-->
চিরদিনই আমি যে তোমার

যুগে যুগে তুমি আমারই

ইসমত জেরিন স্মিতা
যুগে যুগে তুমি আমারই

ভারতীয় সংগীতজগতে আবারো শোকের ছায়া নেমে এসেছে। কণ্ঠের জাদুতে কয়েক দশক ধরে সংগীতের মাধ্যমে মাতিয়ে রেখেছিলেন যারা শ্রোতাসহ সবাইকে। মৃত্যু যেন হঠাৎ করেই নাড়া দিয়ে বসেছে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে। একে একে ঝরে পড়ছে নক্ষত্রগুলো। তবে খুব কাছাকাছি সময়ে এমন চলে যাওয়া একটু বেশিই বেদনাদায়ক।

সুরের পাখি লতা, সন্ধ্যাকে হারানোর শোকের ভেতরেই খবর এলো আরও এক কিংবদন্তিকে হারানোর। ভারতের মুম্বাইয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেলেন উপমহাদেশের কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী বাপ্পি লাহিড়ী।মৃত্যুকালে এই সংগীতশিল্পীর বয়স হয়েছিল ৬৯ বছর।

গত মঙ্গলবার রাতে মুম্বাইয়ের একটি হাসপাতালে মারা যান এই কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী। অসংখ্য বাংলা ও হিন্দি চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দেওয়া বাপ্পি লাহিড়ী একাধারে ছিলেন গীতিকার, সুরকার, সংগীত পরিচালক ও গায়ক।বয়স যখন মাত্র তিন।

তখন মঞ্চে তবলা বাজাতে শুরু করে ছোট্ট অলোকেশ লাহিড়ী, সেই ছোট ছেলেটাই একদিন হয়ে ওঠে ভারতের ‘ভারতের ডিস্কো কিং’। যাকে সবাই এক ডাকে চেনেন ‘বাপ্পি লাহিড়ী’ নামে। ১৯৫২ সালের ২৭ নভেম্বর জলপাইগুড়িতে জন্মগ্রহণ করেন বাপ্পি।

ছোটবেলা থেকেই সুরের জগতের মানুষ ছিলেন বাপ্পি। তার বাবা অপরেশ লাহিড়ী ছিলেন বাংলা সংগীতের অন্যতম জনপ্রিয় গায়ক। মা বাঁশরী লাহিড়ী ছিলেন শাস্ত্রীয় সংগীতশিল্পী। বাপ্পি লাহিড়ী শুধু একজন সংগীত পরিচালকই ছিলেন না, প্লে-ব্যাকও করেছেন সমানতালে। পিতা-মাতার সান্নিধ্যেই তার সংগীতে হাতেখড়ি।

তিনি বাংলার গর্ব, বাঙালির গর্ব। ১৯ বছর বয়সে দাদু (১৯৭২) নামক বাংলা চলচ্চিত্রে প্রথম কাজ করেন তিনি। গানের জগতের সফরটা বাংলা ছবির সঙ্গে শুরু করলেও খুব দ্রুতই মুম্বাইয়ে পাড়ি দেন তিনি। তার স্বপ্ন ছিল মামার (কিশোর কুমার) মতো বলিউডে রাজ করবেন।

বলিউডে তার প্রথম কাজ ছিল ‘নানহা শিকারি’ (১৯৭৩)। এই ছবির গীতিকারের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এরপর পরিচালক তাহির হুসনের ‘জখমি’ ছবিতে গান লেখার পাশাপাশি গেয়েও ছিলেন বাপ্পি লাহিড়ী। আশির দশকের বলিউডে উল্কা গতিতে তার উত্থান।

পরপর হিন্দি ছবিতে কম্পোজ করা সুর থেকে তার গানে বুঁদ হয়েছিল আসমুদ্রহিমাচল। মিঠুন চক্রবর্তীর ‘ডিস্কো ড্যান্সার’ ছবির মিউজিক কম্পোজ করে রাতারাতি সুপারস্টারে পরিণত হয়েছিলেন বাপ্পি লাহিড়ী। তার জনপ্রিয়তা ভারতের গ-ি পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ে বিদেশে। এরপর থেকেই ‘ডিস্কো কিং’ নামে পরিচিতি লাভ করেন এই বাঙালি গায়ক।

ডিস্কো মিউজিকের ব্যবহার তার মতো আগে কেউ কোনোদিন করেনি ভারতীয় সিনেমায়। কিশোর কুমার, আশা ভোঁসলে থেকে ঊষা উত্থুপ, রথী-মহারথীদের সঙ্গে কাজ করেছেন বাপ্পি লাহিড়ী। সুরক্ষা, ওয়ারদাত, চলতে চলতে, কমান্ডো, ইলজাম, ডিস্কো ড্যান্সার, ড্যান্স ড্যান্স, ফিল্ম হি ফিল্ম, সাহেব, টারজান, কসম পয়দা করনে ওয়ালে কি, নমক হালাল- অজস্র ছবির সুপারহিট গানের স্রষ্টা তিনি।

‘শরাবী’ ছবির গান কম্পোজ করে ফিল্মফেয়ারের মঞ্চে সেরা সংগীত পরিচালকের পুরস্কার এসেছিল তার ঝুলিতে। শুধু সংগীত পরিচালনা নয়, গায়ক বাপ্পি লাহিড়ীও কম জনপ্রিয় ছিলেন না। তার হিন্দি উচ্চারণে বাংলা টান ছিল স্পষ্ট, সেই বাঙালিয়ানা আজীবন কাটিয়ে উঠতে পারেননি তিনি।

বা বলা যায় সেই বাংলা টান কাটানোর চেষ্টা ছিল না তার। সেই নিয়েই বোম্বাই সে আয়া মেরা দোস্ত (আপ কি খাতির) থেকে বোম্বাই নাগারিয়া (ট্যাক্সি নং ৯২১১) বা হু লা লা (ডার্টি পিকচার)Ñ সব জায়গাতেই অপ্রতিরোধ্যা বাপ্পি লাহিড়ী।

শুধু ডিস্কো সংগীতের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকেননি বাপ্পী লাহিড়ী। বেশ কিছু গজল গানও রচনা করেছেন তিনি। কিসি নজর কো তেরা ইন্তেজার আজ ভি হ্যায় (এইতবার), আওয়াজ দি হিয়া (এইতবার) তার মধ্যে অন্যতম।শুধু বাপ্পিদার গান নয়, তার ফ্যাশন স্টেটমেন্ট বরাবর ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।

সোনার প্রতি তার প্রেম অজানা নয়। তার মুখের হাসিটাও কম জনপ্রিয় ছিল না, সব সময় ঠোঁটের কোণে লেগে থাকত সেই হাসি। সবাইকে কাঁদিয়ে না-ফেরার দেশে পারি দিলেন বাপ্পি লাহিড়ী। তার প্রয়াণে শোকস্তব্ধ গোটা সংগীতজগৎ।

বাপ্পি লাহিড়ী রাজনীতিতেও নেমেছিলেন। বিজেপিতে যোগ দিয়ে পশ্চিমবঙ্গেও শ্রীরামপুর কেন্দ্র থেকে ভোটেও লড়েছিলেন। কিন্তু রাজনীতিতে কখনোই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেননি তিনি।

বাপ্পি লাহিড়ীর মৃত্যুতে তারকাদের প্রতিক্রিয়া

বাংলা সংগীতে অনবদ্য দিয়ে গেছেন বাপ্পি লাহীড়ি। শুধু অডিও গানেই নয় প্লেব্যাকেও তিনি ছিলেন সেরাদের সেরা। এই তারকার মৃত্যুতে বিভিন্ন অঙ্গনের তারকাদের প্রতিক্রিয়া তুলে ধরা হলো...

বাবাকে দেখে অবাক হতাম! এখন সেই সোনার চেন আর সানগ্লাস ফ্যাশন : বাপ্পা লাহিড়ী

‘যখন ছোট ছিলাম, তখন ভাবতাম- সবাই কেন আমার বাবার সাজপোশাক নিয়ে কথা বলে। এখন পিছন ফিরে তাকালে মনে হয়, বাবা তার ছাপ রেখে গিয়েছেন।’ ৭০-এর দশকে সাজপোশাকের ক্ষেত্রে চেনা ছকের বাইরে নিজস্ব ধারা তৈরি করেছিলেন বাপ্পি। বেল বটম, টানটান শার্টের ভিড়ে হয়ে উঠেছিলেন ‘আলাদা’। সংগীতজগতের মানুষদের ক্ষেত্রে তখন এমন প্রথা ভাঙার চল ছিল না। কিন্তু গান হোক বা সাজ, ব্যতিক্রমী হয়ে উঠেছিলেন ‘জিমি জিমি’র স্রষ্টা। পেশায় সংগীত পরিচালক বাপ্পার কথায়, ‘অনেকেই এখন তাকে অনুসরণ করে সোনার চেন পরেন। সানগ্লাস পরেন। আমি জানতাম, আমার বাবা একজন বিশিষ্ট মানুষ। আমি তাকে নিয়ে গর্বিত।’

Raj Bappi

 

সাত সুর তার গলায় বশ মানত : শান্তনু মৈত্র

বাপ্পিদাকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। আমার প্রতিটি গানের সুর উনি শুনেছেন। সেটা নিয়ে আলোচনাও করতেন। তার সঙ্গে গানের রিয়্যালিটি শোতে বিচারক হয়েছি। প্রতিযোগীরা তার যেন সন্তানের মতো। সারাক্ষণ প্রশংসা করে ওদের মনের জোর বাড়াতেন। বাপ্পিদার চরিত্রের ছায়া তার গানে। তার গান মানেই সেখানে নানা বাদ্যযন্ত্র আর অফুরন্ত প্রাণশক্তি। বাপ্পিদার গানের ছন্দে পা মেলাতে গিয়ে নতুন স্টেপ আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন স্বয়ং অমিতাভ বচ্চন। পরে যা কাল্ট হয়ে যায়। ‘নমকহালাল’ ছবির ‘পগ ঘুঙরু বান্ধ’ গানের দৃশ্যটাই ভাবুন। এটাই বাপ্পি লাহিড়ী।

 

বাপ্পিদার পোশাক নিয়ে বহু বিতর্ক, কিন্তু একজন সুরের রাজাকে ওই জৌলুসেই মানাত : ঋতুপর্ণা

আমি যদি ভুল না হই, বাংলায় শেষ রেকর্ডিং বোধ হয় আমার সঙ্গেই করে গেলেন তিনি। দুই মাস আগে আমাকে ডেকে গান গাওয়ার জন্য জোর করলেন।এত গুণী মানুষ, অথচ যখন মিশতেন মনে হতো না, কোনো খ্যাতনামা কারো সঙ্গে কথা বলছি। ওঁর পরিবারটাও সে রকম। ইদানীং নাতির কথা বলতেন। ও যে ভালো কাজ করছে, নিজের জায়গা তৈরি করেছে, তা নিয়ে নিশ্চিন্ত ছিলেন বাপ্পিদা।

 

চিরদিনই তুমি যে আমার, যুগে যুগে আমি তোমারই বাপ্পিদা : প্রসেনজিৎ

বাপ্পিদা চলে যাবেন, আমি সত্যি ভাবতে পারিনি। প্রসেনজিৎ-বাপ্পি লাহিড়ী জুটি অদ্ভুতভাবে কাজ করেছিল। ‘অমর সঙ্গী’ থেকে শুরু করে আমার অনেক ছবিতে বাপ্পিদা গান গেয়েছেন। তার বাইরেও আমার হিন্দিতে যে কয়টা ছবি, তার সব ক’টিতেই বাপ্পিদার সুর ছিল। বাংলাতেও আমাদের জুটির প্রতিটি গান হিট।তিনি যা সৃষ্টি করে গিয়েছেন, সংগীত এবং সিনেমাজগতের ইতিহাসে সেই অবদান অসামান্য। ‘চিরদিনই তুমি যে আমার, যুগে যুগে আমি তোমারই...’ বাপ্পিদা। যেখানে থাকবে, ভালো থাকবে।

 

প্রশ্ন করেছিলাম, বিদেশি সুর চুরি করেন কেন : মীর

বাপ্পিদা পাশ্চাত্য সংগীতকে আমাদের কাছে নিয়ে এসেছেন। কখনো কখনো তিনি গোটা সুর অন্য কোনো গান থেকে নিয়ে নিতেন। ছোটবেলায় তো বুঝতাম না সেই সুরের উৎস আছে সাগর পেরিয়ে। তাও ভালো লাগত! স্কুলে টেবিল বাজিয়ে গান গাইতাম। ছোট থেকেই বাপ্পিদাকে খুব মজার মানুষ মনে হতো।আমি সরাসরি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘আপনি তো সুর চুরি করেন। এভাবে সুর তুলে আনেন কেন?’ উনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমি ইনিস্পায়ার হই।’ বুঝতে পারিনি প্রথমবার। আবারো জিজ্ঞাসা করি। উত্তর পেলাম, ‘ইনিস্পায়ার।’ আমি বললাম, ‘আচ্ছা! আপনি ইনস্পায়ার্ড হন। উদ্বুদ্ধ হন।’

‘ডিস্কো কিং’ আখ্যাটাকে প্রতি মুহূর্তে বয়ে বেড়াতেন : জিৎ গঙ্গোপাধ্যায়

বাপ্পিদার ‘ডিস্কো ড্যান্সার’ দেশ ছেড়ে রাশিয়ার মাটিতেও জনপ্রিয়। রাজ কাপুরের পরে রাশিয়ায় মিঠুনদা কিংবদন্তি হয়েছেন এই ছবি, ছবির সমস্ত গানের বদৌলতে।

কতটা দক্ষ হলে ‘ওগো বধূ সুন্দরী’র গান আগে লেখা, পরে তাতে সুর বসাতে পারেন তিনি! এই মানুষগুলো চলে গেলে আমরা কী নিয়ে বাঁচব বলতে পারেন? বাঙালিই-বা আর কী নিয়ে গর্ব করবে?সূত্র : হিন্দুস্তান টাইমস।

মন্তব্য

Beta version