‘সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের সড়ক অবরোধ’ এ শিরোনাম বাংলাদেশের মানুষের খুব চেনা। গত সাত বছরে বহুবার এমন শিরোনাম অবধারিতভাবে সামনে আনছে সেই প্রশ্ন- সংকট আসলে কোথায়? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত এই সাত কলেজের একটি ঢাকা কলেজ। সেই কলেজের শিক্ষার্থী আব্দুর রহমান বলছেন, তাদের সমস্যা অনেক। কিন্তু আত্মপরিচয়ের সংকটই এখন বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, স্বতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয়হীনতায় ভুগছে সাত কলেজ শিক্ষার্থীরা। আমরা নিজেদের পরিচয় দিতে গিয়ে নানা সমস্যার সম্মুখীন হই।
ক্ষমতায় পালাবদলের পর এই সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তি থেকে বেরিয়ে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন করছেন। আব্দুর রহমান সেই আন্দোলনকারীদের অন্যতম ‘ফোকাল পার্সন’। তার ভাষায়, আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় করে দেওয়াটাই এখন সাত কলেজের সব সমস্যা সমাধানের ‘একমাত্র উপায়’। রাজপথের আন্দোলনের সমান্তরালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ’ নামে একটি প্ল্যাটফর্মও গড়ে তুলেছেন তারা। এই কলেজগুলোর মধ্যে তিতুমীর কলেজের অনেক শিক্ষার্থী আবার চাইছেন, শুধু তাদের কলেজ নিয়েই একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হোক। সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও এবার কলেজগুলোর অধিভুক্তি বাতিলের দাবি তুলেছে।
শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ এ সমস্যার দায় চাপিয়েছেন বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর, যাদের সিদ্ধান্তে সাত কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়েছিল। তার ভাষায়, সেই ‘অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্তের’ কারণে এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাত কলেজ- উভয় পক্ষকেই ভুগতে হচ্ছে। তবে শিক্ষার্থীদের মূল দাবি ‘স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়’ স্থাপনের বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার একমত নয়। কীভাবে সমস্যার সমাধান করা যায়, সেই সুপারিশ দিতে সরকার বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি কমিটি করে দিয়েছে।
এক সময় দেশের সব ডিগ্রি কলেজ পরিচালিত হত ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। ১৯৯২ সালে সরকারি কলেজগুলোকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করে তখনকার বিএনপি সরকার। কিন্তু বিপুল সংখ্যক কলেজ সামলাতে গিয়ে হিমশিম দশা হয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের। সময়মতো পরীক্ষা নেওয়া বা ফল প্রকাশ করতে না পারায় দেখা দেয় দীর্ঘ সেশনজট। অ্যাকাডেমিক কার্যক্রমে দেখা দেয় স্থবিরতা। সনদের মান নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। চাকরির ক্ষেত্রে বৈষম্যের অভিযোগ তুলে শিক্ষার্থীরা তখনও রাস্তায় নেমেছিলেন। ২০১৪ সালের শেষ দিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় পরিদর্শনে গিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ২৭৯টি সরকারি কলেজকে বিভাগীয় পর্যায়ের পুরোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করার নির্দেশ দেন তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরের বছর তিনি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সঙ্গে এক বৈঠকে সরকারি কলেজগুলোকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আনার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার তাগিদ দেন। এর ধারাবাহিকতায় ঢাকার ঐতিহ্যবাহী সাত সরকারি কলেজকে ২০১৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নেওয়া হয়। কলেজগুলো হলো- ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজ ও সরকারি তিতুমীর কলেজ। সে সময় সিদ্ধান্ত হয়, এসব কলেজে ভর্তি পরীক্ষা, পাঠ্যসূচি ও পরীক্ষা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিচালিত হবে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সে সময় কলেজ ছিল দুই হাজার ১৫৪টি, শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ২০ লাখের বেশি। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত হওয়া সাত কলেজে তখন স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে এক লাখ ৬৭ হাজার ২৩৬ জন শিক্ষার্থী এবং এক হাজার ১৪৯ জন শিক্ষক ছিলেন। সে সময় দেশের অন্য সরকারি কলেজগুলোকেও ধারাবাহিকভাবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করার সিদ্ধান্ত ছিল, কিন্তু সাত কলেজের পর সেই উদ্যোগ আর এগোয়নি।
সাত কলেজকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করার পর শিক্ষার্থীদের মধ্যে শুরুতে বেশ উচ্ছ্বাস দেখা গিয়েছিল। তবে কিছুদিন না যেতেই তারা নানা সমস্যা তুলে ধরতে শুরু করেন। সেগুলোর সমাধান চেয়ে রাজপথে শুরু হয় আন্দোলন। সে সময় দীর্ঘমেয়াদি কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই সাত কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নেওয়ায় প্রশাসনিক ও অ্যাকাডেমিক বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ভবনে ‘হয়রানি’, অ্যাকাডেমিক ক্যালেন্ডার প্রকাশ না করা, সেশনজট, ফল প্রকাশে দীর্ঘসূত্রতা, ত্রুটিপূর্ণ ফলাফল প্রকাশ, রেকর্ড সংখ্যক শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হওয়া- ইত্যাদি সমস্যা নিয়ে আন্দোলন করতে দেখা যায় শিক্ষার্থীদের।
তাদের শিক্ষাঙ্গনে ফেরাতে বিভিন্ন সময়ে নানা পদক্ষেপ ঘোষণা করা হলেও কিছু সমস্যা এতটাই জটিল রূপ পায় যে অধিভুক্তির পর সাত বছরেও কলেজগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থিতু হতে পারেনি। জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সরকার পরিবর্তন হওয়ার পর অধিভুক্তি বাতিলের দাবিতে আন্দোলন জোরালো হয়েছে। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ‘ঢাবির সঙ্গে সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের বৈষম্য’ শীর্ষক একটি তালিকা দিয়েছেন আন্দোলনকারীদের ‘ফোকাল পার্সন’ আব্দুর রহমান। সেখানে অভিযোগ করা হয়েছে, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে গবেষণার জন্য বিভাগভিত্তিক শিক্ষকের অপ্রতুলতা রয়েছে কলেজগুলোতে। ভর্তি, রেজিস্ট্রেশন, মানোন্নয়ন, নন-কলেজিয়েটসহ বিভিন্ন খাতে যে পরিমাণ টাকা নেওয়া হয়, সে টাকার কতটুকু সাত কলেজের জন্য ব্যয় হয় সে হিসেবের কোনো জবাবদিহিতা থাকে না বলেও অভিযোগ করছেন আন্দোলনকারীরা।
কবি নজরুল সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী রিয়া কর্মকার বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এতদিন যাবত আমাদের সঙ্গে একটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মতো আচরণ করে আসছে। তারা টাকাটাই নেয় শুধু, আমাদের ক্লাস-পরীক্ষা সংক্রান্ত কোনো তদারকিই করছে না। শিক্ষার্থী অনুপাতে শিক্ষক সংকট, ক্লাসরুম সংকট, ভর্তি কার্যক্রমে দীর্ঘসূত্রতা, সাত কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের ল্যাবগুলোতে যন্ত্রপাতির অভাব, মানসম্মত লাইব্রেরির অপ্রতুলতা, সহশিক্ষা কার্যক্রমে অপর্যাপ্ত বরাদ্দ, সেমিস্টার পদ্ধতির ব্যবস্থা না থাকার অভাব নিয়েই চলছে কলেজগুলো। সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা তাদের সমাবর্তন পদ্ধতিকে ‘জঘন্য’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন অভিযোগের তালিকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ‘অনলাইন সমাবর্তন’কেও তারা বৈষম্য হিসেবে দেখেন। ঢাকা কলেজের দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী কাইফ ইসলাম বলেন, এমন সমাবর্তন পদ্ধতি অসম্মানজনক। এসব সমস্যার থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদের অধিভুক্তি থেকে মুক্ত হতে হবে। আমাদের নিজেদের একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থাকলে সেখানে আর বৈষম্য থাকবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সাত কলেজের সক্ষমতার বাইরে মাত্রাতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তি করছে অভিযোগ করে আন্দোলনকারীদের অন্যতম ‘ফোকাল পার্সন’ আব্দুর রহমান বলেন, ১০০ জন পড়ানোর ক্যাপাসিটি না থাকলেও ভর্তি করা হয় ৩৫০-এর উপর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সাত কলেজকে লোপাটের উপায় হিসেবে ব্যবহার করছেন। আন্দোলনের আরেক ‘ফোকাল পার্সন’ কবি নজরুল সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী জাকারিয়া বারী সাগর সাত কলেজের কিছু অ্যাকাডেমিক ‘অসংলগ্নতার’ কথা বললেন। তিনি বলেন, আমাদের ক্লাস নেন বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারভুক্ত শিক্ষকরা, প্রশ্ন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি ডিগ্রিধারী শিক্ষকরা, খাতা দেখেন পিএইচডি ডিগ্রিধারী শিক্ষকরা, যে শিক্ষকরা আমাদের ক্লাস নেন না, সিলেবাস জানেন না। ফলে আমাদের শিক্ষার্থীরা নিজেদের সেরাটা অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের শুধু রুটিন দেওয়াটাই কাজ মনে করে। অথচ ভর্তির সময় অর্থ বাণিজ্য করার জন্য ধারণ ক্ষমতার অনেক বেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তি করে।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা সমস্যার যে তালিকা করেছে, তাতে সাত কলেজের সার্টিফিকেটে ‘এফিলিয়েটেড’ শব্দটি থাকায় শিক্ষার্থীদের ভোগান্তির কথাও বলা হয়েছে। বলা হচ্ছে, ওই শব্দটির কারণে বিদেশে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ‘অসুবিধায়’ পড়তে হয় তাদের। পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষায় প্রায়ই ‘বিব্রত’ হতে হয়। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, পরীক্ষার মানোন্নয়ন ফি দিতে সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের পরিশোধ করতে হয় দুই হাজার টাকার বেশি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যা মাত্র ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা। কিছুদিন আগে সাত কলেজের পুনঃভর্তির জরিমানা ফি দ্বিগুণ করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। শিক্ষার্থীদের ‘গণহারে ফেল করিয়ে’ প্রতি বিষয়ে খাতা পুনঃনিরীক্ষণের জন্য ৮০০ টাকা করে আদায় করার অভিযোগও শিক্ষার্থীরা করেছেন।
২০১৭ সালে সাত কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হওয়ার সময় এর কারণ হিসেবে ‘উচ্চশিক্ষার মান বৃদ্ধির’ কথা বলেছিলেন তখনকার উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। এখন এ নিয়ে তিনি নতুন কিছু ভাবছেন কিনা জানার জন্য বারবার চেষ্টা করেও তার সঙ্গে কথা বলা যায়নি।
শিক্ষার্থীরা নতুন করে আন্দোলন শুরুর পর গত ২৪ অক্টোবর ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাতটি কলেজের অ্যাকাডেমিক ও প্রশাসনিক সমস্যা নিরসনকল্পে’ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবকে সভাপতি করে ১৩ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি শিক্ষার্থীরা প্রত্যাখ্যান করে, ‘বিশ্ববিদ্যালয় রূপান্তর কমিশন’ গঠনের দাবি জানিয়ে গত ২৯ অক্টোবর ‘শাটডাউন সায়েন্সল্যাব’ কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে নামে। পরে গত ৩১ অক্টোবর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সরকারি সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় শাখার উপসচিব মো. শাহীনুর ইসলামের সই করা বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত ২৪ অক্টোবর গঠিত কমিটির নাম ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাতটি সরকারি কলেজের অ্যাকাডেমিক ও প্রশাসনিক সমস্যা নিরসনকল্পে’-এর পরিবর্তে ‘সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের দাবি পর্যালোচনা ও সুপারিশ সংক্রান্ত কমিটি’ করা হল। সাত কলেজের সমস্যাগুলো সমাধানের লক্ষ্যে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করেই সমাধান খোঁজার চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন কমিটি সংশ্লিষ্টরা। ওই কমিটির সভাপতি এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের কলেজ অণুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ খালেদ রহীম বলেন, আমরা আমাদের এই কমিটিতে আরো নতুন সদস্য যুক্ত করব। আমরা শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিকেও অন্তর্ভুক্ত করব। এ সপ্তাহেই আমরা একটি সভা করব। সেখানেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে যে কমিটিই থাকছে নাকি কমিশন গঠন করা হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খান গত ২২ অক্টোবর সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিলের দাবিতে আন্দোলনরত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বলেছিলেন, সাত কলেজ থাকা না থাকা নিয়ে এখন আলোচনা হচ্ছে। আমরা চাচ্ছি সবাই মিলে একটা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে, এখানে কেউ আলাদা না। সবার মর্যাদা রক্ষা করে সাত কলেজের বিষয়ে একটি যৌক্তিক সমাধান করা হবে, আর এই সিদ্ধান্তটি হবে রাষ্ট্রীয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখানে একক কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।
এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ১ নভেম্বর এক বিবৃতির মাধ্যমে জানিয়েছে, তারা এ সমস্যা সমাধানে শিক্ষার্থীসহ গুরুত্বপূর্ণ অংশীজনদের সঙ্গে আরো আলোচনা করতে চায়। আন্দোলনের অন্যতম ‘ফোকাল পার্সন’ কবি নজরুল সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী জাকারিয়া বারী সাগর স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে শিক্ষার্থীদের ভাবনার কথা বলেছেন। স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি কল্পিত মডেল উপস্থাপন করে তিনি বলেন, আমরা একটি স্বতন্ত্র পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়ে ভাবছি, যেখানে আমরা একেকটি বিভাগ একেকটি কলেজে রাখতে চাচ্ছি। যেমন ঢাকা কলেজে কিছু ডিপার্টমেন্ট, ইডেন কলেজে কিছু ডিপার্টমেন্ট, কবি নজরুল কলেজে কিছু ডিপার্টমেন্ট। একইভাবে অন্য কলেজগুলোতে নতুন এই বিশ্ববিদ্যালয়টির ক্যাম্পাস বিস্তৃত হবে। যার নাম হতে পারে সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তি বাতিল এবং স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা না হলে সাত কলেজের সমস্যাগুলো দূরীভূত হবে না বলেই মনে করছেন আন্দোলনকারীরা। আন্দোলনকারীদের অন্যতম ‘ফোকাল পার্সন’ আব্দুর রহমান গত ৩১ অক্টোবর উপদেষ্টাদের সঙ্গে বৈঠকের প্রসঙ্গ ধরে বলেন, আমাদের সঙ্গে সভায় বিভিন্ন সমস্যার সমাধান নিয়ে কথা হয়েছে। বিভিন্ন মডেল প্রস্তাব করা হয়েছে। সব শিক্ষার্থীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে আমাদের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
এদিকে সাত কলেজের অন্যতম, সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীদের অনেকেই ইতোমধ্যে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় চেয়ে আন্দোলন করছেন। ওই কলেজের গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী আমিনুল ইসলাম এ আন্দোলনের অন্যতম মুখপাত্র। তিনি মনে করছেন, এ কলেজের বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার মত যাবতীয় অবকাঠামো বিদ্যমান। আমিনুল বলেন, উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে ও ঢাকা উত্তর সিটির চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করার কোনো বিকল্প নেই। ১৯৯৮ সালে থেকে এই কলেজে কোনো ইন্টারমিডিয়েট নেই, এখানে শুধু মাত্র স্নাতক ও স্নাতকোত্তর প্রোগ্রাম চলমান। ১৯৯৭, ২০০৫, ২০১১, ২০১৪ সর্বশেষ ২০২৪ দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা তিতুমীর বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি জানাচ্ছেন। এছাড়া ঢাকা উত্তর সিটিতে কোনো উল্লেখযোগ্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নেই। সেই জায়গা থেকে তিতুমীর কলেজের অবস্থান ও যোগ্যতা সার্বিক দিক বিবেচনায় তিতুমীর কলেজকে তিতুমীর বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করলে রাষ্ট্র, জনগণের সকলের জন্যই মঙ্গলজনক হবে। তবে একটি কলেজ নয়, সাতটি কলেজের সমন্বয়ে বিশ্ববিদ্যালয় গঠন ‘সঠিক সমাধান’ বলে মনে করছেন অন্য কলেজগুলোর শিক্ষার্থীরা।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুনও সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য ‘একটি স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়’ গঠনকেই সমস্যার সমাধান হিসেবে দেখছেন। তিনি বলেন, সাত কলেজ সমস্যার সমাধান একটাই। সেটা হলো সাতটি কলেজকে একটি ছাতার নিচে নিয়ে আসতে হবে। একটি স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় গঠনের মাধ্যমে সেটি করা যেতে পারে। এছাড়া অন্যান্য উপায়ে সমস্যা সমাধান করতে পারবে কি না সেটা সরকার জানে। তবে তাদেরকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধিভুক্তি থেকে বের হয়ে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। সাত কলেজ অধিভুক্তির মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলেও মনে করছেন অধ্যাপক কামরুল। তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এর মাঝে আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বিভিন্ন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় গিয়ে ক্লাস নিচ্ছেন। তার ওপর যদি ঢাকা কলেজ, ইডেন কলেজের মতো বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর আসে তখন সেটা সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য