যেসব তারকা আত্মগোপনে

ইমরুল শাহেদ
যেসব তারকা আত্মগোপনে

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মুখে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর তার সমর্থক গ্ল্যামার জগতের ১৫৭ জন শিল্পী-তারকা আত্মগোপনে চলে গেছেন। তাদের একটি অংশ চলে গেছেন বিদেশে। যাদের বিদেশে গিয়ে অবস্থানের সামর্থ্য নেই; তারা দেশেই আছেন। এসব শিল্পী-তারকার ভয় - তারা মামলা-মোকদ্দমা ছাড়াও জনরোষের মুখে পড়তে পারেন।

ছাত্র-জনতা আন্দোলনবিরোধী যেসব শিল্পী-তারকা দেশে অবস্থান করছেন তাদের প্রতি রয়েছে নির্মাতাদের ‘অনীহা’। নির্মাতাদেরকে আউটডোর লোকেশনেও কাজ করতে হয়। সেখানে গিয়ে গুটি কয়েক পারফর্মারের জন্য গোটা ইউনিট হামলার মুখে পড়তে পারেন - এমন বিবেচনা থেকেও নির্মাতারা এসব শিল্পীদের এড়িয়ে চলছেন। তবে বেকায়দায় পড়েছেন ধারাবাহিক নাটক নির্মাতারা। তাদের অনেকেই জুলাইয়ের আগে শুরু করা ধারাবাহিক নাটকগুলো শেষ করতে পারছেন না। নাট্যনির্মাতা ফরিদুল হাসান বলেন, ‘আমার একটি চলমান ধারাবাহিকের কাজ স্থগিত করতে হয়েছে।’ এভাবেই স্বৈরাচারের দোসর শিল্পী-তারকারা কর্মহীন হয়ে পড়েছেন।

গত জুলাই মাসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিরুদ্ধে লড়াই চালানোর লক্ষ্যে তৎকালীন তথ্যপ্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত এবং সংসদ সদস্য ফেরদৌসের নেতৃত্বে ‘আলো আসবেই নামে একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খোলা হয়; যাতে আওয়ামীপন্থি শিল্পী ও কিছু সাংবাদিক যুক্ত ছিলেন।

এই গ্রুপে সোহানা সাবা, জ্যোতিকা জ্যোতি, অরুণা বিশ্বাস, ফেরদৌস ছাড়াও ছিলেন রিয়াজ আহমেদ, সুবর্ণা মুস্তাফা, আজিজুল হাকিম, স্বাগতা, বদরুল আনাম সৌদ, শমী কায়সার, তানভীন সুইটি, আশনা হাবীব ভাবনা, শামীমা তুষ্টি, জামশেদ শামীম, ঊর্মিলা শ্রাবন্তী কর, সাজু খাদেম, হৃদি হক, ফজলুর রহমান বাবু, দীপান্বিতা মার্টিন, সাইমন সাদিক, জায়েদ খান, লিয়াকত আলী লাকী, নূনা আফরোজ, রোকেয়া প্রাচী, রওনক হাসান, আহসানুল হক মিনুসহ অনেকে।

৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান। এরপর সব এমপি-মন্ত্রী ও দলীয় নেতাকর্মীও আড়ালে চলে যান। গা ঢাকা দেন সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব ব্যক্তি। এদের মধ্যে রয়েছেন শোজিব অঙ্গনের উল্লিখিত তারকারাও।

এখনো খোঁজ মেলেনি জনপ্রিয় তারকা ও সাবেক সংসদ সদস্য ফেরদৌসের। তিনি ভারতে পালিয়ে গেছেন গুজব রয়েছে। কিন্তু তার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তিনি দেশেই আত্মগোপনে আছেন। তিনি সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের হয়ে নির্বাচন করে ঢাকা-১০ আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।

শেখ সেলিমের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার অভিযোগে আলোচনায় উঠে এসেছেন অভিনেত্রী নিপুণ। তিনি রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায়। সরকার পতনের পর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না আরো অনেক তারকা অভিনয়শিল্পীর। এমনকি সামাজিক মাধ্যমেও নেই বেশির ভাগ শিল্পীর কার্যক্রম।

সায়মন সাদিক, জায়েদ খানও দেশ থেকে পলাতক। তারা দুজনই রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে। তবে জায়েদ খানের বিষয়টি ভিন্ন। তিনি সরকার পতনের অনেক আগেই শো করার জন্য কানাডা গিয়েছিলেন। সরকার পতনের পর সেখান থেকে আর ফিরে আসেননি। মনোয়ার হোসেন ডিপজল তিনটি মামলায় অভিযুক্ত হয়ে এখন পলাতক আছেন। নায়িকা শিরিন শিলা ছাত্র-জনতার আন্দোলনের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় থেকে নিন্দিত ও কর্মহীন হয়ে পড়েন। এখন তিনি বিয়ে করে সকলের আড়ালে চলে গেছেন।

রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে হামলার শিকারও হয়েছেন কয়েকজন। কেউ দেশ ছেড়ে পলায়ন করছেন, কেউ বা কাজ না পাওয়াসহ নানাবিধ সংকটে পড়েছেন। আওয়ামী সরকারের সুবিধা ভোগী অভিনেত্রী আন্দোলনে বিরোধিতা করে অরুণা বিশ্বাস কানাডা চলে গেছেন। গেল জুলাইয়ে ছাত্র আন্দোলন দমাতে ছাত্রদের ওপর গরম পানি ঢালার পরামর্শ দেন অভিনেত্রী অরুণা বিশ্বাস।

অভিনেত্রী জ্যোতিকাকা জ্যোতি শিল্পকলা একাডেমিতে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছিলেন। একটি ছবি নির্মাণের জন্য অনুদানও পেয়েছিলেন। ৫ আগস্ট পট পরিবর্তনের পর তিনি শিল্পকলায় অফিস করতে এসে সহকর্মীসহ আরো কিছু লোকের হাতে লাঞ্ছিত হয়ে কর্মস্থল ত্যাগ করেন। এখন তিনি কর্মহীন উত্তরার একটি বাড়িতে আছেন এবং জীবিকা নির্বাহের জন্য মিউজিক ভিডিওতে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে একজন নির্মাতা জানিয়েছেন।

২০১৮ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত মহিলা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিকবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন অভিনেত্রী রোকেয়া প্রাচী। সরকারের সব কার্যক্রমে ছিলেন তিনি। তিনিও একাধিক মামলায় অভিযুক্ত হয়েছেন।

আওয়ামী লীগের সর্বশেষ করা নির্বাচনে নৌকার হয়ে একই আসন থেকে মনোয়ন ফরম কিনেছিলেন শমী কায়সার এবং রোকেয়া প্রাচী। দুইজনই আশাহত হয়েছেন। ১৫ আগস্ট ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে অবস্থান কর্মসূচি করে হামলার শিকার হন রোকেয়া প্রাচী। শমী কায়সার গ্রেপ্তারের পর জামিন নিয়ে এখন নীরব আছেন এবং অবস্থান করছেন নিজের বাসভবনেই। তাকে ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের সংগঠন ই-ক্যাবের সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করতে হয়েছে।

সরকার পতনের পর অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফার বাড়িতেও হামলা চালিয়েছে বেশ কয়েকজন। খবরটি নিশ্চিত অভিনেতা সাজু খাদেম ও অভিনেত্রী বিজরী বরকতুলস্নাহ হামলার পরপর জানান, বাড়িতে হামলা হলেও নিরাপদে আছেন সুবর্ণা মুস্তাফা। ২০১৯-২০২৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের হয়ে সংরক্ষিত মহিলা আসন-৪-এর প্রতিনিধিত্বকারী জাতীয় সংসদ সদস্য ছিলেন সুবর্ণা মুস্তাফা।

এ ছাড়া পাঁচবারের এমপি আসাদুজ্জামান নূর গ্রেপ্তার হয়ে বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। সাবেক নারী সংরক্ষিত আসনের এমপি এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী তারানা হালিমের কোনো খোঁজ নেই কোথায় আছেন তারা। সোহানা সাবা পলাতক হলেও সম্প্রতি তাকে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতির (বাচসাস) বনভোজনে দেখা গেছে।

ফেরদৌসের মতো আত্মগোপনে আছেন চিত্রনায়ক রিয়াজও। রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার খবর না মিললেও আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সামনের সারিতেই দেখা যেত এই অভিনেতাকে। তিনি চাকরি করতেন চ্যানেল আইয়ের ওটিটি প্ল্যাটফর্ম আই-সেন্টারে। চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহিও রয়েছেন আত্মগোপনে। তিনি একাধিকবার এমপি হওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন। এখন তার হাতে কোনো ছবি নেই। মৌসুমী আগেই চলে গেছেন যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে মেয়ের সঙ্গে থাকেন। হাসিনাপন্থি অপু বিশ্বাস দেশেই আছেন। তার হাতে কোনো ছবি নেই। তিনি ভিন্ন পন্থায় জীবিকা নির্বাহের চেষ্টা করছেন।

একই অবস্থা আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য ও সঙ্গীতশিল্পী মমতাজের। তারও কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। ২০০৮ সালে সংরক্ষিত মহিলা আসনে এবং ২০১৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। এখন তিনি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে কোথায় আছেন হদিশ পাওয়া যাচ্ছে না।

রাজনীতির সঙ্গে কোনো সম্পৃক্ততা না থাকলেও আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থীদের সমর্থনে কথা না বলায় রোষানলে পড়েছেন অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী। মায়ের অসুস্থতার কারণে ফেসবুকে সক্রিয় ছিলেন না জানানোর পরও অভিনেতার দিকে ধেয়ে আসে নেতিবাচক মন্তব্য। যদিও তিনি প্রথমে আন্দোলনে ছয় ছাত্রের হত্যার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। তবে শেখ হাসিনার পতনের পর চঞ্চলের প্রতিও ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে অসংখ্য অনুরাগীকে। জানা গেছে, তিনি বর্তমানে অবস্থান করছেন যুক্তরাষ্ট্রে।

 

ভোরের আকাশ/রন

মন্তব্য