-->
টিকা মৃত্যু কমায়, সংক্রমণ ঠেকায় না

এখনো ঝুঁকিতে দেশ

নিখিল মানখিন ও আরিফ সাওন
এখনো ঝুঁকিতে দেশ

দেশের করোনা পরিস্থিতি এখনো ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, দৈনিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে পরীক্ষা বিবেচনায় করোনা সংক্রমণের হার কমছে। তবে ঝুঁকিপূর্ণ স্তরে রয়েছে। তা ছাড়া সারাবিশ্ব থেকে করোনা মহামারি দূর না হওয়া পর্যন্ত সংক্রমণ যেকোনো সময় বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

দেশে দুর্বল প্রতিরোধ কার্যক্রমের পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধিও মানা হচ্ছে না। এছাড়া করোনার নমুনা পরীক্ষা করাতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে দেশের মানুষ। উপসর্গহীন রোগী এবং করোনা রোগীর অবাধ চলাফেরা দেশকে আরো বেশি করোনা ঝুঁকিতে ফেলে দিচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

করোনাভাইরাসের তৃতীয় ঢেউয়ের আঘাতে জর্জরিত বিশ্বের অধিকাংশ দেশ। হ্রাস পাওয়ার কয়েক সপ্তাহ পরই হঠাৎ করে বেড়ে যাচ্ছে সংক্রমণ।

পরিসংখ্যানগতভাবে বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। তবে পরিসংখ্যানগত করোনার চিত্রে আশঙ্কামুক্ত থাকতে পারছেন না দেশের মানুষ। করোনা রোগীদের চিকিৎসাসেবা প্রদান এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা ছাড়া করোনার তৃতীয় ঢেউ মোকাবিলায় দেশে দৃশ্যমান কর্মসূচি নেই।

জানুয়ারিতে করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে সরকারি নির্দেশনা জারি করা হলেও বাস্তবে তা কার্যকর হচ্ছে না। নির্দেশনা ঘোষণা দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেন সংশ্লিষ্টরা। মাঠে নেই নজরদারি। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা, বিভিন্ন জরিপ এবং দৈনিক রোগী শনাক্তের হার দেখিয়ে দিচ্ছে বাংলাদেশ এখনো করোনার প্রবল থাবা থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। তবে তৃতীয় ঢেউ মোকাবিলায় বাংলাদেশের প্রস্তুতি রয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই করোনা সংক্রমণের হার কমে গিয়ে আবার বেড়েছে। বাংলাদেশেও ঘটেছে এমন ঘটনা। বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২০ সালে সংক্রমণের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা শুরু হয় এপ্রিলে। জুন পর্যন্ত সংক্রমণ উঠতে থাকে। জুলাই থেকে নিম্নমুখী প্রবণতা শুরু হয়। আগস্ট, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর পর্যন্ত নিম্নমুখী থেকে নভেম্বরে আবার কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা শুরু হয়ে ডিসেম্বরে আবার কমতে শুরু করে।

২০২১ সালের জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি একেবারেই কমে গিয়ে মার্চে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা শুরু হয়। এপ্রিলে অনেক বেড়ে যায়। মে মাসে কমে আবার জুন মাসে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা জুলাই পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। আগস্টে কমতে শুরু করে নভেম্বর পর্যন্ত কমে ডিসেম্বরের শেষের দিকে কিছুটা বাড়তে শুরু করে।

আর ২০২২ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ থেকে অবনতি ঘটতে থাকে দেশের করোনা পরিস্থিতির। ঝুঁকিপূর্ণ স্তরে পৌঁছে গত এক সপ্তাহ ধরে ধীরে ধীরে কমছে সংক্রমণের হার। তবে করোনায় দৈনিক মৃতের সংখ্যা বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। তাই আমাদের করোনাভাইরাস বিষয়ে অসতর্ক হওয়ার কোনো সুযোগ নেই, বরং আমাদের আরো বেশি সচেতন এবং সতর্কতার ওপর জোর দেওয়া উচিত।

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুস্তাক হোসেন ভোরের আকাশকে বলেন, আমরা আশা করতে পারি শিগগিরই করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বিপৎসীমার নিচে চলে আসবে। তবে আবারও বেড়ে যেতে পারে। পৃথিবীর অন্য দেশেও এটা হয়েছে।

যখন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কমে যায় তখন মানুষ অসতর্ক হয়ে যায়, ফলে সংক্রমণ পুনরায় বেড়ে যায়। আমরা এমনিতেই অসতর্ক, তাই দেশে সংক্রমণ আবার বেড়ে যেতে পারে। টিকা মৃত্যুর ঝুঁকি কমায়, সংক্রমণ ঠেকাতে পারে না। তাই টিকা গ্রহণ করলেই পুনরায় সংক্রমিত হবেন না-এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। যতক্ষণ পর্যন্ত পৃথিবী থেকে করোনাভাইরাস পুরোপুরি বিদায় না হবে ততদিন সংক্রমণের আশঙ্কা থাকবেই। সংক্রমণের হ্রাস-বৃদ্ধির খেলা চলবে।

আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এএসএম আলমগীর ভোরের আকাশকে বলেন, দেশের বর্তমান করোনা পরিস্থিতিকে আমরা কোনোভাবেই ঝুঁকিমুক্ত ভাবতে পারি না। কমে গিয়ে হঠাৎ প্রবল হয়ে ওঠার ঘটনা রয়েছে। তাই নির্দেশিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিকল্প নেই। সবকিছু বিবেচনায় নিয়েই করোনা প্রতিরোধে কাজ করে যাচ্ছে সরকার। মানুষের স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রবণতা কমলে কিছুদিন পরই সংক্রমণ বাড়তে দেখা যায়।

স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ ভোরের আকাশকে বলেন, করোনা মোকাবিলায় সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে সরকার। বিশ্ব ও দেশের করোনা পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গে করোনা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমেও পরিবর্তন ঘটে চলেছে। সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকলেও করোনার ঝুঁকি থেকে মুক্ত হতে পারেনি বাংলাদেশ।

তাই সরকারি নির্দেশনাসমূহ পালনের মাধ্যমে করোনা প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে পারেন দেশের মানুষ। কেউই করোনাভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কা থেকে মুক্ত নন। ফলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা ছাড়া কোনো উপায় নেই।

করোনা মোকাবিলার জন্য গঠিত জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ ভোরের আকাশকে বলেন, করোনা মোকাবিলায় বাংলাদেশের সফলতা বিশ্বের অনেক উন্নত দেশকে পেছনে ফেলে দিয়েছে। বাংলাদেশের জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১২শ জনের বেশি। জনসংখ্যায় বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম।

তাই এক জায়গায় সংক্রমণ শুরু হলে সারা দেশে ছড়াতে খুব বেশি সময় লাগে না। দেশের করোনা পরিস্থিতি এখনো ঝুঁকির মধ্যে রয়ে গেছে বলে জানান ডা. মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ।

মন্তব্য

Beta version