-->

সুরক্ষায় দরকার সর্বজনীন স্বাস্থ্যবিমা

স্বাস্থ্যবিমা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে করতে হবে

নিখিল মানখিন ও আরিফ সাওন
সুরক্ষায় দরকার সর্বজনীন স্বাস্থ্যবিমা

সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত সর্বজনীন স্বাস্থ্যবিমা। মোট জনসংখ্যার ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ মানুষকে স্বাস্থ্যবিমার আওতায় আনা না গেলে দেশে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জন করা সম্ভব হবে না।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দেশের ৫৫ শতাংশ মানুষ এখনো মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার ধারণায় ২০৩০ সালের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় সহনীয় পর্যায়ে ও সাধ্যের মধ্যে নিয়ে আসার কথা বলা হয়েছে। অথচ দেশে চিকিৎসা পেতে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয় এর ৬৭ শতাংশই রোগীকে বহন করতে হচ্ছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার (ইউএইচসি) মূল কথা হচ্ছে, সব মানুষ প্রয়োজনের সময় মানসম্পন্ন চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা পাবে। চিকিৎসাসেবা নিতে গিয়ে কেউ দরিদ্র হয়ে পড়বে না। ইউএইচসির উদ্দেশ্য অর্জনে কৌশল হিসেবে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির পাশাপাশি অপচয় ও দুর্নীতি কমাতে হবে, স্বাস্থ্যবিমা মানুষকে সেবা প্রাপ্তির নিশ্চয়তা দেবে।

সম্প্রতি সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জন করতে হলে সবাইকে আন্তরিক হতে হবে। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা স্লোগান হিসেবে শুনতে ভালো। কিন্তু এই জনবহুল দেশে বাস্তবায়ন করা খুব কঠিন। অর্থ ছাড়া মানসম্পন্ন সেবা দেওয়া সম্ভব নয়। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জন করতে হলে স্বাস্থ্য, অর্থ ও জনপ্রাসনসহ আরো বেশকিছু সংখ্যক মন্ত্রণালয়কে একসঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করতে হবে বলে মনে করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।

গতকাল রোববার রাজধানীর একটি হোটেলে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তথ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি হাসানুল হক ইনু, এমপি বলেন, সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবাটা মৌলিক অধিকার হিসেবে সংবিধানে স্বীকৃতি দেওয়া দরকার। সর্বজনীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ৫ থেকে ৭ বছর লাগবে। আগামী বাজেট থেকে যদি আমরা বাড়তি বরাদ্দ শুরু করি, তাহলে ৫ বছরে সর্বজনীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা চালু হয়ে যাবে। এজন্য স্বাস্থ্যবিমার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বলে জানান হাসানুল হক ইনু।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে  জাতীয়ভাবে পরিচালিত শক্তিশালী স্বাস্থ্যবিমা ব্যবস্থা চালু নেই। দাবি আছে বহু বছর ধরে। তবে গত পাঁচ বছর ধরে আলোচনা চললেও কোনো অগ্রগতি নেই। বৈঠক হয়, সিদ্ধান্ত হয়, আবার চাপা পড়ে যায়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থ স্বীকৃত স্বাস্থ্যব্যবস্থার আওতায় নাগরিকেরা আর্থিক অসচ্ছলতা থেকে মুক্ত না হয়েও স্বাস্থ্যসুবিধা পেতে পারেন, সেই স্বাস্থ্যব্যবস্থাকেই বলা হয় সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা। ২০১২ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা বা ইউনিভার্সেল হেলথ কভারেজ (ইউএইচসি) সংক্রান্ত প্রস্তাবে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করে আসে।

২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসেও নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ইউএইচসির পক্ষে প্রতিশ্রুতি  দেয় বাংলাদেশ। কিন্তু  তা স্বাক্ষর ও প্রতিশ্রুতির মধ্যেই রয়ে  গেছে।

ডক্টরস ফর হেলথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদী-ই মাহবুব ভোরের আকাশকে বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রোগীর সুরক্ষায় স্বাস্থ্য বিমা চালু থাকলেও বাংলাদেশে এখনো এ সেবা সফলভাবে চালু করা সম্ভব হয়নি। স্বাস্থ্যবিমা শুরু হলেও তা দেশের মাত্র একটি জেলার তিনটি থানায় পাইলট প্রকল্প হিসেবে চালু রয়েছে। 

সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা কার্যক্রম সম্প্রসারণে দেশের মানুষকে স্বাস্থ্য বিমায় আগ্রহী  করতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সভাপতি অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান ভোরের আকাশকে  বলেন, সেবাপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা  থাকার পরও দেশের অধিকাংশ মানুষই স্বাস্থ্যসেবা পেতে বিমা করতে আগ্রহী নয়। তাছাড়া আগে টাকা দিয়ে পরে সেবা গ্রহণের মনোভাব না থাকা এবং একজনের টাকায় অন্যজনের চিকিৎসা এ বিষয়েও অনীহা রয়েছে। তাই স্বাস্থ্যবিমা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না।

পৃথিবীর উন্নত দেশ এবং কল্যাণ রাষ্ট্রগুলোয় মানুষের স্বাস্থ্য সেবা অনেকাংশে বিমার ওপর নির্ভরশীল। ফলে স্বাস্থ্যসেবা ব্যয় মেটাতে সেসব দেশের জনগণকে আর্থিক সমস্যায় পড়তে হয় না।  কিন্তু স্বাস্থ্যসেবা পেতে বাংলাদেশের মানুষকে মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ের ৬৭ ভাগ পকেট থেকে করতে হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ ভোরের আকাশকে বলেন, স্বাস্থ্যবিমা বাস্তবায়নের জন্য পরিবেশ সৃষ্টি করা দরকার। যা দেশে এখনো হয়নি। জনগণের সচেতনতা প্রয়োজন। স্বাস্থ্যবিমা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে করতে হবে। যা বাধ্যতামূলক হবে। বিমা ফরমাল সেক্টর ও করপোরেটে চালু করা সহজ হবে। কিন্তু ইনফরমাল সেক্টরে করা কঠিন।

রাজনৈতিক ঘোষণা দরকার, যাতে দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে এর আওতাভুক্ত করা যায়। যাদের বিমার কিস্তি দেওয়ার সামর্থ্য নেই, তাদের জন্য সরকার হেলথ ইক্যুয়িটি ফান্ড তৈরি করতে পারে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের তথ্য প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা সূচকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ১০টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতি ৫০ শতাংশ। অথচ এই সূচকে ভুটান ৭২, নেপাল ৬২, শ্রীলঙ্কা ৬৮, ইন্দোনেশিয়া ৬১, মালদ্বীপ ৭২, দক্ষিণ কোরিয়া ৭৮ ও থাইল্যান্ড সর্বোচ্চ ৮৮ শতাংশ অবস্থানে রয়েছে।

১০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশে ব্যক্তির পকেট থেকে খরচ হয় সর্বোচ্চ ৬৭ শতাংশ। আর থাইল্যান্ডে ১২, মালদ্বীপে ১৬, ভুটানে ২০, নেপালে ৬০, ভারতে ৬৫, ইন্দোনেশিয়ায় ৪৮ ও শ্রীলঙ্কায় ৩৮ শতাংশ ব্যয় হয় ব্যক্তির পকেট থেকে।

গড় আয়ু ৭২ বছরের এ দেশে স্বাস্থ্যবিমা বাধ্যতামূলক নয়, যা বিশ্বের অনেক দেশেই বাধ্যতামূলক। জাতীয়ভাবে স্বাস্থ্যবীমা চালু করার মাধ্যমে চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা ব্যয়ের একটি সহজ সমাধান দিয়ে যাচ্ছে বিশ্বের অনেক দেশ। 

সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভিয়েতনামে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে স্বাস্থ্যবিমা কার্যক্রম। হ্যানয় মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটির ফরেন এ্যাফেয়ার্স বিভাগের প্রধান ড. ভ্যান থ্যান রয়টার্সকে বলেন, ৮৭ ভাগ মানুষ ইউনিভার্সাল হেলথ কভারেজের (ইউএইচসি) আওতাভুক্ত।

অর্থাৎ স্বাস্থ্যবিমার মাধ্যমে দেশটির মানুষ তাদের চিকিৎসা ব্যয় নির্বাহ করে থাকে। ওই বিমার আওতায় ক্যান্সার, কিডনি বিকল কিংবা এইচআইভি-এইডস, লিভারসহ বিভিন্ন জটিল রোগের চিকিৎসাব্যয়ও মেটানো হয়।

মন্তব্য

Beta version