সাম্প্রতিক সময়ে সংশোধিত কপিরাইট আইনে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিজ ওনার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এমআইবি)-এর নেতা ও সদস্যরা। তাদের অভিমত, নতুন কপিরাইট আইনের মাধ্যমে মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে বিশৃঙ্খলা আরো বাড়বে। শুধু তাই নয় ডিজিটাল মাধ্যমে নাটক, সিনেমা ও গান প্রকাশে তৈরি হবে নানা প্রতিবন্ধকতা। যা দেশ তথা ইন্ডাস্ট্রির জন্য সুখকর বার্তা বয়ে আনবে না।
এক বিজ্ঞপ্তিতে মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিজ ওনার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ জানিয়েছে, কপিরাইট আইন-২০২১-এ এমন কিছু আইন যুক্ত হচ্ছে, যা প্রযোজক, শিল্পী, সুরকার, গীতিকবিদের মধ্যে ভারসাম্য নষ্ট করবে। পরস্পরের প্রতি যে আস্থা ও বিশ্বাস রয়েছে সেটিও নষ্ট হবে। এ ছাড়া এ আইনের মাধ্যমে একজন শিল্পী, সুরকার. গীতিকার, নির্মাতা চাইলে তার সৃষ্টি কোনো প্রযোজকের কাছে এককালীন বিক্রি বা বিপণনের সুযোগ পাচ্ছেন না।
তারচেয়ে বড় বিষয়, শিল্পী-প্রযোজকদের যৌথ সম্মতিতে যে চুক্তিই হোক না কেন, সেটি যে কোনো সময় বাতিল করার অধিকার রাখবে কপিরাইট বোর্ড। আরো জানা গেছে, কোনো প্রযোজক নাটক বা সিনেমা ক্রয় করার পর সেটির গান বা ক্লিপ আলাদা করেও পরিবেশন করতে পারবে না নতুন আইনের কারণে।
যা প্রযোজকদের হাত-পা বেঁধে সমুদ্রে ফেলে দেওয়ারই নামান্তর বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ প্রসঙ্গে মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিজ ওনার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এমআইবি)-এর প্রধান এবং লেজার ভিশনের অন্যতম কর্ণধার একেএম আরিফুর রহমান বলেন, ‘আমরা যারা নিয়মিত কাজ করছি, তাদের সবকিছুই তো চলমান কপিরাইট আইনের ভিত্তিতে চলছে।
কিন্তু আপত্তিটা নতুন আইনের কিছু সংশোধনী নিয়ে। যেটা মোটেই কাম্য নয়। আমার কথা, যার বা যাদের গান, তারা যদি আমার চুক্তিপত্রে হাসিমুখে স্বাক্ষর করেন, সেটিতে অন্যপক্ষের হস্তক্ষেপ কেন থাকবে? ফলে নতুন যে আইনটি হচ্ছে সেটি আরো প্রপারলি, স্পষ্ট ও সংস্কৃতিবান্ধব হওয়ার দাবি জানাই।’
এদিকে দেশের আরেক প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সাউন্ডটেকের কর্ণধার সুলতান মাহমুদ বাবুল বলেন, ‘এ মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে পুরো জীবন কাটিয়ে দিয়েছি। নতুন আইন পাস হলে মামলা আমাদের পিছু ছাড়বে না। এভাবে এ আইন পাস হলে আমাদের প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে হবে।
কারণ নতুন আইনের মাধ্যমে পুরনো প্রযোজকরা ঘরে ফিরে যেতে বাধ্য হবে। বিপরীতে নতুন কোনো ইনভেস্টর এ ইন্ডাস্ট্রিতে যুক্ত হবে না।’
‘যদি রাত পোহালে শোনা যেত, বঙ্গবন্ধু মরে নাই’- এই ঐতিহাসিক গানের রচয়িতা, চেনা সুরের কর্ণধার ও এমআইবির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট হাসান মতিউর রহমান নতুন কপিরাইট আইন প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমাদের অর্থায়নেই গড়ে উঠেছে অডিও শিল্প। তবুও আমরা কখনো বলিনি সবকিছু আমাদের দিয়ে দিন।
বরাবরই চেয়েছি, একসঙ্গে থেকে আমাদের শিল্প-সংস্কৃতির বিকাশে এগিয়ে যেতে। কিন্তু বার বার সে অগ্রযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। হতাশার বিষয়, এমন একটি আইন হচ্ছে, যেটা সম্পর্কে আমরা এখনো পুরোপুরি অন্ধকারে আছি। আমরা জানি না, এ আইনে আসলে কী আছে, কী নেই। আইনটি চূড়ান্ত অনুমোদনের আগে আমরা এটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাই, এটুকুই দাবি করছি।
এদিকে কপিরাইট আইন-২০২১ প্রণয়ন নিয়ে অস্বস্তি প্রকাশ করেছেন দেশের আরেক অন্যতম প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সিডি চয়েসের কর্ণধার জহিরুল ইসলাম সোহেল। তিনি বলেন, ‘গত ৫০ বছরে আমার মতো শত শত প্রযোজক প্রাণের টানে এ অঙ্গনে এসেছেন, ফিরে গেছেন নি:স্ব হয়ে।
আমরা এখনো যে কয়েকজন টিকে আছি, প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে চলেছি। নতুন আইন হলে এ কয়েকজনও বাড়ি ফিরে যাব। তাই আমার আবেদন, আইনটি চূড়ান্ত করার আগে সবার মতামত নিন।’ দেশের অন্যতম সংগীতশিল্পী এবং ধ্রুব মিউজিক স্টেশনের কর্ণধার ধ্রুব গুহ বলেন, ‘নতুন আইনের কারণে যদি প্রযোজক-পরিবেশকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে পুরো ইন্ডাস্ট্রিই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
কারণ যেকোনো নাটক, সিনেমা ও গান তৈরি এবং পরিবেশনার পেছনে একজন প্রযোজকের কনট্রিবিউশন ভুলে গেলে চলবে না। কিন্তু নতুন কপিরাইট আইনের কিছু ধারার বিষয়ে আমরা জানতে পারছি, যার ফলে শিল্পী-প্রযোজকদের মধ্যে অবিশ্বাস ও বিশৃঙ্খলা বাড়বে বলেই আমি মনে করি।
তাই এ ধরনের আইন সংশোধনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট পক্ষের মতামত/বক্তব্য নেওয়াটা জরুরি।’ চলচ্চিত্রভিত্তিক দেশের প্রাচীন প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান অনুপম রেকর্ডিং মিডিয়া। প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার ও এমআইবির সহসভাপতি মো. আনোয়ার হোসেন নতুন কপিরাইট আইন নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করেন।
তিনি বলেন, ‘চার দশকের প্রতিষ্ঠান আমার। অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যদিয়ে এ পর্যন্ত এসেছি। প্রতিনিয়ত চেষ্টা করছি বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ও গানের বিকাশে কাজ করার। অথচ এ পর্যায়ে এসে নিজেকে অসহায় মনে হচ্ছে। বর্তমানে যে আইন হচ্ছে বলে শুনছি, তাতে করে গান করার ইচ্ছা শক্তি হারিয়ে ফেলছি।’
এদিকে দেশের আরেক প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ঈগল মিউজিকের কর্ণধার কচি আহমেদ বেশ স্পষ্ট করেই তুলে ধরেন তাদের ক্ষোভ বা হতাশার বিষয়টি। তিনি বলেন, ‘ধরুন আমি একটি গান প্রযোজনা ও পরিবেশনার জন্য সংশ্লিষ্ট ক্রিয়েটরদের সঙ্গে চুক্তি করলাম। কিন্তু কপিরাইট বোর্ড চাইলে আমাদের সেই যৌথ চুক্তি বাতিল করতে পারবে!
এটা কেমন কথা। তার মানে, আমাদের কারো কোনো মতের বা স্বাধীনতার গুরুত্ব থাকছে না! এটা কেমন আইন। শুনছি নতুন কপিরাইট আইনে এমন কিছু ধারা যুক্ত হচ্ছে। যে আইনগুলো আমাদের মতো মানুষগুলোকে নিরুৎসাহিত করবে।’
মন্তব্য