা-পরবর্তী সময় এসে প্রায় অর্ধেকে নেমে গেছে। এক্ষেত্রে এসব শিশুর একটা অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ তৈরি হয়েছে। অনেকে শিশু শিক্ষা থেকে ঝরে যাচ্ছে। তাদের আর স্কুলমুখী করা যাবে কিনাÑ এ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন খোদ অভিভাবকরাই।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এমন অনেক অভিভাবকের সঙ্গে কথা বলে জানা জায়, অনলাইনে এসব বাচ্চাকে কোনো বিষয় বোঝাতে অনেক সময় লাগে। তাছাড়া পড়াশোনার পাশাপাশি এসব বাচ্চার বিশেষ থেরাপির প্রয়োজন হয়। স্কুল বন্ধ থাকায় অনেক ক্ষেত্রে এসব থেরাপি দেওয়া হয়ে ওঠে না। কিছু কিছু প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান আছে, যারা বিশেষ শিশুদের নিয়ে কাজ করে। থেরাপির জন্য ক্ষেত্রবিশেষে প্রতিষ্ঠান খোলা রাখা হচ্ছে। তবে তা সংখ্যায় একেবারেই হাতেগোনা।

বিশেষ শিশুদের কীভাবে শিক্ষা দেওয়া সম্ভব- এ সম্পর্কে জানতে চাইলে কিডি রকস স্পেশাল নীডস স্কুলের চেয়ারম্যান ডা. রাহাত চৌধুরী দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেন, বিশ্বের অন্যান্য স্পেশাল বাচ্চাকে যেভাবে শিক্ষা দেওয়া হয়ম সে তুলনায় বাংলাদেশ অনেকটা পিছিয়ে আছে। তিনি বলেন, বিশেষ শিশুদের ক্ষেত্রে অটিজম স্পেকট্রাম ব্যাধির অসংখ্য ভাগ আছে। প্রতিটি শিশুর সমস্যার ধরন আলাদা হয়। যেমন কোনো বাচ্চার শারীরিক সমস্যা থাকে। সেক্ষেত্রে সে বাচ্চা ভালো করে কাজ করতে পারে না, কলমটা পর্যন্ত ধরতে পারে না।

কিন্তু দেখা যায়, শিশুটি ঠিকমতো কথা বলতে পারছে, শুনতে পাচ্ছে; এমনকি মুখে মুখে অঙ্ক পর্যন্ত করতে পারছে। এ ধরনের শিশুদের ক্ষেত্রে আমরা শিক্ষাটাকে গুরুত্ব দিই। আবার কিছু বাচ্চা আছে, যাদের পরিপূর্ণভাবে মস্তিষ্ক বিকাশ ঘটে না। তারা ঠিকমতো ঘাড় সোজা করে রাখতে পারে না। এ ধরনের বাচ্চার মাথাটা ছোট হয়। তারা কখনো কিছু শিখতে পারবে না। কারণ তার মস্তিষ্ক তৈরি হয়নি।

এ ধরনের শিশুদের ক্ষেত্রে শিক্ষাটা জরুরি নয়, তারা ঠিকমতো নিজেদের কাজটুকু করতে পারলেই হবে। আবার কিছু বাচ্চা আছে, যারা খুব চঞ্চল কোনো কিছুতেই তাদের মনোযোগ ঠিক থাকে না। এসব বাচ্চার কোনো শারীরিক সমস্যা নেই, মস্তিষ্কের কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু সমস্যা শুধু মনে। তাদের যখন যেটা ভালো লাগে, সে তা করে। এসব বাচ্চার নিজের মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উন্নত দেশগুলোয় সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে শারীরিক সমস্যা, মস্তিষ্কের স্নায়ুর সমস্যা, আচরণগত সমস্যাজড়িত বিশেষ শিশুদের আলাদা শ্রেণিবিন্যাস করে শিক্ষা দেওয়া যায়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশে বিশেষ শিশুদের একই শ্রেণিকক্ষে শিক্ষা দেওয়া হয়। যদি আলাদা করে শিক্ষা কারিকুলাম ব্যবস্থা থাকে, তাহলে বিশেষ শিশুরা খুব দ্রুতই স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারত বলে মনে করেন তারা।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে গবেষকরা অটিজমকে অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার বলে আখ্যায়িত করেছেন। অটিজম কেন হয়, তার সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ উদ্ঘাটন করা সম্ভব হয়নি। মস্তিষ্কের অস্বাভাবিক গঠন, বংশগত অস্বাভাবিকতা থেকে এ সমস্যা হতে পারে বলে বিভিন্ন গবেষণায় প্রতীয়মান হয়।

বিশেষজ্ঞদের মতে, অটিজম শিশুদের যদি জটিল বিষয়কে সহজ-সরলভাবে ধাপে ধাপে উপস্থাপন করে শেখানো যায়, তবে তারা সহজে বুঝতে পারবে। অটিজম কোনো মানসিক রোগ নয়, তাই অটিজম শিশুদের সমাজের বোঝা মনে না করে, বরং এসব শিশুকে যথাযথ পরিচর্যার মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তর করা সম্ভব বলে মনে করেন এ সেক্টরের বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলছেন, আজকের অটিজম শিশুরা যাতে ভবিষ্যতে কিছুটা হলেও স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে, সে লক্ষ্যে কাজ করতে হবে। এ দায়িত্ব শুধু সরকারের একার নয়, এটা আমার, আপনার, গোটা জাতির দায়িত্ব। আমরা সবাই যদি সচেতন থাকি, তবেই অটিজম শিশুরা ভবিষ্যতে একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ দেখতে পারবে। এরা পাগল বা মস্তিষ্কবিকৃত নয়, এরা প্রখর মেধার অধিকারী।

বিশেষ শিশুদের শিক্ষাদানের জন্য বাংলাদেশে যথেষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষক আছে কিনা- জানতে চাইলে কিডি রকস স্পেশাল নীডস স্কুলের ম্যানেজিং ডিরেক্টর এবং একাডেমিক হেড সাবরিনা আকতার বলেন, প্রতিটি বিশেষ শিশুর জন্য কমপক্ষে একজন করে শিক্ষক থাকা প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেখা যায়, অনেকগুলো বাচ্চার জন্য মাত্র একজন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া থাকে। এসব বাচ্চাকে শিক্ষাদানের জন্য বিশেষায়িত শিক্ষক এবং প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন। এক্ষেত্রে পর্যাপ্ত জায়গা, অর্থ এবং বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের অনেক অভাব আছে দেশে।

বিশেষ শিশুদের শিক্ষাদানের জন্য অবশ্যই সনদপ্রাপ্ত শিক্ষকের প্রয়োজন আছে। পাশাপাশি ভালোমানের থেরাপিস্টের দরকার, যারা বাচ্চাদের স্পিচথেরাপি এবং অকুপেশনাল থেরাপিসহ অনেক ধরনের শারীরিক থেরাপি দিয়ে থাকেন। এ সেক্টরকে উন্নত করতে হলে দক্ষ বিশেষজ্ঞ বাড়াতে হবে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় এ বিষয়ক পড়াশোনার সিট বাড়ানো প্রয়োজন।

তিনি বলেন, অটিজম সম্পর্কে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশে সচেতনতা নেই বললেই চলে। অনাদর-অবহেলায় বড় হয়ে উঠে তারা পরিণত হয় সমাজের বোঝা হিসেবে। প্রতিবন্ধীদের দিয়ে কিছুই হবে না- এই ভেবে তাদের বাতিলের খাতায় ফেলে রাখা হয়। অনেক অভিভাবক লজ্জায় তাদের সন্তানদের সমাজের কারো সামনে আনেন না। জীবনের প্রতি পদে তারা অবহেলার শিকার হয়। ফলে তাদের মেধার বিকাশে যথেষ্ট উদ্যোগ নেই।

মন্তব্য

Beta version