- শৃঙ্খলা ফেরাতে কঠোর অবস্থানে মন্ত্রণালয়
- সরানো হয়েছে দুই দপ্তরের শীর্ষ চার কর্মকর্তাকে
রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার এসে শিক্ষা প্রশাসনে ব্যাপক রদবদল শুরু করে। বিভিন্ন দপ্তরের শীর্ষ পদগুলোতে বিএনপি ও জামায়াত ঘরানার কর্মকর্তাদের পদায়ন করে তারা। তবে শিক্ষা প্রশাসনের অস্থিরতা এতে কাটেনি। নিজ নিজ দপ্তরে আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে রেষারেষিতে জড়িয়ে পড়ছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা। এ অবস্থায় শৃঙ্খলা ফেরাতে কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, শৃঙ্খলা আনার অংশ হিসেবে গত বৃহস্পতিবার দুটি দপ্তরের শীর্ষ চার কর্মকর্তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে একজন বিএনপিপন্থি প্রভাবশালী কর্মকর্তাও রয়েছেন। বিশৃঙ্খলা করছেÑ এমন অভিযোগ পেলে ভবিষ্যতেও যে কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জানা গেছে, ৫ আগস্টের পর বদলি বাণিজ্য, দপ্তরে দপ্তরে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন কিছু কর্মকর্তা। এ কারণে শিক্ষাবোর্ডসহ আরও কয়েকটি দপ্তরে ব্যাপক রদবদল হয়েছে। সামনের সপ্তাহে আরও বড় পরিবর্তনের আভাস দিয়েছেন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা।
একজন অতিরিক্ত সচিব বলেন, আগের সরকারে থাকা কর্মকর্তাদের সরিয়ে বিভিন্ন দপ্তরের শীর্ষ পদে রদবদল করা হচ্ছে। কিন্তু বেশ কয়েকটি দপ্তরে নিজেদের মধ্যে রেষারেষি মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে। শৃঙ্খলা বজায় রাখতে দুটি দপ্তরের শীর্ষ চার কর্মকর্তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তারা সবাই ৫ আগস্টের পর পদায়ন পেয়েছেন। এ ছাড়া যারা দুর্নীতি বা অদক্ষতার পরিচয় দেবেন তাদের ব্যাপারেও একই সিদ্ধান্ত আসবে।
এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (কলেজ) মো. নুরুজ্জামান বলেন, যাদের বদলি করা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাভঙ্গের নানা অভিযোগ রয়েছে। নতুন বাংলাদেশে আগের মতো করে প্রশাসন চালাবেন এমনটা হতে দেওয়া হবে না। সামনে আরও কঠোর সিদ্ধান্ত আসতে পারে।
আওয়ামী সরকারের পতনের পর শিক্ষা প্রশাসনের জাতীয়তাবাদী প্যানেল থেকে প্রথম পদায়ন হিসেবে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) পরিচালক করা হয় প্রফেসর কাজী কাইয়ুম শিশিরকে। তিন মাস না যেতেই গত বৃহস্পতিবার ময়মনসিংহের মুমিনুন্নিসা সরকারি মহিলা কলেজে বদলি করা হয় ১৪তম বিসিএসের এই কর্মকর্তাকে। নিজ দপ্তরে আওয়ামী লীগের সময়ের কর্মকর্তাদের রক্ষা, আশ্রয়, অফিসার্স ক্লাবের সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে অশালীন আচরণ এবং প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণের কারণে তাকে বদলি করা হয়। শিক্ষা ক্যাডার ও নিজ দপ্তরে অর্থের বিনিময়ে পদায়ন করাতে একটি বলয় গড়ে তোলার চেষ্টা করছিলেন তিনি। এসব বিষয় মন্ত্রণালয়ের নজরে আসার পর তার বিরুদ্ধে কঠোর এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
শিক্ষা ক্যাডারের প্রভাবশালী এই কর্মকর্তার সঙ্গে একই দপ্তরের যুগ্ম পরিচালক মো. আবু আল কায়সারের দ্বন্দ্ব শুরু হয় দুই মাস আগে। শেখ হাসিনার পতনের একদিন আগে ৪ আগস্ট শিক্ষাভবনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে খুনি বলে সেøাগান দেন আওয়ামীপন্থি কিছু কর্মকর্তা। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ডিআইএ-এর কর্মকর্তা। ডিআইএ-এর এই কর্মকর্তাদের কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হলেও পরবর্তীতে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ার অভিযোগ ছিল কাইয়ুম শিশিরের বিরুদ্ধে। এ ক্ষেত্রে অভিযুক্ত কর্মকর্তারা মোটা অঙ্কের টাকা লেনদেন করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
ডিআইএ সূত্র বলছে, গেল সপ্তাহে ‘সেøাগান দেওয়া’ ছয়জনকে বিভিন্ন অঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শনে পাঠান পরিচালক। যদিও যুগ্ম পরিচালক তাদের পাঠাতে নিষেধ করেন। এ নিয়ে দ্বিতীয় দফায় দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এর মধ্যে কক্সবাজারে গিয়ে একটি টিম জনতার রোষানলে পড়ে।
মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব বলেন, ডিআইএতে কে আধিপত্য ধরে রাখবেন তা নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু হয় তাদের মধ্যে। অভ্যন্তরীণ অনেক সিদ্ধান্তের বিষয়ে তারা দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। এই মুখোমুখি অবস্থান থেকে অধিদপ্তরকে রক্ষা করতে পরিচালককে বদলি করা হয়েছে। জানতে চাইলে পরিচালক প্রফেসর কাজী কাইয়ুম শিশির বলেন, ৪ আগস্ট শুধু ডিআইএ নয়, শিক্ষাভবনের অনেকেই সেøাগান দিয়েছেন। অন্য দপ্তরগুলো কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি। এখন আমি যদি ব্যবস্থা নিতাম তাহলে সমালোচনা হতো। যুগ্ম পরিচালকের সঙ্গে দ্বন্দ্বে প্রসঙ্গে বলেন, দপ্তরটি খুবই টেকনিক্যাল দপ্তর। নতুন যারা আসেন প্রথম অবস্থায় কোনো কাজ বোঝেন না। সেজন্য আমি চেয়েছিলাম নতুন-পুরোনো কর্মকর্তা মিলিয়ে একটি টিম গঠন করতে। কিন্তু উনি সেটা চাননি। সম্প্রতি পরিচালক কাইয়ুমকে ঢাকা অফিসার্স ক্লাবের সদস্যপদ থেকেও সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। অসদাচরণ, ক্লাবের পাওনা পরিশোধে ব্যর্থতা ও গঠনতন্ত্রের বিধি লংঘন করায় তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময় শিক্ষাপ্রশাসনে প্রভাবশালী কর্মকর্তা ছিলেন তিনি। আওয়ামী লীগের ১৬ বছর তিনি ঢাকার বাইরে ছিলেন বেশি। সর্বশেষ কুড়িগ্রামের একটি কলেজে ছিলেন। আওয়ামী লীগ সরকার তার বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগ তুলে বিভাগীয় মামলাসহ নানা হয়রানি করে।
৫ আগস্টের পর শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী পদে পদায়ন পান রায়হান বাদশা। তার সঙ্গে প্রধান কার্যালয়ের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আফরোজা বেগম ও সমীর কুমার রজক দাসকে পদায়ন করা হয়। দুর্নীতি ও অদক্ষতার অভিযোগে এই তিনজনকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সিলেটের অন্তত ১১৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি ধামাচাপা দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে রায়হান বাদশার বিরুদ্ধে। তিনি দুর্নীতি আড়াল করতে সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলীকে জোরপূর্বক অনির্দিষ্টকালের ছুটিতে পাঠিয়েছেন বলেও অভিযোগ উঠেছিল। আর সমীর কুমার রজক দাসের বিরুদ্ধে নিয়মিত দপ্তরে না থাকা এবং নথিপত্র ও ড্রইং-ডিজাইন আটকে রেখে ঠিকাদারদের হয়রানি করার অভিযোগ রয়েছে।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের কয়েকটি শাখায় বেশকিছু পদে পরিবর্তন আনা হয়েছে। মাউশির ওএসডিতে থাকা কাজী ফয়জুর রহমানকে বোর্ডের বিদ্যালয় পরিদর্শক করা হয়েছে। আগের বিদ্যালয় পরিদর্শক আবুল মনছুর ভুঞাকে চট্টগ্রামে বদলি করা হয়েছে। মাধ্যমিকের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক রফিকুল ইসলামকে রাজবাড়ীতে পাঠানো হয়েছে। তার স্থলে পদায়ন পেয়েছেন ঢাকা উদ্যান কলেজে সংযুক্ত জাকির হোসেন। কলেজ শাখার উপ-পরিদর্শক কল্যাণী নন্দীকে ওএসডি করে তার স্থলে পদায়ন করা হয়েছে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছানা উল্লাহকে। উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক জাকির হোসেনকে দিনাজপুর ফুলবাড়ী কলেজে বদলি করা হয়েছে। তার জায়গায় পদায়ন পেয়েছেন ইডেন মহিলা কলেজে এনসিটু থাকা নুরুল হক। প্রশাসন ও সংস্থাপন শাখার উপ-সচিব খান খলিলুর রহমানকে ফরিদপুরে পাঠানো হয়েছে। তার স্থলে পদায়ন পেয়েছেন ঢাকা আলিয়া মাদরাসার সহযোগী অধ্যাপক ইমদাদ জাহিদ। এনসিটিবির গবেষণা কর্মকর্তা রুবেল হোসাইনকে যশোর শিক্ষাবোর্ডের অডিট অফিসার হিসেবে পদায়ন করা হয়েছে। একই বোর্ডের উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নিয়ামত ইলাহীকে বদলি করা হয়েছে। যশোর বোর্ডের অডিট অফিসার খুরশিদ আলম মল্লিককে এক ধাপ পদোন্নতি দিয়ে একই বোর্ডে উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক করা হয়েছে। একইভাবে কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ডের উপ-কলেজ পরিদর্শক হিসেবে পদায়ন পেয়েছেন চৌদ্দগ্রাম সরকারি কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন মজুমদার। একই বোর্ডের উপ-মাধ্যমিক পরিদর্শক হয়েছেন গোলাম মহিউদ্দিন। এছাড়া দেশের ১১টি সরকারি কলেজে নতুন অধ্যক্ষ এবং তিনটি কলেজে উপ-অধ্যক্ষ দিয়েছে সরকার। আর ১১টি শিক্ষাবোর্ডে শিগগিরই আরও বড় ধরনের রদবদল হবে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কলেজ শাখার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য