মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ: একসময় বিনোদনের উন্নতম সেরা মাধ্যম ছিল সংস্কৃতির অবিচ্ছদ অনুষঙ্গ যাত্রাপালা। কবে শীত আসবে এ অপেক্ষায় থাকতেন গ্রামবাংলার মানুষ। ফসল তোলার অপেক্ষায় থাকতেন কৃষক। ফসল ঘরে তুলে করতেন যাত্রার আয়োজন। কে কার চেয়ে ভালো যাত্রাদল নিয়ে আসতে পারেন, তা নিয়ে চলত প্রতিযোগিতা। সময়ের বিবর্তনে এখন সেই দিন নেই।
বলতে গেলে গ্রামবাংলা থেকে হারিয়ে গেছে এ যাত্রাপালা। সংস্কৃতির অবিচ্ছদ অংশ এ শিল্পের সুদিন ফিরিয়ে আনতে রাজধানীর শিল্পকলায় শুরু হয়েছে যাত্রা উৎসব। পরিছন্ন যাত্রা উপহার দিতেই এ উৎসবরে আয়োজন করেছে শিল্পকলা একাডেমি। যাত্রাশিল্প উন্নয়ন নীতিমালা-২০১২ বাস্তবায়ন ও যাত্রাদল নিবন্ধনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে শুরু হয়েছে ছয় দিনব্যাপী যাত্রা উৎসব-২০২৩। ১৪ জানুয়ারি ব্যতীত প্রতিদিন দুপুর ২টা থেকে রাত সোয়া ৯টা পর্যন্ত ৩৬টি যাত্রাদলের যাত্রাপালা মঞ্চস্থ হচ্ছে।
গত ১২ জনুয়ারি ২০২৩ একাডেমির নাট্যকলা ও চলচ্চিত্র বিভাগের ব্যবস্থাপনায় জাতীয় নাট্যশালার স্টুডিও থিয়েটার হলে অনুষ্ঠিত হয়। উৎসবের প্রথম দিনে মনীষা অপেরা, গোপালগঞ্জ এবং নিউ বাংলার মুখ নাট্য সংস্থা, জামালপুরের ‘কাশেম মালার প্রেম’; আয়নাল অপেরা, শেরপুর এবং রাজন অপেরা, জামালপুরের ‘আলোমতি প্রেমকুমার’ শীর্ষক যাত্রাপালা মঞ্চস্থ হয়। যাত্রাপালাগুলোর পালাকার ছিলেন সামছুল হক।
চুমকী অপেরা, গোপালগঞ্জের যাত্রাপালা ‘মানবী দেবী’র পালাকার এবং গোল্ডেন-৯ নাট্যগোষ্ঠী, ঢাকার ‘মায়ের চোখে জল’র পালাকার ছিলেন ‘ রঞ্জন দেবনাথ। পরের দিন মঞ্চস্থ হয় মায়ের চোখে জল, প্রেমের সমাধি তীরে এবং জেল থেকে বলছি। এদিন ৬টি শো হওয়া কথা থাকলেও জামালপুরের দুটি এবং ঢাঙ্গাইলের দল উপস্থিত না থাকায় তিনটি শো অনিুষ্ঠিত হয়। তবে প্রতিদিনই কিছু দল অনুপস্থিত থাকছে বলে জানা যায়।
১৮ জানুয়ারি এ উৎসবের পর্দা নামবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিল্পকলার এক কর্মকর্তা বলেন, আমরা প্রতিদিন ৬টি শো করার জন্য তৈরি। কিন্তু কোনো দল উপস্থিত না থাকলে আমাদের কিছু করার নেই। প্রকৃতপক্ষে যাত্রার কদর কমে যাওয়ায় শিল্পীদের এ অবস্থা হয়েছে। তবে দল কম থাকলেও দর্শক কিন্তু আসছেন। এটা ভালো খবর। জানা গেছে, প্রতিদিন নাট্য, সাহিত্য ও যাত্রাব্যক্তিত্বসহ যাত্রাশিল্প উন্নয়ন কমিটির সদস্যরা অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে যাত্রাপালা মূল্যায়ন করছেন।
তাদের মূল্যায়নের ভিত্তিতে যাত্রাদলগুলোকে নিবন্ধন প্রদান করা হবে। পালা মূল্যানয়কারী সম্মানীত সদস্যরা হলেন খায়রুজাহান মিতু, তাপস সরকার, মিলন কান্তি দে, নাসিরউদ্দিন ইউসুফ, মামুনুর রশীদ, রামেন্দু মজুমদার, ড. ইসরাফিল শাহীন, ড. আমিনুর রহমান সুলতান, ড. তপন বাগচী, সাইদুর রহমান লিপন, ইউসুফ হাসান অর্ক, লাকী ইনাম, ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, ওয়াহিদা মল্লিক জলি, কামাল উদ্দিন কবির, গোলাম সারোয়ার, প্রবীর মিত্র, মার্জিয়া আক্তার, অরুণা বিশ্বাস, রহমত উল্লাহ, ইউসুফ হাসান অর্ক, তামান্না হক সিগমা।
এছাড়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয় ও সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ১ জন করে প্রতিনিধি উপস্থিত থাকছেন। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ইতোমধ্যে ১৩টি যাত্রা উৎসবের মাধ্যমে ১৫৫টি যাত্রাদলকে নিবন্ধন প্রদান করেছে এবং ৯টি যাত্রাদলকে বিভিন্ন অভিযোগে নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে।
যাত্রার কথা মনে হলেই এমন দৃশ্য ভেসে আসে। চারদিকে পিনপতন নীরবতা। গ্রামের কিশোর থেকে বৃদ্ধ সবাই উপস্থিত। ছেলেদের হাতে হুক্কা অথবা বিড়ি আর মেয়েদের হাতে পানের বাটা কিন্তু কারো মুখে কোনো শব্দ নেই, মঞ্চের ওপর, খালি গলায় দারাজ কণ্ঠে অভিনেতা আর অভিনেত্রীর একের পর এক সংলাপ বিনিময় হচ্ছে। এরই মাঝে খলচরিত্রের আগমন ঘটল, তরবারি নিয়ে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে চারদিকে তুমুল উত্তেজনা কার জয় হবে।
এভাবে একটা সময় পালা শেষ হতো। নায়ক-নায়িকার দুঃখ দেখে চোখের পানি মুছতে মুছতে বাড়ি ফিরতেন সবাই। বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে একসময় এমন দৃশ্যই দেখা যেত। গ্রামের মতো নগরে যাত্রার আয়োজন হতো। সময় বদলেছে। কাল বদলেরর সঙ্গে সঙ্গে মানুষের রুচিও বদলে গেছে। এখন আর কেউ শীত আসার অপেক্ষায় থাকেন না। অপেক্ষায় থাকেন না যাত্রাপালার জন্য। বর্তমানে যাত্রাপালা মহাসংকটে পড়েছে।
যাত্রার এ করুণ দশার কারণে বেকার হয়ে পড়েছেন এ শিল্পের মানুষ। বিকল্প কর্মসংস্থানের অভাবে তাদের অনেকে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর যখন অনেক যাত্রাদল পূর্ববঙ্গ ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে যায়, তখন পাকিস্তান সরকার যাত্রাপালা ধর্মবিরোধী কাজ এমন কথা বলে ফতোয়াও জারি শুরু করে । তারা কখনো বাংলার লোকসংস্কৃতিকে সুনজরে দেখেনি। এরপর স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে যাত্রাপালা তার আগের রূপে ফিরতে পারেনি।
যত দিন গেছে, তা আরো নিম্নগামী হয়েছে। যদিও ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর দেশ স্বাধীন হলে অনেক যাত্রাদল নতুনভাবে গড়ে ওঠে এবং ভালো এবং জনপ্রিয় কিছু যাত্রা তারা উপহার দেয়। কিন্তু সত্তর দশকের শেষভাগ যাত্রাশিল্পে অবক্ষয় শুরু হয়। তবে যাত্রার ইতিহাস বহু প্রাচীন। বাঙালির অভিনয়ে প্রবেশ নাটকের মাধ্যমে হওয়ার আগে যাত্রার মাধ্যমে শুরু হয়। এ বিষয়ে কারো কোনো দ্বিমত নেই।
তবে সর্বজনবিদিতভাবে মনে করা হয় হিন্দু সম্প্রদায়ের বিভিন্ন দেব-দেবীর উৎসব যেমন দোলযাত্রা, শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমীতে কৃষ্ণযাত্রা, জগন্নাথ দেবের জন্য রথযাত্রা ইত্যাদি অনুষ্ঠানে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গা গান-বাজনার মিছিল নিয়ে যওয়া শুরু করার পরই ধারণা করা হয়েছে। বিভিন্ন উৎসবে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় গান-বাজনা করতে করতে যাওয়া এ ‘যাওয়া’ কথাটা থেকেই ‘যাত্রা’ কথাটির উৎপত্তি বলে বেশিরভাগ গবেষক ধারণা করে থাকেন।
বিভিন্ন কারণে যাত্রার ভগ্নদর্শা হলেও মূলত অতি মুনাফালোভী মালিকদের খপ্পরে পড়ে গত তিন দশকে মুমূর্ষু হয়ে পড়েছে এ শিল্প। দুই দশক আগেও সারা দেশে তিন শতাধিক যাত্রাদল ছিল। কমতে কমতে এখন সর্বোচ্চ টিকে আছে মাত্রা ৩০টি। সরকার যাত্রাশিল্পের জন্য নীতিমালা ও নিবন্ধনের ব্যবস্থা করার কারণে এ শিল্পের মরণদশা কাটবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। একসময় পরিচ্ছন্ন পাত্রা থাকলেও পরবতীতে ক্ষমতাসীন লোকের দৌরাত্ম্যে সংকটে পড়ে যাত্রপালা।
বর্তমানে সারা দেশে অঘোষিতভাবে বন্ধ রয়েছে যাত্রাপালার অনুমোদন। ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের অনুরোধে ডিসি এবং এসপিরা অনুমোদন দিলেও যাত্রা-পুতুল নাচের নামে অশ্লীল-নোংরা নৃত্য, জুয়া-হাউজির আসর বসানোর কারণে স্থানীয় জনগণের চাপের মুখে তা আবার বন্ধ করে দেয়া হয়।
এ প্রসঙ্গে চিত্রনায়িকা ও যাত্রাশিল্পী অরুণা বিশ্বাস ভোরের আকাশকে বলেন, বর্তমানে যাত্রাশিল্প সংকটে পড়েছে। আগের মতো আর যাত্রাপালা হয় না। যতটুকু হয়, তা শুধু অশ্লীল নাচগানে ভরপুর। যখন থেকে যাত্রা ‘প্রিন্সেস’ যুক্ত হয়েছে মূলত তখনই এ শিল্প শেষ হয়ে গেছে। ওঠে গেছে মূলধারার যাত্রা। কাজ না থাকায় এ শিল্পের অনেকেই পেশা বদল করেছেন। অনেকে খুব কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবার দৃষ্টি পড়লে হয়তো এ শিল্পটা টিকে থাকবে। আমরাও চাই এ শির টিকে থাকুক। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, যাত্রাশিল্পের অবক্ষয় এবং বিলুপ্তির পথে ধাবিত হওয়ার মূল কারণ অসাধু যাত্রাপালা ব্যবসায়ীদের ‘প্রিন্সেস’ আমদানি আর জুয়া-হাউজি চালু।
তারা বলেন, এ শব্দগুলো আগে যাত্রা দলে ছিল না। ১৯৭৮-৭৯ সালের পর এ অশ্লীলতার সূচনা হয়েছিল মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের হাত ধরে। তাদের কাছেই চিরায়ত যাত্রাপালার মৃত্যু ঘটে। যাত্রাপালার সোনালি সময় ছিল ৬০ থেকে ৮০ দশক পর্যন্ত। ৯০ দশকেও ছিল এ শিল্পের কদর। ১৯৮৭-৮৮ যাত্রাদলের সংখ্যা বেড়ে তিন শতাধিক হয়। শিল্পকলা একাডেমিতে ১১১টি দল নিবন্ধন করেছে। তবে টিকে আছে ৩০টির মতো। গত বছরও ৫৭টি দল ছিল। প্রতি বছর কমছে। বাংলাদেশে আশ্বিন থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত ৭ মাস যাত্রার ভরা মৌসুম। যাত্রার মৌসুম শুরু হয় দুর্গাপূজায় আর শেষ পহেলা বৈশাখে।
এখন টিকে আছে এমন নামকরা যাত্রাদলগুলো হলো নারায়ণগঞ্জের ভোলানাথ যাত্রা সম্প্রদায়, কোহিনূর অপেরা, গাজীপুরের দিশারী অপেরা, যশোরের আনন্দ অপেরা, চ্যালেঞ্জার অপেরা, অগ্রগামী নাট্য সংস্থা, মাগুরার চৈতালী অপেরা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস যাত্রা ইউনিট, খুলনার স্বদেশ অপেরা, রাজমহল অপেরা, বাগেরহাটের সুন্দরবন অপেরা, লক্ষীপুরের কেয়া যাত্রা ইউনিট, রঙমহল অপেরা দেশ অপেরা, নাটোরের পদ্মযাত্রা ইউনিট ইত্যাদি।
এদিকে উল্লেখযোগ্য যাত্রাপালার মধ্যে রয়েছে কমলা রানীর বনবাস, মালকা বানু, রূপবান-রহিম বাদশাহ, সয়ফুল মুলুক বদিউজ্জামাল, গুনাইবিবি, দুর্গামণি, কাজল রেখা, মলুয়া, ভেলুয়া সুন্দরী, সোনাভান, বীরাঙ্গনা সখিনা, গাজী কালু চম্পাবতী, বনবিবি ইত্যাদি। জনপ্রিয়তা পায় মাইকেল মধুসূদন, দেবদাস, সোজন বাদিয়ার ঘাট, রক্তাক্ত বাংলা, স্বাধীন বাংলা, বিজয় এনেছি, মা মাটি মানুষ, সোনার বাংলা, লালন ফকির, ঈশা খাঁ, রক্তাত্ত প্রান্তর, একযে ছিলেন মহারানী, দাতা হাতেম তাই, এই দেশ এই মাটি ইত্যাদি পালা।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য