কেস স্টাডি ১. শিশুটির নাম সামিয়া জাহান (ছদ্ম নাম)। বয়স ৬ বছর। সে ভর্তি হতে ইচ্ছুক রাজধানীর মোহাম্মপুরে একটি স্কুলে। তার জন্ম সনদে সমস্যা নেই। সমস্যায় পড়তে হলো সামিয়ার বাবার জন্ম সনদ নিয়ে। বাবা ফরিদুল ইসলামের জন্ম ৭৫ সালে; তখন তো জন্ম সনদ ছিল না। তাদের গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রাম। দীর্ঘদিন যাতায়াত না থাকায় চেয়ারম্যানের কাছে সনদ আনার সময়ও নেই। ফলে চাইলেও সামিয়া ভর্তি যুদ্ধে অংশ নিতে পারছে না।
কেস স্টাডি ২. লক্ষ্মীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চায় ফরহাদ হোসেন (ছদ্মনাম)। কিন্তু সে আবেদন করতে পারছে না। কারণ তার মায়ের জন্ম নিবন্ধনের কপি আবেদনপত্রের সঙ্গে দেয়া হয়নি। ফরহাদের মা ফারহানার জন্মস্থান ঢাকা। তিনি জন্ম নিবন্ধন করতে পারেননি।
কেস স্টাডি ৩. রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা নুসরাত জাহান তার দুই সন্তান সাদমান মুকতাদির ও সালাম মুকতাদিরকে স্কুলে ভর্তি করাতে চান। সন্তানদের জন্মসনদ করাতে তিনি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অঞ্চল-৫ এর আঞ্চলিক কার্যালযয়ে যান। সেখানে সন্তানদের জন্ম সনদের জন্য বাবা-মায়েরও জন্ম সনদ চাওয়া হয়। এটা ছাড়া অনলাইনে আবেদনই করা যাচ্ছে না।
কেস স্টাডি ৪. মহুয়া সুলতানার বাসা রাজধানীর মিরপুর ১০ নম্বর এলাকায়। তার তিন সন্তান। ছোট দুইজন যমজ। বয়স ৪ বছর। নতুন বছরের শুরুতেই সন্তানদের বিদ্যালয়ে ভর্তি করাবেন। তাই দরকার সন্তানদের জন্মসনদ। নিবন্ধনের জন্য গত সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে দৌড়ঝাঁপ করছেন মহুয়া। সম্প্রতি এই নারীর সঙ্গে কথা হয় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) আওতাধীন মিরপুর-১৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়ে। এখনও সনদ হাতে পাননি তিনি। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) আঞ্চলিক কার্যালয়-২-এ গিয়ে বেশ ভিড় দেখা গেল। অনেক অভিভাবক সন্তানের জন্ম সনদ করাতে এসেছেন। একই উদ্দেশ্যে মুগদা থেকে এসেছিলেন বেসরকারি চাকরিজীবী হৃদয় আহমেদ। সন্তানকে বিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে জন্ম সনদ লাগবে। কিন্তু তাকেও ঘুরতে হচ্ছে।
অভিভাবকদের অভিযোগ, আগে বাবা-মায়ের জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়েই সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করানো যেতো। কিন্তু অভিভাবকদের জন্ম সনদের বিধান পরিস্থিতিকে অহেতুক জটিল করে তুলেছে। এতে যতটা না ভালো হয়েছে, এর চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। অনেক বাবা-মায়ের বাবা-মা (দাদা-দাদি, নানা-নানি) মারা যাওয়ায় তাদের জন্মসনদ নিতে যেসব তথ্য দরকার সেগুলো দিতে পারছেন না। ফলে পদে পদে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। তারা বলছেন, এখন যারা অভিভাবক তাদের জন্মের সময়ে জন্ম সনদ নেয়ার চর্চাই ছিল না। পরিণত বয়সে এসে শুধু নিয়ম রক্ষার জন্য সনদের কাগজ করিয়ে নেওয়ার মানে নেই। বরং এই পদ্ধতি অনেক অনিয়মের জন্ম দিচ্ছে। জন্ম নিবন্ধনে বংশানুক্রম নির্ধারণের জটিলতা এড়াতে অনেক অভিভাবকই জন্ম নিবন্ধন অফিসের কর্মচারীদের ম্যানেজ করছেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দাদা-দাদির ভুয়া তথ্য দিয়ে সনদ তৈরি করা হচ্ছে। কোনো ক্ষেত্রে উৎকোচের বিনিময়ে লিখে দেয়া হচ্ছে বাবা-মায়ের সনদের তথ্য।
শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে বলা হচ্ছে, বংশানুক্রম নির্ধারণের চিন্তা এবং পারিবারিক ধারাবাহিকতা মেলাতে আওয়ামী লীগ সরকার এই উদ্যোগ নিয়েছিল। সম্পদের উত্তরাধিকার যেন সঠিকভাবে নিরুপণ করা যায় সেই চিন্তা থেকেই এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। যাদের জন্ম ২০০১ খ্রিস্টাব্দের পর তাদের জন্ম নিবন্ধনের জন্য বাবা-মায়ের জন্ম সনদ বাধ্যতামূলক করা হয়। তারপর থেকেই ভোগান্তি বেড়ে যায় অভিভাবকদের। তবে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধকের কার্যালয়ের রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. জাহিদ হোসেন এ বিষয়ে কথা বলতে চাননি। শুধু বলেছেন, পুরো বিষয়ে বলতে হলে কাগজপত্র দেখে বলতে হবে। রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়, জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন’-এর তথ্য অনুযায়ী, এ বছর সারা দেশে জন্ম নিবন্ধনের আবেদনের সংখ্যা ছিল ৩৮ হাজার ৫৫। তারমধ্যে জন্ম নিবন্ধন হয়েছে ৩৩ হাজার ৯১৮টি।
ডিএসসিসির অঞ্চল-২ এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা রেজাউল করিম প্রতিবেদককে বলেন, প্রতি বছর বিদ্যালয়ে ভর্তির মৌসুমের শুরু থেকেই অর্থাৎ, সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে জন্মসনদ সংগ্রহের চাহিদা বেড়ে যায়। ফলে এ সময়ে কাজের চাপও বাড়ে। প্রয়োজনে অতিরিক্ত জনবল দিয়ে হলেও বাড়তি চাপ সামলাতে হয়। যদিও এবারের পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। শিক্ষার্থীদের সরকারবিরোধী আন্দোলনের জেরে জুলাইয়ে দেশজুড়ে জন্ম নিবন্ধনের প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়েছে। আন্দোলনের সময় ১৮ থেকে ২৩ জুলাই টানা পাঁচ দিন মোবাইল ও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ ছিল। মোবাইল ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ ছিল প্রায় ১০ দিন। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিভিন্ন ওয়ার্ড কাউন্সিলর, ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যানরা আত্মগোপন করেন। কার্যালয়গুলোয় ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও হামলা করা হয়। সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলরদের অপসারণ করা হয়। এসব কারণে আগস্ট ও সেপ্টেম্বরের বড় অংশজুড়ে অনেক জায়গায় জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের কাজ বন্ধ থাকে। সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে এসে জন্ম নিবন্ধনের আবেদন বাড়তে থাকে। বর্তমানে অসংখ্য আবেদন নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। আরো অগণিত অভিভাবক আবেদনই করতে পারছেন না বলে জানা গেছে।
প্রসঙ্গত, বর্তমানে যেকোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সন্তানকে ভর্তি করাতে গেলে জন্মসনদ বাধ্যতামূলক। এছাড়া নতুন পাসপোর্ট ইস্যু, বিবাহ নিবন্ধন, সরকারি-বেসরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ, ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যু, ভোটার তালিকায় নাম তোলা, জমি রেজিস্ট্রেশন, জাতীয় পরিচয়পত্র, লাইফ ইন্স্যুরেন্স পলিসিসহ প্রায় ১৮ রকম নাগরিক সেবা মেলে জন্ম সনদে।
জন্ম নিবন্ধনের সনদ নিতে বর্তমানে বয়স ভেদে জন্ম নিবন্ধনের জন্য যেসব তথ্য ও নথি দরকার হবে সেগুলো নিচে তুলে ধরা হল-
শূন্য থেকে ৪৫ দিন বয়সী শিশুর জন্ম নিবন্ধনের জন্য লাগবে টিকার কার্ড; পিতা-মাতার অনলাইন জন্ম নিবন্ধনসহ জাতীয় পরিচয়পত্র; বাসার হোল্ডিং নম্বর ও চৌকিদারি ট্যাক্সের রশিদের হাল সনদ; আবেদনকারী/অভিভাবকের মোবাইল নম্বর; ফরমের সঙ্গে এক কপি রঙিন পাসপোর্ট সাইজের ছবি।
৪৬ দিন থেক ৫ বছর বয়সীদের জন্ম নিবন্ধন নিতে লাগবে টিকার কার্ড/স্বাস্থ্যকর্মীর প্রত্যয়নপত্র স্বাক্ষর ও সিলসহ প্যাডে হতে হবে; পিতা-মাতার অনলাইন জন্ম নিবন্ধনসহ জাতীয় পরিচয়পত্র; প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে স্কুলের প্রধান শিক্ষকের প্রত্যয়নসহ বিদ্যালয়ের প্রত্যয়নের সব প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট লাগবে; বাসার হোল্ডিং নম্বর ও চৌকিদারি ট্যাক্সের রশিদের হাল সনদ; আবেদনকারী/অভিভাবকের মোবাইল নম্বর; ফরমের সঙ্গে এক কপি রঙিন পাসপোর্ট সাইজের ছবি।
বয়স ৫ বছরের বেশি হলে লাগবে শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদপত্র (পিএসসি/জেএসসি/এসএসসি) শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদপত্র না থাকলে সরকারি হাসপাতালের এমবিবিএস ডাক্তারের স্বাক্ষর ও সিলসহ প্রত্যয়ন সনদ এবং জন্ম নিবন্ধন আবেদন ফরমের ৭ এর ১ নং কলামের স্বাক্ষর ও সিল বাধ্যতামূলক। যাদের জন্ম ২০০১ খ্রিস্টাব্দের ১ জানুয়ারির পর তাদের ক্ষেত্রে পিতা-মাতার অনলাইন জন্ম নিবন্ধনসহ জাতীয় পরিচয়পত্র বাধ্যতামূলক; যাদের জন্ম ২০০১ খ্রিস্টাব্দের ১ জানুয়ারির আগে তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র বাধ্যতামূলক; যদি জন্ম ২০০১ খ্রিস্টাব্দের আগে হয় সেক্ষেত্রে পিতা-মাতা মৃত হলে মৃত্যু সনদ বাধ্যতামূলক; যাদের জন্ম ২০০১ খ্রিস্টাব্দের ১ জানুয়ারির পর তাদের পিতা-মাতা মৃত হলে প্রথমে অনলাইন জন্ম নিবন্ধন গ্রহণ করার পর অনলাইন মৃত্যু নিবন্ধন সনদ গ্রহণ করতে হবে। উভয় সনদ আবেদনপত্রের সঙ্গে জমা দিতে হবে। বাসার হোল্ডিং নম্বর ও চৌকিদারি ট্যাক্সের রশিদের হাল সন; আবেদনকারী/অভিভাবকের মোবাইল নম্বর; ফরমের সঙ্গে এক কপি রঙিন পাসপোর্ট সাইজের ছবি; আবেদনের সঙ্গে কাগজপত্র সরকারি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য/নারী সদস্যদের স্বাক্ষরসহ সিল বাধ্যতামূলক।
২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে করা সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, ২০০১ সালের পর জন্ম নেওয়া ব্যক্তিদের জন্ম নিবন্ধন করাতে হলে মা-বাবার জন্ম সনদ থাকা আবশ্যিক। জাতিসংঘ শিশু অধিকার কনভেনশনের অনুচ্ছেদ ৭ অনুযায়ী, জন্মনিবন্ধন করতে হবে শিশুর জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই। আর রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের এক নির্দেশিকায় শিশুর জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যে জন্ম নিবন্ধনের ব্যাপারে তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
ভোরের আকাশ/ সু
মন্তব্য