২ মাস পেরিয়ে গেলেও প্রশাসনিক ভবনে রদবদল, শ্রেণি কার্যক্রম শুরু করা আর প্রতিনিয়ত মিটিং করা ছাড়া কোনো ধরণের কার্যকরী পদক্ষেপই গ্রহণ করতে দেখা যায়নি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) নতুন প্রশাসনকে।
জুলাই-আগস্ট গণ অভ্যূত্থানের মধ্য দিয়ে হাসিনা সরকারের পতনের পাশাপাশি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ২৯ তম উপাচার্য আওয়ামী পন্থী নীলদলের অন্যতম সদস্য অধ্যাপক এ এস মাকসুদ কামাল। পরবর্তীতে নানা আলোচনা সমালোচনার মুখে নতুন করে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান। পরবর্তীতে নানা আলোচনার মধ্য দিয়ে নিয়োগ দেওয়া হয় উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা ও উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক মামুন আহমেদকে। পরিবর্তন করা হয় একাধিক ডিন ও হল প্রাধ্যক্ষকে।
এত পরিবর্তন ও আশা আকাঙ্ক্ষার পরেও প্রশাসনিক কার্যক্রমে ব্যাপক ধীরগতির অভিযোগ উঠেছে। ২ মাস পেরিয়ে গেলেও প্রশাসনিক ভবনে এখনও চলছে শধুমাত্র রদবদল ও মিটিং। এত রদবদল ও ধীরগতির কারণে বর্তমান প্রশাসনের সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
প্রশাসনিক ভবন থেকে পাওয়া তথ্যমতে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন প্রধানদের নিয়ে “সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট টিম (এসএমটি)” নামক একটি টিম রয়েছে। যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ ও প্রক্টরসহ আরও অনেকে রয়েছেন। প্রায় প্রতিদিনই এই টিমের মিটিং হয়। কি বিষয়ে আলোচনা হয় সেটি বাইরে আসে না।
রদবদল খুব দ্রুত হলেও প্রশাসনিক কাজে তীব্র ধীরগতি লক্ষ করা যাচ্ছে। উপাচার্য নিয়োগের পরপরই শিক্ষার্থীদের চাওয়া ছিলো ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতির সংস্কার সে বিষয়ে এখনও পাওয়া যায়নি কোনো রূপ রেখা, গঠন করা হয়নি কোনো কমিশন, ডাকসু নির্বাচন নিয়েও এখনও দেওয়া হয়নি কোনো রূপরেখা, ১৫ জুলাই আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর হামলার ঘটনার দ্রুত বিচার চাইলেও সবে মাত্র গঠিত হয়েছে তথ্যানুসন্ধান কমিটি। ক্যাম্পাসে সংঘটিত বেআইনি ও সহিংস ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করতে আইন বিশেষজ্ঞ ও আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মাহফুলুল হক সুপণকে আহ্বায়ক করে এই কমিটি করা হয়েছে। কমিটিকে ৪৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। শিক্ষার মানোন্নয়ন, র্যাংকিং-য়ে পিছিয়ে পড়া নিয়েও নেই আলোচনা, মেয়েদের হল বাড়ানো নিয়ে কয়েক দফা মিটিং হলেও কোনো পরিকল্পনা সামনে আনছে না প্রশাসন, প্রশাসনিক ভবনকে ডিজিটালাইজড করার কথা বললেও সেটি এখন আলোচনায় নেই বললেই চলে।
শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান অথবা নীলদলের সদস্য বা শেখ হাসিনার সমর্থক এমন ৫০ জনেরও বেশি শিক্ষক বর্তমানে একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম থেক্ব বিরত রয়েছেন। তাদেরকে শিক্ষা কার্যক্রমে ফিরিয়ে আনা হবে নাকি তাদের বিরুদ্ধে প্রমাণ সাপেক্ষে কোনো সুষ্ঠু ব্যবস্থা নেওয়া হবে সে বিষয়েও পাওয়া যায়নি পরিষ্কার তথ্য।
ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে শিক্ষার্থী মনে। টিএসসিতে জ্যাম বাড়লেও প্রক্টরিয়াল টিমের কার্যকরী পদক্ষেপ নেই। লাখ টাকার সিকিউরিটি সার্ভেইলেন্স বক্সগুলোতে নেই কর্মচারী, প্রক্টর অফিসে নেই পর্যাপ্ত ও দক্ষ লোকবল, টিএসসি সংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেইট বন্ধ করে দিলেও তালা ভেঙে আবার প্রবেশ করছে জনগন সেদিকে নজর নেই প্রশাসনের। নিরাপত্তাজনিত এই বিষয়গুলো সমাধানেও ধীরগতি।
চলতি বছরের এপ্রিল মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শারিরীক শিক্ষা কেন্দ্রের সুইমিংপুলে ডুবে মৃত্যু হয় ঢাবি শিক্ষার্থী সোহাদের। মে মাসের শুরুতে তদন্ত কমিটি গঠন করে সাত দিনের সময় দিলে তারা মেয়াদ বাড়িয়ে ১৫ দিন করে। কিমতু এখনও মেলেনি তদন্ত রিপোর্ট খোলা হয়নি সুইমিংপুল। এসব নিয়ে কারও কোনো পদক্ষেপ বা হস্তক্ষেপ কোনোটাই লক্ষ করা যাচ্ছে না।
এদিকে গত এক সপ্তাহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে হয়েছে একাধিক রদবদল। কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরকে সুবিধানুযায়ী এক জায়গা থেকে সরিয়ে অন্য জায়গায় দেওয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে সুবিধা পাচ্ছে বিএনপি পন্থী কর্মকর্তা কর্মচারীরা। বড় বড় পদগুলো দখলের জন্য ইতোমধ্যে নানা জায়গায় তদবির ও জোর জবরদস্তির অভিযোগ উঠেছে বিএনপিপন্থী কর্মকর্তা কর্মচারীদের বিরুদ্ধে।
অভিযোগ রয়েছে, বিএনপিপন্থী কর্মকর্তা কর্মচারীরা এখন প্রশাসনিক ভবনের বড় বড় পদগুলো দখলে নেওয়ার জন্য বিভিন্ন জায়গায় তদবির চালাচ্ছেন। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক মামুন আহমেদ বিএনপিপন্থী হওয়ায় তার কাছে তদবির নিয়ে যাচ্ছেন কর্মকর্তা কর্মচারীরা এমন অভিযোগও উঠেছে।
প্রশাসনিক ভবন সূত্রে জানা যায়, মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের সিনিয়র এডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার আহসানুল কবির রেজিস্ট্রার ভবনে শিফট হতে চান, পরিবরহন অফিসের প্রধান হিসেবে কর্মরত আছেন কামরুল হাসান। তিনি পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক হতে চান। মনোবিজ্ঞান বিভাগের প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত আছেন মোহাম্মদ সফিউল্যাহ। তিনি উপাচার্যের অফিসে যোগ দিতে তদবির করছেন। এস্টেট অফিসে সহকারী এস্টেট ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত আছেন শাহেদ মিয়া। তিনি ট্রেজারার অফিসে আসতে চান। সিনিয়র সহকারী রেজিস্ট্রার হিসেবে স্বাস্থ্য-অর্থনীতি ইনস্টিটিউটে কর্মরত আছেন মোহাম্মদ মনির হোসেন। তিনি রেজিস্ট্রার অফিসের শিক্ষা-২ শাখার প্রধান হতে চান। এ পদে থাকা মুন্সি শামস উদ্দিন আহম্মদ লিটন সম্প্রতি ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার পদে নিয়োগ পেয়েছেন। সহকারী হিসাব পরিচালকের দায়িত্বে থাকা জহিরুল ইসলাম আসতে চান বিএনপিপন্থী কর্মকর্তাদের সাথে মহড়া দেয় এবং আরও ভালো পদের জন্য তদবির করছেন।
উপাচার্য অফিস থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে ৫ জিন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে। তারা হলেন, ভিসি অফিসের ডেপুটি রেজিস্ট্রার লাভলু মোল্লা শিশির, উপাচার্যের পিএস আরাফাত হোসেন, সেকশন অফিসার নিপু ইসলাম তন্বী, উচ্চমান সহকারী মাহমুদুল তানভীর এবং প্রধান সহকারী নয়ন হালদার।
আরাফাতের জায়গায় এসেছেন অর্থনৈতিক গবেষণা ব্যুরোর প্রিন্সিপাল রিসার্চ অফিসারের দায়িত্বে থাকা বিএনপি পন্থী আব্দুর রহমান। রোকেয়া হলের সিনিয়র এডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসারের দায়িত্বে থাকা মনিরুজ্জামানও শিফট হয়েছেন উপাচার্য অফিসে। উপাচার্য অফিসে বাঁকি ৩ টি পদ খালি থাকলেও ইতোমধ্যে তা দখলের জন্য চলছে নানা তদবির। প্রশাসন-৩ এর দায়িত্বে থাকা আমজাদ হোসেন শিশির তদবির করে পেয়েছেন কলেজ পরিদর্শকের পদ।
পদ দখলে বিএনপি পন্থীদের গতি বাড়লেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও প্রশাসনিক কার্যক্রম চলছে অত্যন্ত ধীর গতিতে। প্রশাসনের এমন অবস্থা প্রশাসনের প্রতি আস্থা হারিয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও।
নিরাপত্তা ও ধীরগতি প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক সাইফুদ্দিন আহমেদ বলেন, আমাদের সিকিউরিটি সার্ভেইলেন্স বক্স গুলো আসলেই কাজ করছে না। আমাদের আরও দক্ষ লোকবল প্রয়োজন। অল্প সময়ে আমাদের নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়েছে। শিক্ষা কার্যক্রম, হল চালু করা, টিএসসি থেকে ভাসমান দোকান উচ্ছেদ করা হয়েছে, আন্দোলনে হামলাকারীদের শনাক্তকরণে তথ্যানুসন্ধান কমিটি গঠন করা হয়েছে। তবে আমাদের প্রশাসনিক বিভাগগুলোতে সমন্বয় করতে একটু ধীরগতি হচ্ছে। তবে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয় ভালো কিছু দেখবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিং প্রসঙ্গে উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক মামুন আহমেদ বলেন, আমাদের যে উপাদান গুলো আছে সেগুলো র্যাংকিং যারা করে তাদের কাছে সঠিক ভাবে পৌঁছায়নি, নয়তো ভুল তথ্য গিয়েছে অথবা সব তথ্য যায়নি। এটা নিয়ে আমরা কাজ করছি।
সেশনজট নিরসন সম্পর্কে তিনি বলেন, বিভাগগুলোতে সেমিস্টারগুলোর সময় একটু কমানো হয়েছে। এতে করে কয়েক মাসের মধ্যেই আন্দোলন কালীন যে সময়টা লস হয়েছে সেটি পুরণ হয়ে যাবে।
কার্যক্রমে ধীরগতির বিষয়টি স্বীকার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা বলেন, আমাদের কার্যক্রম একটু ধীরে চলছে। আমাদের ২ মাসের প্রথম মাস তো শিক্ষা কার্যক্রম ফিরিয়ে আনতেই ব্যয় হয়েছে। পরবর্তীতে আমরা বার বার মিটিং করেছি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কার্যকরী এমন নানা পদক্ষেপও আমরা নিয়েছি। কাযে একটু ধীরগতি আছে না পিছুটানের কারণে তবে আশা করি এখন দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেওয়ার সময় হয়েছে এবং দ্রুতই ছোট ছোট অনেকগুলো কাজ দৃশ্যমান হবে।
তিনি বলেন, দায়িত্ব নেবার পর প্রথম মাস ছিলো শ্রেণি কার্যক্রম শুরু করা। নানা দ্বন্দ্ব সমাধান করে আমরা ১ম মাসে শ্রেণি কার্যক্রম শুরু করেছি। আমাদের ৯০ শতাংশ সময় একাডেমিক কাউন্সিলের মিটিং, ফাইন্যান্স কমিটির মিটিংসহ বিভিন্ম ফাইলের কাজ করতে করতেই চলে যায়। বাঁকি ১০ শতাংশ সময় হাতে নিয়েই আমরা কতগুলো প্লান নিয়ে কাজ করছি। কয়েকটি হল মেরামত নিয়ে আমাদের কাজের পরিকল্পনা হয়েছে। মেডিকেল সেন্টার নিয়ে কাজ শুরু করেছি সেখানে নারীদের জন্য ৩ তলায় ওয়াশরুম, ইমারজেন্সি ও ঔষধ কক্ষে এসি লাগানো, এম্বুলেন্সের ড্রাইভার নিয়োগসহ কয়েকটি কাজ করার চেষ্টা করছি। ক্যাম্পাসে শাটল বাসের ব্যাপারে কাজ করছেন কোষাধ্যক্ষ। খুব দ্রুতই এটার আপডেট জানা যাবে।
ছাত্র রাজনীতি ও ডাকসু নির্বাচন সম্পর্কে তিনি বলেন, ছাত্র রাজনীতি ও ডাকসু নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আমাদের একটা কমিটি করার চিন্তা-ভাবনা আছে। কিছুদিনের মধ্যেই এই চিন্তা ভাবনার বহিঃপ্রকাশ দৃশ্যমান হবে।
তিনি বলেন, আন্দোলনপরবর্তী সময়ে আমরা আস্তে আস্তে কাজ করে যাচ্ছি। ফুল স্পিডে কাজ করতে হলে আমাদেরকে আরেকটু সময় দিতে হবে। এজন্য তো কাজ ফেলে রাখা যাবে না। যাতে করে স্থবিরতা তৈরি না হয় এজন্য জরুরি এজেন্ডাগুলোকে কমিটি গঠনের মাধ্যমে বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে আমরা যেহেতু সৎভাবে কাজ করার চেষ্টা করছি অবশ্যই ভালো রেজাল্ট আসবে।
ভোরের আকাশ/ সু
মন্তব্য