-->
শিরোনাম

মুখরিত শিক্ষাঙ্গন

নিজস্ব প্রতিবেদক
মুখরিত শিক্ষাঙ্গন
প্রথম দিনে সবার চোখেমুখে ছিল বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস। যেন আপন ঠিকানায় ফিরেছে সবাই। ছবি- ভোরের আকাশ

শিক্ষার্থীদের কলরবে আবারো মুখরিত হলো শিক্ষাঙ্গন। কোভিডের চোখ রাঙানি শেষে শিশুরা বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে ক্লাসে ফিরেছে। তাই প্রথম দিনে সবার চোখেমুখে বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস। যেন আপন ঠিকানায় ফিরেছে সবাই। দ্বিতীয় দফায় স্কুল চালুর প্রথম দিনে করোনা শনাক্তের হার নেমেছে ছয় শতাংশে। তেমনি মৃত্যুহারও কমেছে। সর্বশেষ কোভিডের ছোবলে মৃত্যু হয়েছে ১৬ জনের।

শনাক্ত ও মৃত্যুর হার কমতে থাকায় করোনাভাইরাসের বাধা পেরিয়ে এক মাস পর আবার শ্রেণিকক্ষে ফিরেছে দুই ডোজ কোভিড টিকা নেওয়া মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা। গতকাল মঙ্গলবার স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে আগের মতো তোড়জোড় দেখা যায়নি কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। তবে বেশকিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ নিয়ে ছিল সতর্ক নজরদারি। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যেও মাস্ক পরার সচেতনতা লক্ষ করা গেছে। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শরীরের তাপমাত্রা মেপে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়।

করোনাভাইরাসের অতি সংক্রামক ওমিক্রন ধরনটি নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে গত ২১ জানুয়ারি দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আবার বন্ধ করে দেওয়া হয়। সংক্রমণ কমায় দ্রুত স্কুল খুলে দেওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন অভিভাবকসহ শিক্ষার্থীরাও। দীর্ঘ এক মাসের ছুটি শেষে বন্ধুদের দেখা পেয়ে শিক্ষার্থীরাও উচ্ছ্বসিত। ক্লাসের আগে-পরে আর স্কুলের বাইরেও তারা আগের মতো মেতে উঠছে আড্ডায়। কোলাকুলি শেষে জমে থাকা কথাগুলো সবই প্রথম দিনেই বন্ধুর কাছে বলে হালকা হয়েছে।

গতকাল মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর মতিঝিল, রামপুরাসহ মিরপুরের কয়েকটি স্কুলে গিয়ে দেখা যায়, সকাল থেকেই শিফট অনুযায়ী শিক্ষার্থীরা আসা-যাওয়া করছে। মতিঝিল আইডিয়াল, মুগদা আইডিয়াল শাখা, মতিঝিল মডেল, মতিঝিল সরকারি বালক/বালিকা বিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে দেখা গেছে, শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বেশ। বাইরে অপেক্ষা করছেন অভিভাবকরা।

তবে এবার শিক্ষার্থীসহ অভিভাবকরা বলছেন, আসন্ন রমজান মাসে পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেন খোলা রাখা হয়। এর কারণ হিসেবে তারা বলছেন, ইতোমধ্যে শিক্ষার্থীদের অনেক ক্ষতি হয়েছে। বাসায় থাকলে স্কুলের মতো পড়াশোনা হয় না। তাই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে অর্ধেক ক্লাস নিয়েও যেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখা হয়।

আইডিয়াল স্কুলের শিক্ষার্থী পূর্বাশা বলে, অনেক ভালো লাগছে আজ। যেন বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়েছি।’ সে বলেন, রমজানে অল্প সময়ের জন্য হলেও যেন ক্লাস চালু থাকে। সুমাইয়া বলে, কী যে ভালো লাগছে তা বলে বোঝানো যাবে না। ক্লাসে ফিরেই সবার খোঁজখবর নিয়েছি। ছুটি শেষে কানামাছি খেলব, তারপর বাসায় যাব।’

এ স্কুলের বাইরে অপেক্ষায় ছিলেন অভিভাবক লিনা আক্তার। বললেন, মহামারির মধ্যে গত দুই বছর ছেলেমেয়েরা একরকম পড়ালেখার বাইরেই ছিল। এরপর যদি সংক্রমণ আবারো বাড়ে, তিনি নিরবচ্ছিন্নভাবে ক্লাস চালিয়ে নেওয়ার পক্ষে।

লিনা আক্তার বলেন, ক্লাস বন্ধ থাকলে বাচ্চারা পড়তে চাইবে না, এটাই স্বাভাবিক। এত বেশি গ্যাপ হয়েছে, এটা কমানো অসম্ভব। টিচাররা যদি একটু গুরুত্ব দেন, তাহলেই কেবল ক্ষতি কিছুটা কমানো সম্ভব।

প্রথম দিন ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী ক্লাসে এসেছে জানিয়ে মিরপুর গার্লস আইডিয়াল ল্যাবরেটরি ইনস্টিটিউটের মর্নিং শিফটের প্রধান আমিনা রশীদ বলেন, বাচ্চারা এখন আর বাসায় বসে থাকতে চায় না। ওরা স্কুলে আসার জন্য মুখিয়ে ছিল। শিক্ষার্থীরা টিকা নেওয়ায় ক্লাস চালাতে কোনো শঙ্কা দেখছেন না তিনি।

শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা দুই ডোজ টিকা পেয়েছে, মঙ্গলবার থেকে কেবল তাদেরই ক্লাসে আসতে বলেছিল সরকার। তবে শিক্ষার্থীরা টিকা নিয়েছে কি না, সব স্কুলে তা জানতে চাওয়া হয়নি।

শুরুর দিন অনেক অভিভাবক সরকার নির্ধারিত বয়স অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের টিকা নিশ্চিত করতে স্কুলকেন্দ্রিক টিকা বুথ স্থাপনের দাবি জানিয়েছেন।

তারা বলছেন, টিকার জন্য রেজিস্ট্রেশন করে বিভিন্ন হাসপাতালে যেতে হয়। ভিড়ের মধ্যে অভিভাবকসহ শিক্ষার্থীর স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ে। স্কুলে বুথ চালু করে দ্রুত সময়ের মধ্যে নিরাপদ টিকাদান কর্মসূচি সম্পন্ন করা সম্ভব। অভিভাবকদের এমন দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন অনেক শিক্ষক। তারা বলছেন, টিকা নিশ্চিত হলে সব শিক্ষার্থী ক্লাসে ফেরার সুযোগ পাবে।

লিটল ফ্লাওয়ার্স প্রিপারেটরি স্কুলে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ক্লাস নিতে দেখা যায়। পঞ্চম শ্রেণির একজন শিক্ষার্থী বলেছে, সকাল সাড়ে ৭টা থেকে তাদের ছয়টি ক্লাস হয়েছে। মিরপুরের প্যারাডাইস কিন্ডারগার্টেন ও হাই স্কুলে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের স্কুলে আসতে দেখা গেছে সকালে।

এ প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক দেলোয়ার হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাচ্চারা স্কুলে আসতে চাচ্ছে, তাই আসছে। আমাদের স্টুডেন্ট কম, তাই এক শিফটেই এখন ক্লাস হচ্ছে। সাউথ পয়েন্ট স্কুলের শিক্ষার্থী আমীর জানান, যথাসময়ে ক্লাস শুরু হয়েছে। প্রথম দিনে আমাদের কাছে টিকা কার্ড চাওয়া হয়নি। ভিকারুননিসা স্কুলের শিক্ষার্ক্ষী মৌমিতা বলে, স্কুলে আসার প্রস্তুতিতে ভোরে ঘুম ভেঙে যায়। দ্রুত এসে সবার সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে ক্লাস করেছি।

একই চিত্র দেখা গেছে, রাজধানীর দনিয়া এলাকার ব্রাইট স্কুল অ্যান্ড কলেজ, বর্ণমালা আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়, এ কে স্কুল অ্যান্ড কলেজ, আলফ্রেড স্কুল এবং মগবাজারের ইস্পাহানি বালিকা বিদ্যালয়ে।

পুরান ঢাকার বিভিন্ন স্কুল ঘুরে দেখা যায়, পোগোজ ল্যাবরেটরি স্কুল, সেন্ট গ্রেগরি, সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার গার্লস স্কুল, সেন্ট্রাল গার্লস স্কুলগুলোতে অভিভাবক, শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠেছে। অনেক প্রতিষ্ঠানে বিদ্যালয়ের প্রবেশমুখে শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা করে ভেতরে প্রবেশ করানো হচ্ছে। বিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে সবার মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

সকাল থেকেই রাজধানীর প্রভাতী বিদ্যানিকেতনের সামনে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ভিড় দেখা গেছে। শরীরের তাপমাত্রা মেপে ও হাত ধুয়ে শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করছে শিক্ষার্থীরা। এ সময় সবার মুখে মাস্ক দেখা গেছে।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ার পর ২০২০ সালের মার্চে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয় সরকার। পরিস্থিতির উন্নতি হলে দেড় বছর পর গত বছরের সেপ্টেম্বরে ক্লাসে ফেরে শিক্ষার্থীরা। এরপর এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা নিতে পারলেও চার মাস পরই আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে হয়েছিল করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রনের দাপটে।

সংক্রমণ কমে আসায় গত ১৭ ফেব্রুয়ারি শিক্ষামন্ত্রী ঘোষণা দেন, ২২ ফেব্রুয়ারি থেকেই মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিয়ে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান শুরু হবে। আর সশরীরে ক্লাস শুরুর ক্ষেত্রে ২০ দফা নির্দেশনা মেনে চলতে বলেছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, যেসব শিক্ষার্থী করোনার টিকার দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছে, শুধুমাত্র তারাই শ্রেণিকক্ষে সশরীরে ক্লাস করতে পারছে। বাকিদের ক্লাস করতে হচ্ছে অনলাইনে।

মন্তব্য

Beta version