শীতজনিত রোগগুলোর দায়ভার পড়ছে করোনার ওপর। উপসর্গে মিল থাকায় পরীক্ষা করানোর আগ পর্যন্ত বিড়ম্বনায় পড়ছেন করোনা ও শীতজনিত রোগে আক্রান্তরা।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শীতজনিত রোগ ও করোনা- উভয় রোগের উপসর্গগুলোর মধ্যে সর্দি-কাশি, জ্বর ও শ্বাসকষ্ট রয়েছে। দেশে চলছে শীতজনিত রোগের মৌসুম। দেশের করোনা পরিস্থিতিরও প্রতিদিন অবনতি ঘটছে।
দেশে করোনা প্রবেশ করার আগে প্রতি বছর শীতজনিত রোগগুলোর নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশ করত স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। করোনা প্রবেশ করার পর থেকে প্রতিবেদনটি বন্ধ রয়েছে। সর্বশেষ ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে শীতজনিত বিভিন্ন রোগে প্রায় ৪ লাখ আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
চার দিন সর্দি-কাশি ও জ্বরে ভোগার পর গত ১৫ জানুয়ারি ময়মনসিংহের ধোবাউড়া থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে করোনা টেস্ট করানোর জন্য নমুনা জমা দেন মো. মিজান। পরীক্ষার রিপোর্টে আসে করোনা নেগেটিভ।
তিনি ভোরের আকাশকে বলেন, ‘সর্দি-কাশি ও জ্বরে কাহিল হয়ে গিয়েছিলাম। পাড়া-প্রতিবেশীর ঠেলাঠেলিতে পরীক্ষা করাতে বাধ্য হই। আমি নিজেও ধরে নিয়েছিলাম, আমার করোনা পজিটিভ আসবে। কিন্তু হাতে পেলাম করোনা নেগেটিভ রিপোর্ট। পরে ডাক্তার দেখিয়ে সর্দি জ্বরের চিকিৎসা নিলাম।’
মগবাজার মোড়ের কাছে ওয়াকফ ভবনের সামনে ভাসমান চা দোকান চালায় শফিকুল ইসলাম। সর্দি-জ্বরের পাশাপাশি গলায় ব্যথা ছিল তার। মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে তিনি করোনা টেস্ট করান।
তিনি ভোরের আকাশকে বলেন, ‘চা দোকান চালালে সবসময় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তবে ঘন ঘন হাত ধোয়া হয়। জ্বরের কারণে দুদিন দোকান বন্ধ রেখেছি। গলাব্যথা থাকায় করোনা টেস্ট করাতে গিয়েছি।’
রিপোর্টে করোনা নেগেটিভ এসেছে বলে জানান শফিকুল ইসলাম।
অন্যদিকে সর্দি-কাশি ও জ্বরের উপসর্গ নিয়ে টেস্ট করাতে গিয়ে করোনা পজিটিভ হয়েছেন অনেকে। বড় মগবাজার বাটারগলিতে পরিবার নিয়ে থাকেন মো. বেলাল হোসেন। তিনি একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে কর্মরত। সর্দি-কাশি ও জ্বর এমনিতেই চলে যাবে চিন্তা করে তিনি কয়েকদিন পার করেছেন। অবশেষে পরিবারের লোকজনের পরামর্শে তিনি করোনা টেস্ট করান। করোনা পজিটিভ আসে রিপোর্টে।
বেলাল হোসেন ভোরের আকাশকে বলেন, ‘গত দুই বছরে আমি সর্দি-জ্বরে কয়েকবার আক্রান্ত হয়েছি। কিন্তু করোনা টেস্ট করাইনি। এবারও তাই ভেবেছিলাম।’
পরবর্তীতে পরিবারের আরো দুই সদস্যের করোনা শনাক্ত হয়েছে বলে জানান বেলাল হোসেন।
এভাবে একই উপসর্গ নিয়ে পরীক্ষা করাতে যাওয়া লোকদের কেউ কেউ করোনা রোগী এবং বাকিরা শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটছে। এমনিতেই দেশে করোনা টেস্ট করানোর বিষয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের উদাসীনতা ও অনীহা দেখা দিয়েছে। তার মধ্যে করোনা ও শীতজনিত রোগের উপসর্গের মিল থাকায় করোনা টেস্ট করাতে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে অনেক সময় রোগীর অবস্থার অবনতি হওয়ার ঘটনা ঘটছে।
দেশে করোনা প্রবেশ করার আগে প্রতি বছর শীতজনিত রোগগুলোর নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশ করত স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন্স সেন্টার ও কন্ট্রোলরুম প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে থাকে। সাধারণত প্রতি বছর নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ চলত।
করোনা প্রবেশ করার পর থেকে শীতজনিত রোগের দৈনিক প্রতিবেদনটি বন্ধ রয়েছে। অধিদপ্তরের সর্বশেষ প্রবেদন অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ১ নভেম্বর থেকে ২০২০ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত সারা দেশে শীতজনিত রোগগুলোর মধ্যে ডায়রিয়ায় ১ লাখ ৫৮ হাজার ৪৯৯, শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণে ৬৫ হাজার ২১৬ এবং সর্দি-কাশি ও জ্বরে ১ লাখ ৮৭ হাজার ২৭৪ জন আক্রান্ত হয়। অর্থাৎ ওই মৌসুমে শীতজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ৪ লাখ ছাড়িয়ে যায়।
রোগতত্ত্ব, রোগনির্ণয় ও রোগ গবেষণা কেন্দ্রের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা মুশতাক হোসেনও সাবধানে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন।
তিনি ভোরের আকাশকে বলেন, সর্দি-কাশি ও জ্বর নিয়ে আতঙ্কের কিছুই নেই। চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে কিছু ওষুধপত্র সেবন করলে কয়েকদিনের মধ্যেই সমস্যা কেটে যাবে। তবে করোনা ও কিছুসংখ্যক শীতজনিত রোগের বেশকিছু উপসর্গের মিল রয়েছে। আক্রান্ত রোগীর প্রয়োজনীয় চিকিৎসার বিষয়ে অবহেলা করা যাবে না। দেরি না করে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। দ্রুত করাতে হবে করোনা টেস্ট। সাধারণ সর্দি-কাশি ও জ্বর ভেবে ঘরে বসে থাকা যাবে না।
মুশতাক হোসেন বলেন, শীতজনিত রোগগুলোর দায়ভার বর্তাচ্ছে করোনার ওপর। উপসর্গ মিল থাকায় পরীক্ষা করোনার আগ পর্যন্ত বিড়ম্বনায় পড়ছেন করোনা ও শীতজনিত রোগে আক্রান্তরা। বর্তমানে চলছে শীতজনিত রোগে মৌসুম। দেশের করোনা পরিস্থিতিরও প্রতিদিন অবনতি ঘটছে। তাই এসব বিষয়ে অবহেলা করা যাবে না।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন এবং প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ ভোরের আকাশকে জানান, শীতজনিত সর্দি-কাশি ও জ্বরও ভাইরাসজনিত রোগ। শীতজনিত রোগ নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।
এ সময় শীতজনিত রোগের প্রকোপ থাকবেই। প্রতি বছরই এমনটি হয়ে থাকে। তবে কিছুতেই ঠান্ডা লাগানো যাবে না। সাবধানতা অবলম্বন না করলে সাধারণ ব্যাধিই অনেক সময় স্থায়ী ও জটিল ব্যাধিতে রূপ নিতে পারে। বিশেষ করে হাঁপানি বা শ্বাসকষ্টের প্রকোপ মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যায়।
করোনা ও কিছু শীতজনিত রোগের উপসর্গের মধ্যে মিল রয়েছে জানিয়ে ডা. আব্দুল্লাহ বলেন, করোনার মহামারি চলছে। সর্দি-কাশি ও জ্বর নিয়ে অবহেলা করা ঠিক হবে না। করোনা টেস্ট করিয়ে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ নিতে হবে।
মন্তব্য