-->
শিরোনাম

ল্যাবরেটরি বাড়লেও নমুনার সংখ্যা আগের মতো

দুই কারণে পরীক্ষায় অনীহা

নিখিল মানখিন ও আরিফ সাওন
ল্যাবরেটরি বাড়লেও নমুনার সংখ্যা আগের মতো
করোনাভাইরাস শনাক্তের জন্য নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে। ফাইল ছবি

ল্যাবরেটরির সংখ্যা বৃদ্ধির তুলনায় দৈনিক করোনা পরীক্ষিত নমুনার সংখ্যা  বাড়ছে না। পরীক্ষা হার বাড়াতে বিনামূল্যে করোনার পরীক্ষা করানো এবং দৈনিক অন্তত এক লাখ করে নমুনা পরীক্ষার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলছেন, প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্তের পর গত পৌনে দুই বছরে দেশে করোনার পরীক্ষার জন্য ল্যাবরেটরির সংখ্যা বেড়ে একটি থেকে হয়েছে ৮৫৭টি। ৫০টি ল্যাবরেটরি থাকার সময় দৈনিক পরীক্ষিত নমুনার সংখ্যা ১৩ থেকে ১৮ হাজারের মধ্যে ওঠানামা করেছিল।

বর্তমানে ল্যাব সংখ্যা ৮৫৭টি হলেও পরীক্ষিত নমুনার সংখ্যা প্রায় একই অবস্থানে রয়ে গেছে। দেশের করোনা পরিস্থিতির সার্বিক চিত্র জানতে এবং প্রয়োজনীয় করোনা প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে দৈনিক পরীক্ষিত নমুনার সংখ্যা বাড়াতেই হবে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের করোনা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। করোনা প্রবেশের গত পৌনে দুই বছরেও দেশের করোনা পরিস্থিতির সার্বিক চিত্র জানা হয়ে উঠেনি।

বিপুল জনসংখ্যার বিপরীতে করোনা সীমিত নমুনা সংখ্যা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলে আসছে। এমন সুযোগে দেশে বিরাজ করছে করোনাময় স্বাভাবিক অবস্থা। করোনা ভাইরাস থেকেও যেন নেই। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বালাই নেই।

অনেক আগেই করোনা টেস্ট করানোর আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে দেশের মানুষ। উপসর্গহীন করোনা রোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞগণ। এমন পরিস্থিতিতে পরীক্ষিত নমুনার সংখ্যা বাড়ানোর বিকল্প নেই বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিশ্বের অনেক দেশে করোনা পরিস্থিতির উন্নতি ও অবনতির ঘটনা ঘটেছে বহুবার। ঝুঁকিমুক্ত ভেবে স্বাস্থ্যবিধিহীন স্বাভাবিক চলাফেরা করতে গিয়ে বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে পড়েছে অনেক দেশ।

২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহানে প্রথম করোনার সংক্রমণ দেখা দেয়। কয়েক মাসের মধ্যে এ ভাইরাস বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। আর ২০২০ সালের ৮ মার্চে বাংলাদেশে প্রথম তিন জনের শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে বলে জানায় স্বাস্থ্য অধিদফতর। তার ঠিক ১০ দিন পর প্রথম রোগীর মৃত্যুর কথা জানানো হয়।

এরপর থেকে সংক্রমণের হার ঊর্ধ্বমুখী-নিম্নমুখী হলেও ধারণা করা হচ্ছিল ২০২০ সালের শেষের দিকে শীত পড়লে করোনার প্রকোপ বাড়বে। কিন্তু ধারণা ভুল প্রমাণ করে উল্টো দেশে করোনার সংক্রমণ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।

২০২১ সালের মার্চের শেষ দিক পর্যন্ত এই ধারা নিম্নমুখীই ছিল। কিন্তু করোনার চরিত্রটা বদলাতে থাকে মে মাসের দিকে, যা টানা কয়েক মাস দেশে তাণ্ডব চালিয়েছে। কয়েক মাস স্বস্তিদায়ক অবস্থার পর গত বছরের ডিসেম্বরের শেষ দিক থেকে বাড়তে শুরু করে করোনা রোগী, শনাক্তের হার ও মৃতের সংখ্যা, যা অব্যাহত রয়েছে।

দেশে করোনাভাইরাস পরীক্ষা করোনার জন্য তিনটি পরীক্ষা পদ্ধতি চালু রয়েছে। সেগুলো হলো আরটি-পিসিআর, জিন এক্সপার্ট ও র‌্যাপিড অ্যান্টিজেন। বর্তমানে রয়েছে ৫৬টি আরটি-পিসিআর, ৫৪টি জিন এক্সপার্ট ও ৫৪৫টি র‌্যাপিড অ্যান্টিজেন পরীক্ষাগার। সর্বমোট চলমান পরীক্ষাগারের সংখ্যা ৮৫৭টি। এর মধ্যে বেসরকারি পরীক্ষাগারের সংখ্যা ১০১টি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, ২০২১ সালের পহেলা জুনে দেশে পরীক্ষিত নমুনা সংখ্যা ৩২,০৫৫টি, শনাক্তকৃত রোগী ৮,৩০১ জন ও শনাক্তের হার ২৫.৯০ শতাংশ। ল্যাবরেটরীর সংখ্যা আরটি-পিসিআর ৫৩টি, জিন এক্সপার্ট ৪৪টি ও র‌্যাপিড অ্যান্টিজেন ৩৯১টি।

গত ৩১ জুলাই দেশে পরীক্ষিত নমুনা সংখ্যা ৩০,৯৮০, শনাক্তকৃত রোগী ৯,৩৬৯ জন ও শনাক্তের হার ৩০.২৪ শতাংশ। ল্যাবরেটরীর সংখ্যা আরটি-পিসিআর ৫৪টি, জিন এক্সপার্ট ৫০টি ও র‌্যাপিড এ্যান্টিজেন ৪৬৪ টি।

পহেলা আগস্টে পরীক্ষিত নমুনা সংখ্যা ৪৯,৫৩১, শনাক্তকৃত রোগী ১৪,৬৪৪ জন ও শনাক্তের হার ২৯.৯৭ শতাংশ। ল্যাবরেটরির সংখ্যা আরটি-পিসিআর ৫৪টি, জিন এক্সপার্ট ৫০টি ও র‌্যাপিড অ্যান্টিজেন ৪৮১টি। 

এভাবে ৩১ আগস্টে পরীক্ষিত নমুনা সংখ্যা ২৮,০৯৭টি, শনাক্তকৃত রোগী ৩,৩৫৭ জন ও শনাক্তের হার ১১.৯৫ শতাংশ। আরটি-পিসিআর ৫৫, জিন এক্সপার্ট ৫১ ও র‌্যাপিড অ্যান্টিজেন ৫৪৫টি। 

পহেলা সেপ্টেম্বর পরীক্ষিত নমুনা সংখ্যা ৩০,২৯৪টি, শনাক্তকৃত রোগী ৩,০৬২ জন ও শনাক্তের হার ১০.১১ শতাংশ। ল্যাবরেটরির সংখ্যা আরটি-পিসিআর ৫৬টি, জিন এক্সপার্ট ৫১টি ও র‌্যাপিড অ্যান্টিজেন ৫৪৫টি।

৩০ সেপ্টেম্বর পরীক্ষিত নমুনা সংখ্যা ২৬,৫৬৯টি, শনাক্তকৃত রোগী ৮৬০ জন ও শনাক্তের হার ৩.২৪ শতাংশ। আর আরটি-পিসিআর ৫৬টি,  জিন এক্সপার্ট ৫৩টি ও র‌্যাপিড অ্যান্টিজেন ৫৪৫টি।

পহেলা অক্টোবর  পরীক্ষিত নমুনা সংখ্যা ২৪,৫৭০টি, শনাক্তকৃত রোগী ৮৪৭ জন ও শনাক্তের হার ৩.৪৩ শতাংশ। ল্যাবরেটরীর সংখ্যা আারটি-পিসিআর ৫৬টি,  জিন এক্সপার্ট ৫৩টি ও র‌্যাপিড অ্যান্টিজেন ৫৪৫টি।

এভাবে ৩১ অক্টোবর পরীক্ষিত নমুনা সংখ্যা ১৭,২২৬টি, শনাক্তকৃত রোগী ২১১ জন ও শনাক্তের হার ১.২২ শতাংশ। ল্যাবরেটরীর সংখ্যা আরটি-পিসিআর ৫৬টি, জিন এক্সপার্ট ৫৪টি ও র‌্যাপিড অ্যান্টিজেন ৫৪৫ টি। 

পহেলা নভেম্বর পরীক্ষিত নমুনা সংখ্যা ১৯,৭৩৪টি, শনাক্তকৃত রোগী ২১৪ জন ও শনাক্তের হার ১.০২ শতাংশ। আর ল্যাবরেটরীর সংখ্যা আরটি-পিসিআর ৫৬টি,  জিন এক্সপার্ট ৫৪টি ও র‌্যাপিড অ্যান্টিজেন ৫৪৫টি।

এভাবে ৩০ নভেম্বর পরীক্ষিত নমুনা সংখ্যা ১৯, ৮০২টি, শনাক্তকৃত রোগী ২৭৩ জন ও শনাক্তের হার ১.৩৮ শতাংশ। ল্যাবরেটরীর সংখ্যা আরটি-পিসিআর ৫৬টি,  জিন এক্সপার্ট ৫৪টি ও র‌্যাপিড অ্যান্টিজেন ৫৪৫টি।

পহেলা ডিসেম্বর পরীক্ষিত নমুনা সংখ্যা ১৮,৮৫১টি, শনাক্তকৃত রোগী ২৮২ জন ও শনাক্তের হার ১.৫০ শতাংশ। ল্যাবরেটরীর সংখ্যা ৮৪৮টি। এভাবে ৩১ ডিসেম্বর পরীক্ষিত নমুনা সংখ্যা ১৮,৬৭৩টি, শনাক্তকৃত রোগী ৫১২ জন ও শনাক্তের হার ২.৭৪ শতাংশ। ল্যাবরেটরীর সংখ্যা ৮৫২টি।

২০২০ সালের পরীক্ষিত নমুনা, শনাক্তকৃত রোগী ও শনাক্তের চিত্র

২০২০ সালের ১৬ এপ্রিল পরীক্ষিত নমুনা সংখ্যা ২০১৯টি, শনাক্তকৃত রোগী ৩৪১ জন এবং ল্যাবরেটরির সংখ্যা ছিল ১৭টি। ৩০ এপ্রিল পরীক্ষিত নমুনা সংখ্যা ৪৯৫০টি, শনাক্তকৃত রোগী ৫৬৪ জন এবং ল্যাবরেটরি ছিল ২৮টি।

১৫ মে পরীক্ষিত নমুনা সংখ্যা ৮৫৮২টি, শনাক্তকৃত রোগী ১২০২ জন এবং ল্যাবরেটরীর সংখ্যা ছিল ৪১টি। ১৫ জুন পরীক্ষিত নমুনা সংখ্যা ১৫,০৩৮টি, শনাক্তকৃত রোগী ৩০৯৯ জন এবং ল্যাবরেটরির সংখ্যা ছিল ৬০টি। 

২০২০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পরীক্ষিত নমুনা সংখ্যা ১৩,৪০৪টি, শনাক্তকৃত রোগী ১৪৩৬ জন ও শনাক্তের হার ১০.৭১ শতাংশ। ল্যাবরেটরীর সংখ্যা ছিল ১০৮টি।

২ অক্টোবরে পরীক্ষিত নমুনা সংখ্যা ১১,১৭৬টি, শনাক্তকৃত রোগী ১৩৯৬ জন ও শনাক্তের হার ১২.৪৯ শতাংশ। ল্যাবরেটরির সংখ্যা ছিল ১০৯টি। ৩০ অক্টোবর পরীক্ষিত নমুনা সংখ্যা ১৪,১৪১টি, শনাক্তকৃত রোগী ১৬০৪ জন ও শনাক্তের হার ১১.৩৪ শতাংশ। ল্যাবরেটরীর সংখ্যা ছিল ১১৪টি।

২০২০ সালের ২ ডিসেম্বর পরীক্ষিত নমুনা সংখ্যা ১৫,৯৭২টি, শনাক্তকৃত রোগী ২১৯৮ জন ও শনাক্তের হার ১৩.৭৬ শতাংশ। ল্যাবরেটরির সংখ্যা ছিল ১১৮টি।

আর ৩১ ডিসেম্বর পরীক্ষিত নমুনা সংখ্যা ১৩,২৫৪টি, শনাক্তকৃত রোগী ১০১৪ জন ও শনাক্তের হার ৭.৬৫ শতাংশ। ল্যাবরেটরীর সংখ্যা আরটি পিসি আর ৫১টি, জিন এক্সপার্ট ২৪টি ও র‌্যাপিড অ্যান্টিজেন ৪০টি।  

আইইডিসিআরের উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, উপজেলায় পর্যায়ে এখন স্যাম্পল কালেকশনের ব্যবস্থা আছে। পরীক্ষার হার বাড়ানো পদ্ধতি হচ্ছে- এরকম বিশ্বমারী পরিস্থিতিতে পরীক্ষা ফ্রি করে দিতে হয়। মানুষকে এটাও দেখানো যে- সে যদি পরীক্ষা করে এবং শনাক্ত হয় তাহলে তার খোঁজ খবর নেওয়া হবে। সহায়তা দেওয়া হবে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘শুরু থেকে আমাদের প্রবণতা ছিল টেস্ট কম করা। আমরা মাত্র দুই হাজার কিট হাতে নিয়ে বলেছি আমাদের পূর্ণ প্রস্তুতি আছে। শুরু থেকেই পরীক্ষা করতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার ব্যাপারে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

‘এমন কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যাতে মানুষ টেস্টে উদ্বুদ্ধ হয়। টেস্টে উদ্বুদ্ধ করার জন্য প্রচারাভিযান চালানো। স্যাম্পল কলেকশন সেন্টার সহজপ্রাপ্য করা, যাতে মানুষ সহজে গিয়ে নমুনা দিয়ে আসতে পারে।’

বিনামূল্যে পরীক্ষা এবং নমুনার সংখ্যা বাড়ানোর বিষয়ে কোনো পরিকল্পনা আছে কিনা জানার চেষ্টা করেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলমের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

মন্তব্য

Beta version