-->
শিরোনাম

ক্যান্সারে আক্রান্ত ১০০ জনে ৫ জন

রাজন ভট্টাচার্য
ক্যান্সারে আক্রান্ত ১০০ জনে ৫ জন

পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দেশে চিকিৎসা নিতে যাওয়া প্রতি ১০০ রোগীর মধ্যে কমপক্ষে পাঁচজন ক্যান্সারে আক্রান্ত। গেল পাঁচ বছরে আক্রান্তের হার বেড়েছে অন্তত ছয় ভাগ। নানা কারণে আগামী দিনগুলোতেও বাংলাদেশসহ এশিয়ার দেশগুলোতে এই মরণব্যাধিতে আক্রান্তের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়াতে চার ধরনের ক্যান্সার সবচেয়ে বেশি। পুরুষের ক্ষেত্রে মুখগহ্বর বা জিহ্বায় ও ফুফফুসে ক্যান্সার হয়। আর নারীরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন স্তন ও জরায়ু ক্যান্সারে।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লাইফ স্টাইলের পরিবর্তন, ধূমপান, তামাকজাত জিনিস খাওয়া, ফাস্ট ফুড ও চর্বি জাতীয় খাবার, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, সচেতনতার অভাব ও অ্যালকোহল সেবনের কারণে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে প্রাণঘাতী এই ক্যান্সারের বিস্তার ঘটছে ব্যাপক হারে।

ভারতের একটি ক্যান্সার গবেষণা প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসকরা বলছেন, অপরিচ্ছন্ন থাকার কারণে গ্রামের নারীরা বেশির ভাগ জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন। আর শহরের নারীরা আক্রান্ত হচ্ছেন চর্বি জাতীয় খাদ্যাভ্যাসের কারণে।

তাই ক্যান্সার নিরাময়ে নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপনের পরামর্শ দিয়ে চিকিৎসকরা বলছেন, ৪০ বছরের বেশি হলেই বছরে অন্তত একবার ক্যান্সার পরীক্ষা করানো উচিত। আর যথাসময়ে ধরা পরলে এখন এ রোগ থেকে নিরাময় পাওয়া সম্ভব বলেও মনে করেন তারা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৮ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১ লাখ ৫০ হাজার ৭৮১ জন। ওই বছর ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ১ লাখ ৮ হাজার ১৩৭ জন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা আরো বাড়ছে।

সময়ের ব্যবধানে রোগীর সংখ্যা বাড়লেও চিকিৎসা সেবার মান নিয়ে এখনো প্রশ্ন রয়েছে রোগী ও তাদের স্বজনদের।

আরেকটি আন্তর্জাতিক সংস্থার পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি বছর বাংলাদেশে প্রায় ১ লাখ ৫৬ হাজার রোগী নতুন করে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় এবং প্রায় ১ লাখ ৯ হাজার রোগী মারা যায়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী প্রায় ১ কোটি মানুষ বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। ক্যান্সারে আক্রান্ত ও মৃতদের তালিকায় স্থান পাওয়াদের অধিকাংশই এশিয়ার বাসিন্দা।চিকিৎসকদের মতে, ক্যান্সার সারানোর জন্য বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়।

তবে প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়লে এই রোগ সারানোর সম্ভাবনা অনেকাংশে বেড়ে যায়। ২০০ প্রকারেরও বেশি ক্যান্সার রয়েছে। প্রত্যেকটির ধরনই আলাদা। চিকিৎসা পদ্ধতিও ভিন্ন। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় ক্যান্সার হলো অনিয়ন্ত্রিত কোষ বিভাজনসংক্রান্ত রোগের সমষ্টি।

এখন পর্যন্ত এই রোগে মৃত্যুর হার অনেক বেশি। কারণ প্রাথমিক অবস্থায় ক্যান্সার শনাক্ত করা যায় না। ফলে শেষ পর্যায়ে গিয়ে ভালো কোনো চিকিৎসা দেওয়াও সম্ভব হয় না।

জানতে চাইলে ভারতের রুবি ক্যান্সার সেন্টারের ক্লিনিক্যাল অনকোলজিস্ট বিভাগের কনসালট্যান্ট ডা. সন্দিপ সরকার ভোরের আকাশকে বলেন, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়াতে ক্যান্সারে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে।

সাউথ এশিয়ায় পুরুষ ও নারীদের ক্ষেত্রে সাধারণত চার ধরনের ক্যান্সার বেশি দেখা যায়। আমাদের গবেষণা বলছে, বহির্বিভাগে ক্যান্সারের চিকিৎসা নিতে আসা প্রতি ১০০ জনের মধ্যে কমপক্ষে ৫ জন আক্রান্ত। গত পাঁচ বছরে ক্যান্সারে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে অন্তত ছয় ভাগ।

ক্যান্সার প্রতিরোধে সচেতনতা বাড়ানোর ওপর জোর দিয়ে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ৪০ বছরের বেশি হলে নিয়মিত স্ক্রিনিং প্রোগ্রামে যেতে হবে। জরায়ু ক্যান্সার প্রতিরোধে নারীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা আরো বেশি জরুরি।

ক্যান্সার প্রতিরোধে ধূমপান পরিহার করে খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনার পরামর্শ দিয়ে সন্দিপ সরকার বলেন, নিয়মিত শাক-সবজি, ফল খেতে হবে। ওজন কমাতে হবে। নিয়মিত ব্যায়াম করা উচিত। অ্যালকোহল ও ফেটি খাবার বর্জন করার কোনো বিকল্প নেই বলেও মনে করেন তিনি।

প্রয়োজন ক্যান্সার চিকিৎসার নিবন্ধন

বাংলাদেশে ক্যান্সার চিকিৎসায় সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া খুবই কষ্টকর। তাই বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সঠিক পরিকল্পনার জন্য সঠিক পরিসংখ্যান প্রয়োজন। একমাত্র জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট এ হাসপাতালভিত্তিক নিবন্ধন চালু আছে, কিন্তু জনগোষ্ঠীভিত্তিক নিবন্ধন এখনো চালু হয়নি।

এ কারণে দেশে ক্যান্সার আক্রান্তের হার মৃত্যুর হারসহ গুরুত্বপূর্ণ নিজস্ব পরিসংখ্যান নেই। তাই পাইলট প্রকল্প হিসেবে পপুলেশন বেইজড ক্যান্সার রেজিস্ট্রি চালুর পরামর্শ স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের। তবে সরকারি উদ্যোগে ক্যান্সার চিকিৎসা সুবিধা বাড়ানোর প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে।

ইতোমধ্যে আটটি বিভাগীয় শহরে পূর্ণাঙ্গ ক্যান্সার চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপনের কাজ চলমান। তবে অনুমিত ক্যান্সার রোগীর এক-তৃতীয়াংশ বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় সংযুক্ত হয় বলে একটি জরিপে দেখা গেছে। বাকিদের স্ক্রিনিংয়ের মাধ্যমে প্রাথমিক অবস্থায় নির্ণয় ও স্বল্প চিকিৎসায় সুস্থ করা সম্ভব।

জাতীয় ক্যান্সার স্ক্রিনিং কর্মসূচি নেইবিশ্বের বিভিন্ন দেশে জাতীয় ক্যান্সার স্ক্রিনিং কর্মসূচি চালু থাকলেও বাংলাদেশে তা নেই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)-এর একটি প্রকল্পের অধীনে স্তন ও জরায়ুমুখের ক্যান্সারের স্ক্রিনিং চলছে।

তবে জাতীয়ভাবে স্তন, জরায়ুমুখ ও মুখগহ্বরের ক্যান্সার অন্তর্ভুক্ত করে আন্তর্জাতিক স্বীকৃত উপযুক্ত পদ্ধতি প্রয়োগে বিজ্ঞানসম্মত সংগঠিত কর্মসূচি চালুর ওপর জোর দেন চিকিৎসকরা। এজন্য সরকারের জাতীয় প্রতিষ্ঠান ও এর সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের পরিচালনা ও তদারকির সঙ্গে যুক্ত করার আহবান জানান অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।

প্রাথমিক প্রতিরোধে করণীয়

ক্যান্সারের প্রাথমিক প্রতিরোধের জন্য হেপাটাইটিস বি ও হিউম্যান পেপিলোমা ভাইরাসের বিরুদ্ধে টিকাদান ও স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাত্রায় জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নেওয়া দরকার বলে মনে করেন চিকিৎসকরা।

এদিকে দেশে জাতীয়ভাবে ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণে কৌশল, কর্মপরিকল্পনা ও কর্মসূচি নেই বলে জানিয়েছেন বিশিষ্ট ক্যান্সার রোগতত্ত্ববিদ ও জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউটের ক্যান্সার ইপিডেমিওলজি বিভাগের প্রধান ডা. মো. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন। একইসঙ্গে ক্যান্সার শনাক্তে জাতীয় কোনো ক্যান্সার স্ক্রিনিং কর্মসূচি না থাকায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন এই চিকিৎসক।

বছরে আক্রান্ত এক লাখ ৫৬ হাজার

প্রতি বছর বাংলাদেশে প্রায় ১ লাখ ৫৬ হাজার রোগী নতুন করে ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে এবং তাদের মধ্য থেকে প্রায় ১ লাখ ৯ হাজার রোগীই মারা যাচ্ছে। এটা ঠিক যে, বিপুল জনসংখ্যার এ দেশে শুধু সরকারের পক্ষে এটা সম্ভব নয়। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গবেষণায় এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে।

জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. স্বপন কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, প্রতি বছর ২০ হাজারের অধিক লোক ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে আসে।

সব ধরনের তামাক বর্জন, মেয়েদের ১৮ বছরের নিচে বিয়ে না দেওয়া এবং নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপনে সহজেই এ রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। পাশাপাশি খাবার টেবিলে শাক-সবজি খেলে অনেক ক্যান্সার প্রতিরোধ সম্ভব।

মন্তব্য

Beta version