-->
শিরোনাম

থেমে গেল কোকিলকণ্ঠ

বিনোদন ডেস্ক
থেমে গেল কোকিলকণ্ঠ
লতা মঙ্গেশকর। ফাইল ছবি

উপমহাদেশের কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী লতা মঙ্গেশকর আর নেই। রোববার সকালে তিনি মারা গেছেন। তার বয়স হয়েছিল ৯২ বছর। 

ভারতের একাধিক সংবাদমাধ্যম রোববার সকালে এই খবর জানিয়েছে।

সুরসম্রাজ্ঞীর মৃত্যুতে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে দুই দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে। তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন ভারতের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীসহ অসংখ্য মানুষ।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একাধিক টুইটে শোক জানিয়ে বলেছেন, ‘তার মৃত্যুতে সংস্কৃতি জগতে এক শূন্যতা তৈরি হয়েছে। এই শূন্যতা কখনো পূরণ হবে না।’

তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সোমবার অর্ধদিবস ছুটি ঘোষণা করল পশ্চিমবঙ্গ সরকার। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, আগামী ১৫ দিন রাজ্যে বাজবে লতার গাওয়া গান।

সূত্রের খবর, রোববার সন্ধে সাড়ে ৬টায় মুম্বাইয়ের শিবাজি পার্কে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় লতা মঙ্গেশকরের শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে। তার আগে লতার প্রভুকুঞ্জের বাড়িতে শায়িত থাকবে দেহ। সেখানে মানুষ শিল্পীকে শেষশ্রদ্ধা জানাতে পারবেন।

লতা মঙ্গেশকরের মৃত্যুতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। রাষ্ট্রপতি তার শোকবার্তায় লতা মঙ্গেশকরের আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। 

লতা মঙ্গেশকরের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, এই সুরসম্রাজ্ঞীর মৃত্যুতে উপমহাদেশের সঙ্গীতাঙ্গনে এক বিশাল শূন্যতার সৃষ্টি হলো। তিনি আরো উল্লেখ করেন, লতা মঙ্গেশকর তার কর্মের মধ্য দিয়ে চিরদিন এ অঞ্চলের মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন।

লতা মঙ্গেশকরের মৃত্যুত গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। স্পিকার এক শোকবার্তায় তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা এবং শোক-সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।

লতা মঙ্গেশকরের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। শোকবার্তায় তিনি তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।

শোকবার্তায় সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী বলেন, সুরসম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকরের সুরেলা কণ্ঠ দিয়ে মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধ করার এক অতুলনীয় ক্ষমতা ছিল। তার মৃত্যুতে উপমহাদেশের সঙ্গীতাঙ্গনে এক বিশাল শূন্যতার সৃষ্টি হলো।

কে এম খালিদ বলেন, সুরের জাদু দিয়ে তিনি উপমহাদেশের কোটি কোটি সঙ্গীতপ্রেমী মানুষকে মোহাবিষ্ট করে রেখেছিলেন এবং তাদের হৃদয়ে ঠাঁই করে নিয়েছিলেন। তিনি তাঁর সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে চিরদিন এ অঞ্চলের মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন।

আনন্দবাজারের এক প্রতিবেদনের শিরোনাম করা হয়েছে, ২৭ দিনের লড়াই শেষ, স্তব্ধ হল কোকিলকণ্ঠ, অন্য সুরলোকে চলে গেলেন লতা মঙ্গেশকর।

প্রতিবেদনে জানানো হয়, প্রায় চার সপ্তাহ ধরে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন শিল্পী। সম্প্রতি অবস্থার উন্নতিও হচ্ছিল। কিন্তু শনিবার আচমকা তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে। দিতে হয় ভেন্টিলেশনে। সেখান থেকে আর ফেরানো যায়নি লতাকে। রোববার সকালে তিনি প্রয়াত হন।

করোনায় আক্রান্ত হওয়ায় গত ১১ জানুয়ারি লতা মঙ্গেশকরকে মুম্বাইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। নিউমোনিয়াও আক্রান্ত ছিলেন তিনি। প্রথম থেকেই তাকে আইসিইউতে রাখা হয়।

৩০ জানুয়ারি তার করোনা নেগেটিভ রিপোর্ট আসে। কিন্তু বয়সজনিত নানা সমস্যার কারণে শেষ পর্যন্ত আর লড়তে পারলেন না তিনি। এর আগেও সঙ্কটজনক অবস্থায় একাধিকবার হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়েছিল লতাকে।

১৯২৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর লতার জন্ম এক মারাঠি পরিবারে। মাত্র ১৩ বছর বয়সে বাবাকে হারান। তার আগে অবশ্য বাবার হাত ধরেই অভিনয় এবং গান শিখতে শুরু করে দিয়েছিলেন। ১৩-১৪ বছর বয়সেই প্রথম বার সিনেমায় গান গাওয়া। মরাঠি ছবিতে। মুম্বই যাওয়ার পর ১৯৪৮ সালে প্রথম হিন্দি ছবিতে গান। ‘মজবুর’ ছবিতে।

বিবিসি বাংলা জানিয়েছে, লতা মঙ্গেশকর ছিলেন এমন একজন কিংবদন্তীর প্লেব্যাক গায়িকা, যিনি ভারতের চলচ্চিত্র জগতের সঙ্গীতকে অন্যরকম এক মাত্রা এনে দিয়েছিলেন।

‘নাইটিঙ্গেল অব ইন্ডিয়া’ আখ্যা পাওয়া লতা মঙ্গেশকর অর্ধশত বছরের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে ভারতের ৩৬টি ভাষায় প্রায় ৩০ হাজার গান গেয়েছেন।

দশকের পর দশকজুড়ে তিনি ছিলেন ভারতের সবচেয়ে বেশি চাহিদাসম্পন্ন সঙ্গীত শিল্পী। বলিউডের প্রত্যেক শীর্ষ অভিনেত্রী চাইতেন, চলচ্চিত্রে তাদের গানটি যেন তাকে দিয়ে গাওয়ানো হয়।

পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে লতা মঙ্গেশকর ছিলেন সবার বড়। তার অন্য ভাইবোনেরাও তার পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন এবং তারাও ভারতের নামকরা গায়ক-গায়িকা হয়েছেন।

বলিউডের সকল বিখ্যাত গায়কের সঙ্গে তিনি গান গেয়েছেন। তাদের মধ্যে আছেন মোহাম্মদ রফি, কিশোর কুমার।

সেই সঙ্গে বলিউডের শীর্ষ সব পরিচালকের সঙ্গে তিনি কাজ করেছেন, যাদের মধ্যে আছেন রাজ কাপুর এবং গুরু দত্ত থেকে শুরু করে মনি রত্নম এবং করন জোহর।

মোহাম্মদ রফির মতো যে পুরুষ গায়করা অনেক গান গেয়েছেন বলে দাবি করতেন, তাদের চ্যালেঞ্জ করার মতো সাহস ছিল মঙ্গেশকরের। তিনি ছিলেন প্রথম গায়িকা যিনি গান গাওয়ার জন্য ভালো পারিশ্রমিক এবং লভ্যাংশ দাবি করেছিলেন।

‘আমি হচ্ছি একজন স্ব-প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি। আমি জানি কীভাবে লড়াই করতে হয়। আমি কখনো কাউকে ভয় পাইনি। আমি খানিকটা ভয়হীন ধরনের মানুষ,’ বলেছিলেন তিনি।

লতা মঙ্গেশকর ক্রিকেটের একজন গোঁড়া সমর্থক। অনেক সময় রেকর্ডিংয়ে বিরতি দিয়ে টেস্ট ম্যাচ খেলা দেখতে গিয়েছেন। ডন ব্রাডম্যানের স্বাক্ষর করা একটি ছবি তার গর্বের একটি জিনিস।

মাঝে মাঝে রান্না করা এবং রোলেইফ্লেক্স ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলা তার শখের অন্যতম। যুক্তরাষ্ট্রে ছুটি কাটানোর সময় তিনি লাস ভেগাসে সারারাত ধরে স্লট মেশিনে খেলতে ভালোবাসতেন।

লতা মঙ্গেশকরকে অনেক সময় তার বন্ধু সেতার মাস্টার রবি শঙ্করের স্টুডিওতে দেখা যেতো, যেখানে তিনি বন্ধু জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে আড্ডা দিতেন। ১৯৭৯ সালে তিনি ছিলেন প্রথম ভারতীয় যিনি রয়্যাল আলবার্ট হলে ওরেন অর্কেস্ট্রার সঙ্গে সঙ্গীতানুষ্ঠান করেছেন।

‘আমি সবসময়ে মনে করি, আনন্দ হলো বিশ্বের সবার সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেয়ার জিনিস আর দুঃখ হলো নিজের ভেতরে চেপে রাখার,’ একবার বলেছিলেন লতা মঙ্গেশকর।

তার কালজয়ী সঙ্গীত অবশ্যই ভারতের লক্ষ লক্ষ মানুষের জন্য আনন্দ বয়ে এনেছে এবং নাসরীন মুন্নী কবির যেভাবে বলেছেন, তাদের জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে এসব সঙ্গীত।

আনন্দবাজার জানিয়েছে, সুরসম্রাজ্ঞী ও অনন্য প্রতিভাময়ী সর্বজনশ্রদ্ধেয় লতা মঙ্গেশকর দীর্ঘ আট দশক ধরে কণ্ঠের জাদুতে শ্রোতাদের মুগ্ধ করে রেখেছিলেন। হিন্দি, মারাঠি, বাংলাসহ ছত্রিশটিরও বেশি ভারতীয় ও বিদেশি ভাষায় তার গাওয়া অগণিত ক্লাসিকাল,গজল, ভজন, আধুনিক ও সিনেমার গান আজও সমান জনপ্রিয়।

ভারতরত্ন, পদ্মবিভূষণ, পদ্মভূষণ, দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার, লিজিয়ন অফ অনার, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্টস' অ্যাসোসিয়েশন অ্যাওয়ার্ড সহ অজস্র পুরস্কার ও সম্মানে তিনি ভূষিত হয়েছেন।

মন্তব্য

Beta version