উপমহাদেশের কিংবদন্তি জাদুকরী কণ্ঠশিল্পী লতা মঙ্গেশকরের মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমেছে দুনিয়াজুড়ে। বাংলা তো বটেই, বাংলাদেশের সিনেমাতেও গেয়েছেন এই কিংবদন্তি। তার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল এই দেশের শিল্পীদের। কাছের মানুষের বিদায়ে ভেঙে পড়েছেন বাংলাদেশের শিল্পীরা। লতাজিকে নিয়ে তাদের স্মৃতিচারণা তুলে ধরা হলো ভোরের আকাশের পাঠকদের জন্য।
তিনি এখন স্বর্গে সুরের মূর্ছনা ছড়াবেন : রুনা লায়লাযে কণ্ঠ আমার মতো কোটি কোটি মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে, তিনি হয়তো এখন স্বর্গে সুরের মূর্ছনা ছড়াবেন। বছরের পর বছর ভালোবাসা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধায় পরিপূর্ণ একটি সুন্দর বন্ধন গড়ে ওঠে আমাদের। আমরা যেন একে অপরের বন্ধু হয়ে উঠেছিলাম। আমরা প্রায় প্রতিদিনই মেসেজ আদান-প্রদান করতাম। ফোনে দীর্ঘ কথোপকথনে সাধারণত গান নিয়ে আলাপ হতো আমাদের। তার অনুমতি নিয়ে জোকস পাঠানোরও সাহস করেছিলাম, যেগুলো তিনি বেশ উপভোগ করেছেন। দিদির দারুণ রসবোধ ছিল। এ বিষয়ে নিজের কিছু অভিজ্ঞতা আমার সঙ্গে ভাগাভাগি করেছেন। আমরা বেশ হাসিখুশি সময় কাটাতাম। তার কথা শুনতে ভালো লাগত আমার। সেই মধুর ঝরনার মতো কণ্ঠ আমার কানে যেন গান হিসেবে বাজত। আমার মধ্যে এমন এক বিমর্ষ অনুভূতি ও শূন্যতা ভর করেছে যা কখনো ফুরানোর নয়। আমি সেই সুন্দর কণ্ঠ আর শুনতে পারব না। দিদির মুখে আর শোনা হবে না রুনাজি আপ ক্যায়সি হ্যায়?
তিনি চিরভাস্বর হয়ে থাকবেন : সৈয়দ আব্দুল হাদিলতাজির চলে যাওয়া শুধু ভারত কিংবা বাংলাদেশের জন্য নয়, পুরো উপমহাদেশ তথা বিশ^সংগীতের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম তার গান শুনছে। আমরাও তার গান শুনে বেড়ে উঠেছি। এখনো প্রতিদিন তার গান শুনি। যারা গান ভালোবাসেন তারা লতাজিকে চিনেন না এমন শ্রোতা খুঁজে পাওয়া দুস্কর। তার মতো কণ্ঠের অধিকারী আর কেউ হবেন না। কোনোভাবেই তার নাম এবং সংগীতকে আলাদা করা যায় না। তার সৃষ্টিকে অন্য কারো সঙ্গে তুলনা করার উপায় নেই। সৃষ্টির মধ্য দিয়ে তিনি চিরভাস্বর চির অমলীন হয়ে থাকবেন। নতুন প্রজন্মের যারা গান করছেন তাদের উচিত হবে লতাজির গানগুলোকে বাঁচিয়ে রাখা। কোনোভাবে যেন তার গানগুলো নষ্ট না হয়ে যায় সেদিকে সবার দৃষ্টি রাখা।
যত বড় শিল্পী মানুষ হিসেবে ছিলেন ততই বিনয়ী : সাবিনা ইয়াসমিনকী বলব আর! বলার মতো ভাষা নেই। আমি ভাগ্যবান যে লতাজির সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল, কথা হয়েছিল। সেই মুহূর্তগুলো আজও আমার মনে ভর করে। এখন সেদিনের স্মৃতি খুব মনে পড়ছে। এত বড় মাপের শিল্পী কিন্তু কাছে গিয়ে বোঝার উপায় নেই। একটা কথা তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন, যত বড় শিল্পী ছিলেন, মানুষ হিসেবে ছিলেন ততই বিনয়ী। আমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল ১৯৭৮ সালে। আমরা একটা ফেস্টিভালে বোম্বে গিয়েছিলাম। আমার সৌভাগ্য যে উনার সামনে গাইতে পেরেছিলাম। উনার সঙ্গে ছবি আছে। সেটা বের করে সকাল থেকেই দেখছিলাম। সেই সফরে আমি, ববিতা, রাজ্জাক, রোজী সিদ্দিকী ছিলাম। সেখানে ছিলেন শচীন দেববর্মন। তিনি বারবার বলছিলেন, ‘অনেক দিন বাংলা গান শুনি না। কতদিন বাংলা গান শুনি না। তুই একটা গান গা।’ তখন আমি ‘পাল তুলে দে’ গানটি গাইলাম। উনি কাঁদলেন। আমাকে জড়িয়ে ধরলেন।’
তিনি থাকবেন : ফরিদা পারভীন তার মতো শিল্পী আর জন্মাবে না। একদিন সবাইকে চলে যেতে হবে। তার বয়স হয়েছেল ৯২। এক দীর্ঘ জীবন। এই সময়ে তিনি অনেক দিয়েছেন। তার গান ভালোবাসতেন না এমন কেউ সম্ভবত নেই। তবে তার কাছ থেকে আমাদের আরো অনেক কিছু পাওয়ার ছিল। গানের মধ্য দিয়ে তিনি আমাদের সঙ্গে থাকবেন।
তাকে নিয়ে কিছু বলার যোগ্যতা আমার নেই : কর্নিয়ালতাজি নেই ভাবতে কষ্ট হচ্ছে। আসলে তাকে নিয়ে বলার মতো কোনো যোগ্যতাই হয়নি আমার। কাছ থেকে তাকে দেখা হয়নি কোনো দিন। কিন্তু তার বহু সাক্ষাৎকার শুনেছি। তিনি সব সময় বলেছেন, লতার মতো হতে হবে এমন নয়, সবার যার যার মতো। নিজে চেষ্টা কর নিজের মতো করে তাহলেই লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে। তার প্রতিটি কথা অনুপ্রেণরা দেয়। আর তার গানের কথা কী বলব। ভারতের মানুষও তার নামে পূজা করেন। সংগীতে তার অবদান ভোলার নয়। আমার আম্মা তার গুণে বেড়ে উঠেছেন, আমরাও তার গান শুনতে শুনতে বড় হয়েছি। খুব মিস করব শ্রদ্ধেয় লতাজিকে। আমরা যারা এখন গান করছি আমাদের উচিত হবে তার গানের সুর তাল-লয় সব ঠিক রেখে গাওয়া। আমরা যদি তার গান পরিবেশন করার সময় সচেতন না হই তাহলে তাকে অশ্রদ্ধা করা হবে।
তার সঙ্গে দেখা করার জন্য সেই শো ছেড়ে দিয়েছিলাম : আঁখি আলমগীর একবার ‘একটি সিনেমার গল্প-চলচ্চিত্রের গান রেকর্ডিংয়ের জন্য আমরা ভারতে গিয়েছিলাম। রেকর্ডিংয়ের আগে আগে লতাজির সঙ্গে দেখা করার সুযোগটা হয়েছিল। আর সেটা করে দিয়েছিলেন রুনা আন্টি। ২৬ মার্চ অস্ট্রেলিয়ায় আমার একটা শো ছিল। তার সঙ্গে দেখা করার জন্য সেই শোটা ছেড়ে দিয়েছিলাম। কারণ দেখা করার তারিখ ছিল ২৭ মার্চ। শো করে ভারতে গিয়ে দেখা করা কঠিন ছিল। তাই শো ছেড়ে দিয়ে ভারতে চলে যাই। লতাজির সঙ্গে দেখা করার আগের রাতে আমি একটুও ঘুমাতে পারিনি।’
মন্তব্য