অব্যাহত রোগী বৃদ্ধি

কোভিড হাসপাতালে শয্যাসংকটের শঙ্কা

নিখিল মানখিন ও আরিফ সাওন
কোভিড হাসপাতালে শয্যাসংকটের শঙ্কা
সারাদেশের মোট করোনা শয্যার ৩৩ শতাংশ ইতোমধ্যে রোগীতে ভরে গেছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।

বর্তমান নতুন করোনা শনাক্তের হার বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে আগামী এক মাসের মধ্যে হাসপাতালগুলো করোনা শয্যাসংকটে পড়বে বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

সারাদেশের মোট করোনা শয্যার ৩৩ শতাংশ ইতোমধ্যে রোগীতে ভরে গেছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার প্রথম ও দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় সফলতা দেখিয়েছে বাংলাদেশ। প্রস্তুতিও খারাপ না। তবে দৈনিক করোনা শনাক্তের হার ৩০ ছাড়িয়ে গেলে এবং তা কয়েক সপ্তাহ ঊর্ধ্বমুখী থাকলে করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলো রোগী সামাল দিতে পারবে না।

দৈনিক নতুন রোগীর সংখ্যার বিপরীতে দৈনিক সুস্থ হওয়ার হার মাত্র ৫ থেকে ৬ শতাংশ। এতে হাসপাতালে রোগীর চাপ শিগগিরই তীব্রতর হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

গত ১০ জানুয়ারি থেকে ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত দৈনিক পরীক্ষিত নমুনার বিপরীতে নতুন রোগী শনাক্তের হার এক দিনের ব্যবধানে ১ থেকে ২ শতাংশ করে বৃদ্ধি পেয়েছে।

নতুন রোগী আক্রান্তের এই একটানা ঊর্ধমুখীতে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন দেশের করোনা মোকাবিলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল কর্তাব্যক্তি।

রোগী শনাক্তের হার গত ১০ জানুয়ারি ৮.৫৩ শতাংশ, ১২ জানুয়ারি ১১.৬৮ শতাংশ, ১৩ জানুয়ারি ১২ শতাংশ, ১৪ জানুয়ারি ১৪.৬৬ শতাংশ, ১৬ জানুয়ারি ১৭.৮২ শতাংশ, ১৭ জানুয়ারি ২০.৮৮ শতাংশ, ১৮ জানুয়ারি ২৩ শতাংশ, ১৯ জানুয়ারি ২৫.১১ ও ২০ জানুয়ারি ২৬ শতাংশ।

অর্থাৎ দৈনিক নতুন রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধির এই হার আরো ৩০ মাস অব্যাহত থাকলে শনাক্তের হার ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে।

সারাদেশের মোট করোনা শয্যার ৩৩ শতাংশ ইতোমধ্যে রোগীতে ভরে গেছে বলে শুক্রবার জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। এই হিসাবে শনাক্তের হার ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেলে হাসপাতালগুলোতে কোভিড শয্যাসংকট প্রকট হয়ে উঠবে।

শুক্রবার রাজধানীতে করোনাবিষয়ক এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে হাসপাতালগুলোতে করোনা রোগীর সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধিকে ‘ আশঙ্কাজনক’ বলেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।

তিনি বলেন, দেশের করোনা পরিস্থিতির কিছুটা অবনতি ঘটেছে। প্রতিদিন করোনা শনাক্তের হার ১০ রেথকে ২০ শতাংশ বাড়ছে, মৃত্যুও বেড়েছে সহনীয়ভাবে। লোকজন স্বাস্থ্যবিধি মানছে না। স্বাস্থ্যবিধি মানা না হলে করোনার দ্রুত সংক্রমণ ঠেকানো যাবে না।

চলমান অবস্থা অব্যাহত থাকলে হাসপাতালের ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়বে জানিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, কিছুদিন আগেও হাসপাতালের কোভিড সাধারণ শয্যাগুলো খালি ছিল।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচাল (প্রশাসন) ডা. আহমেদুল কবীর জানান, গত ১২ থেকে ১৮ জানুয়ারি এক সপ্তাহে তার আগের সপ্তাহের তুলনায় করোনা রোগী বেড়েছে ২২৮ শতাংশ। আর ৩ থেকে ৯ জানুয়ারি এক সপ্তাহে তার আগের সপ্তাহের তুলনায় করোনা শনাক্তের হার ২৩১ দশমিক ৯ শতাংশ বেড়েছে।

এভাবে ২৭ ডিসেম্বর থেকে ২ জানুয়ারি পর্যন্ত এক সপ্তাহে তার আগের সপ্তাহের তুলনায় নতুন রোগী বেড়েছে ৪৮ শতাংশ। শনাক্তের হার ২৮.৪৯ শতাংশ।

দৈনিক সুস্থতার হার কম, প্রতিদিন বাড়ছে রোগীর চাপ

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, দৈনিক করোনা রোগী শনাক্তের বিপরীতে সুস্থ হওয়ার হার মাত্র ৫ থেকে ৬ শতাংশ।

দৈনিক নতুন রোগী শনাক্ত ও সুস্থ হওয়া রোগীর সংখ্যা ২১ জানুয়ারি যথাক্রমে আক্রান্ত ১১,৪৩৪ জন ও সুস্থ ৭৫২ জন, ২০ জানুয়ারি ১০,৮৮৮টি ও সুস্থ ৫৭৭ জন, ১৮ জানুয়ারি ৮,৪০৭ জন ও ৪৭৫ জন, ১৭ জানুয়ারি ৬,৬৭৬ জন ও ৪২৭ জন, ১৬ জানুয়ারি ৫,২২২ জন ও ২৯৩ জন, ১৫ জানুয়ারি ৩.৪৪৭ জন ও ২৯৪ জন, ১৪ জানুয়ারি ৪,৩৭৮ জন ও ৩৫১ জন এবং ১৩ জানুয়ারি ৩,৩৫৯ জন ও ৩০২ জন।

অর্থাৎ দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা এবং দৈনিক সুস্থ হওয়া রোগীর সংখ্যার পার্থক্য অনেকগুণ বেশি হওয়ায় হাসপাতালে রোগীর চাপ বাড়তে বেশি সময় লাগবে না।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, সারাদেশে আইসিইউ সিট ১২৩৭টি, কোভিড এইচডিইউ শয্যা ৭০৭, সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন ১১৯টি, অক্সিজেন সিলিন্ডার ২৯২০৪টি, হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানলা ২০৩০টি, অক্সিজেন কনসেনট্রেটর ২৩৫৩টি। চিকিৎসাধীন রোগীর সংখ্যা বর্তমান হারে বাড়তে থাকলে এই সীমিত সংখ্যক উপকরণ দিয়ে সামাল দেওয়া সম্ভব হবে না।

দেশের মোট কোভিড সাধারণ শয্যা ও খালি শয্যার সংখ্যা গত ২১ জানুয়ারি যথাক্রমে ১৩,৫১৬টি ও খালি ১১,৫৮১টি, ২০ জানুয়ারি ১৩,৪৯৮টি ও ১১,৬৪১টি, ১৯ জানুয়ারি ১৩, ৪২৬টি ও ১১,৭৭৫টি, ১৮ জানুয়ারি ১৩,৪৬৬টি ও ১১,৯২০টি, ১৭ জানুয়ারি ১৩,৪৩৭টি ও ১২,১৬৫টি, ১৬ জানুয়ারি ১৩,৪৩৭টি ও ১২,১৬৫টি, ১৫ জানুয়ারি ১৩,৪৩৭টি ও ১২,২৪০টি, ১৪ জানুয়ারি ১৩,৪২৬টি ও ১২,৩৬৭টি, ১৩ জানুয়ারি ১৩,৪৬০টি ও ১২,৩৭৩টি, ১২ জানুয়ারি ১৩,৪২৬টি ও ১২,৪১৯টি এবং ১১ জানুয়ারি মোট কোভিড সাধারণ শয্যার সংখ্যা ১৩,৪২৬টি ও খালি শয্যার সংখ্যা ১২৫০৬টি।

অধিদপ্তর আরো জানায়, দৈনিক মোট কোভিড শয্যার সংখ্যা ও হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগীর সংখ্যা ২০ জানুয়ারি ১৩,৪৯৮টি ও ১৮৫৭ জন, ১৯ জানুয়ারি ১৩,৪২৬টি ও ১৬৫১ জন, ১৮ জানুয়ারি যথাক্রমে ১৩,৪৬৬টি ও ১৫৪৬ জন, যা শয্যার বিপরীতে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীর হার ১১.৪৮ শতাংশ, ১৭ জানুয়ারি ১৩,৪৩৭টি ও ১২৭২ জন, ১৬ জানুয়ারি ১৩,৪৩৭টি ও ১২৭২ জন, ১৫ জানুয়ারি ১৩,৪৩৭টি ও ১১৯৭ জন, ১৪ জানুয়ারি ১৩,৪২৬টি ও ১০৫৯ জন, ১৩ জানুয়ারি ১৩,৪৬০টি ও ১০৮৭ জন, ১২ জানুয়ারি ১৩,৪২৬টি ও ১০০৭ জন এবং ১১ জানুয়ারি ১৩,৪২৬টি ও ৯২০ জন।

এভাবে কোভিড শয্যার বিপরীতে চিকিৎসাধীন রোগীর হার ছিল যথাক্রমে ১৭ জানুয়ারি ৯.৪৬ শতাংশ, ১৬ জানুয়ারি ৯.৪৬ শতাংশ, ১৫ জানুয়ারি ৮.৯০ শতাংশ, ১৪ জানুয়ারি ৭.৮৮ শতাংশ, ১৩ জানুয়ারি ৮ শতাংশ, ১২ জানুয়ারি ৭.৫০ শতাংশ ও ১১ জানুয়ারি ৬.৫০ শতাংশ।

স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ ভোরের আকাশকে বলেন, সম্মিলিতভাবে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের লাগাম টেনে ধরতে হবে। করোনার প্রথম ও দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় সফলতা দেখিয়েছে বাংলাদেশ। প্রস্তুতিও খারাপ না। তবে দৈনিক করোনা শনাক্তের হার ৩০ ছাড়িয়ে গেলে এবং তা কয়েক সপ্তাহ ঊর্ধ্বমুখী থাকলে করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলো রোগী সামাল দিতে পারবে না।

করোনার দ্রুত সংক্রমণ প্রতিরোধে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে বলে জানান ডা. এম এ আজিজ।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুস্তাক হোসেন ভোরের আকাশকে বলেন, সাধারণ মানুষ সরকারি বিধিনিষেধসমূহ মানছে না। প্রতিদিন নতুন করোনা রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এমন অবস্থা আরো কয়েক সপ্তাহ অব্যাহত থাকলে নিঃসন্দেহে হাসপাতালগুলোর ওপর চাপ বাড়বে।

মন্তব্য