মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ: চলতি বছর এইচএসসিতে পাসের হার কমে গেছে। পাশাপাশি কমে গেছে জিপিএ-৫ ধারীর সংখ্যা। কিন্তু জিপিএ-৫ ধারীর সংখ্যা কমে গেলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির লড়াইয়ে আসন পাবেন না ৪৩ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী। এ বছরের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার সদ্য ঘোষিত ফলাফলে ১০ লাখ ৬৭ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী পাস করেছেন।
রোববার প্রকাশিত ফলাফলে জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৯২ হাজার ৫৯৫ জন। অথচ দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ আসন রয়েছে ৪৯ হাজারের মতো। সে হিসেবে জিপিএ-৫ ধারী অন্তত ৪৩ হাজার শিক্ষার্থী এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন পাবেন না।
এইচএসসি ও সমমানে ভালো ফলাফল করা শিক্ষার্থীদের মূল টার্গেট থাকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ার। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যায়লগুলোতে আসন রয়েছে ৪৯ হাজার। সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজে আসন রয়েছে প্রায় ১৩ হাজার। ফলে জিপিএ-৫ পেলেও অনেক শিক্ষার্থী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পাবেন না। পাশাপাশি জিপিএ-৫ পাননি এমন অনেক শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষায় এগিয়ে যাবেন। ফলে বাদ পড়বে আরও জিপিএ-৫ ধারী।
জিপিএ-৫ পাওয়া অনেকে ভর্তি পরীক্ষায় সুযোগ পাবেন না। কম জিপিএ নিয়েও অনেকে পাবলিকে চান্স পাবেন। ফলে সুযোগ না পাওয়া জিপিএ-৫ ধারীর সংখ্যা বাড়বে। তবে তাদের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজে ভর্তির সুযোগ থাকবে। অনেকে দেশের বাইরেও পড়াশোনো করতে যাবেন।
রোববার সকালে এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে ফল তুলে দেন শিক্ষা বোর্ডগুলোর চেয়ারম্যানরা। দুপুরে সংবাদ সম্মেলন করে ফলের বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরবেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় মোট পাস করেছেন ১০ লাখ ৬৭ হাজার ৮৫২ জন পরীক্ষার্থী। পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন ১৩ লাখ ৫৭ হাজার ৯১৫ জন পরীক্ষার্থী। আর পরীক্ষায় অংশ নিতে ফরম পূরণ করেছিলেন ১৩ লাখ ৭৫ হাজারের বেশি পরীক্ষার্থী।
নয়টি সাধারণ বোর্ডের অধীনে অনুষ্ঠিত এইচএসসি পরীক্ষায় ৭৫ দশমিক ৯ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছেন। গত বছর নয়টি সাধারণ বোর্ডের এইচএসসি পরীক্ষায় ৮৪ দশমিক ৩১ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছিলেন। গত বছর শুধু এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন ১ লাখ ৫৯ হাজার ৭৫৫ জন শিক্ষার্থী।
জানা গেছে, এবারের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অংশ নিতে ফরম পূরণ করেছিলেন ১৩ লাখ ৫৯ হাজার পরীক্ষার্থী। গত ১৭ আগস্ট থেকে এ পরীক্ষা শুরু হয়ে চলে অক্টোবরের মাঝামাঝি পর্যন্ত। বেলা ১১টায় শিক্ষার্থীরা ফল পাবেন বলে জানিয়েছে শিক্ষা বোর্ডগুলো।
জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ও এ ধরনের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্য অনুযায়ী, শিক্ষার্থীদের পছন্দের শীর্ষে থাকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। এসব প্রতিষ্ঠানে মোট আসন আছে ৪৯ হাজার ২৫৫টি। দেশে ৯৮টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চালু থাকলেও হাতেগোনা ১০-১২টি প্রতিষ্ঠান ছাত্রছাত্রীদের কাছে আকর্ষণীয়।
যদিও এসব প্রতিষ্ঠানে সবার ভর্তির আর্থিক সঙ্গতি নেই, তবু এ ধরনের প্রতিষ্ঠান বিবেচনা করলে ২০ হাজার আসন যোগ করা যায়। এছাড়া মেডিকেল ও ডেন্টালে আসন আছে ১২ হাজার ও দুটি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ে (গাজীপুরের আইইউটি ও চট্টগ্রামে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন) ৪৪০টি। শিক্ষার্থীদের অনেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশের পর বিশেষায়িত কারিগরি শিক্ষায় ভিড়ে যায়।
এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৪টি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ৭২০, ছয়টি টেক্সটাইল কলেজে ৭২০, নার্সিং ও মিডওয়াইফারি প্রতিষ্ঠানে ৫ হাজার ৬শ এবং ১৪টি মেরিন অ্যান্ড অ্যারোনটিকাল কলেজে ৬৫৪টি আসন আছে। যারা ইসলামি বিশেষজ্ঞ হতে চায় তাদের জন্য ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনার্সে ভর্তির জন্য প্রায় ৬ হাজার আসন আছে। সবমিলে আসন সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ৯০ হাজার। যদি ধরে নেয়া হয় যে, ভর্তি পরীক্ষায় সবগুলোতে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীরাই সুযোগ পাবে।
চলতি বছরের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলে এগিয়ে আছেন ছাত্রীরা। চলতি বছর উত্তীর্ণ ১০ লাখ ৬৭ হাজার ৮৫২ হাজার পরীক্ষার্থীরা মধ্যে ছাত্রী ৫ লাখ ৬৮ হাজারের বেশি ও ছাত্র ৫ লাখ ২৮ হাজারের বেশি জন। এইচএসসি ও সমমানে মোট পাসের হার ৭৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ। পাসের হারেও এগিয়ে ছাত্রীরা। ছাত্রীদের পাসের হার ৮০ দশমিক ৫৭ শতাংশ। ছাত্রদের পাসের হার ৭৬ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় ছাত্রীদের থেকে বেশি সংখ্যক ছাত্র অংশ নিয়েছিলেন। পরীক্ষায় অংশ নেয়া মোট ১৩ লাখ ৫৭ হাজার ৯১৫ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ছাত্র ছিলেন ৬ লাখ ৮৯ হাজার ও ছাত্রী ছিলেন ৬ লাখ ৬৮ হাজার।
ফলাফলে শিখন ঘাটতির ধাক্কা: এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি মিলিয়ে কমপক্ষে ১৮ মাস ক্লাস নেয়া হয়। একাদশে প্রথমপত্র ও দ্বাদশে পড়ানো হয় দ্বিতীয়পত্র। পরীক্ষার কয়েক মাস আগে থেকে দুটি পত্রই সমানতালে পড়ে নির্বাচনী পরীক্ষায় অংশ নেন শিক্ষার্থীরা। অথচ এবার এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়া শিক্ষার্থীরা একাদশ ও দ্বাদশ মিলিয়ে সর্বসাকুল্যে ১৫ মাস ক্লাস করার সুযোগ পেয়েছেন। এতে শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি ছিল। পরীক্ষার ফলাফলে যার প্রভাব পড়েছে বলে মনে করেন শিক্ষাবিদ, শিক্ষক ও অভিভাবকরা।
জানা গেছে, ২০২২ সালের ২ মার্চ মাস থেকে ২০২৩ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়া শিক্ষার্থীদের একাদশ শ্রেণিতে ক্লাস শুরু হয়। চলতি বছরের ৩০ মে শুরু হয় নির্বাচনী পরীক্ষা। নির্বাচনী পরীক্ষার পর দ্বাদশ শ্রেণিতে আর ক্লাস নেয়া হয় না। ফলে এক বছর তিন মাস ক্লাস করে পূর্ণ নম্বর ও পূর্ণ সময়ের পরীক্ষায় বসতে হয়েছিল এবারের এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের।
চলতি বছরের ৩০ মে শুরু হয় নির্বাচনী পরীক্ষা। নির্বাচনী পরীক্ষার পর দ্বাদশ শ্রেণিতে আর ক্লাস নেয়া হয় না। ফলে এক বছর তিন মাস ক্লাস করে পূর্ণ নম্বর ও পূর্ণ সময়ের পরীক্ষায় বসতে হয়েছিল এবারের এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের
এদিকে, চলতি বছরের এইচএসি পরীক্ষা শুরুর আগে কিছু শিক্ষার্থী আন্দোলনে নামেন। তারা পরীক্ষা পেছানোর দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন। এমনকি ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডও ঘেরাও করেন। তাদের দাবি অযৌক্তিক বলে তা মানেনি শিক্ষা বোর্ড।
ওই সময় ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি অধ্যাপক তপন কুমার সরকার দাবি করেছিলেন- ‘এটা কোনো সমস্যা নয়।’ তার ভাষ্য ছিল, ‘এমনিতেই তো এইচএসসির শিক্ষার্থীদের ১৮ মাসের বেশি ক্লাস নেয়া হয় না। করোনার ক্ষত পুষিয়ে নিতে এবার একটু তো সেক্রিফাইস (ছাড়) করতে হচ্ছে।’
এইচএসসির ফল প্রকাশের পর শিক্ষার্থীদের কম সময় ক্লাস নেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক তপন কুমার সরকার বলেন, ‘শিখন ঘাটতি ছিল না তাও বলা যায় না। আবার খুব বেশি যে সেটা প্রভাব ফেলেছে, তাও নয়। ফলাফল স্বাভাবিক আছে। খারাপ কিছু হয়নি।’
তেজগাঁও সরকারি কলেজের একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘২০২২ সালের এইচএসসির ফল হলো ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে। আবার ২০২৩ সালের পরীক্ষাটাও একই বছরে হলো। সেটার ফলও নভেম্বরের মধ্যে প্রকাশ করা হলো। সময়ের যে অল্প ফারাক এতেই তো শিখন ঘাটতি স্পষ্ট।’
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য