-->

মৃত্যুর পেছনে ওমিক্রন, না ডেল্টা

নিখিল মানখিন ও আরিফ সাওন
মৃত্যুর পেছনে ওমিক্রন, না ডেল্টা

ওমিক্রন ও ডেল্টা- করোনায় মৃত্যুর পেছনে কোনটির ভূমিকা কতটুকু? বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে দেশের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও বিজ্ঞানীদের। মৃত্যুর পেছনে করোনার এই দুই ভ্যারিয়েন্টের ভূমিকা নির্ধারিত না হলেও সংক্রমণে এগিয়ে রয়েছে ওমিক্রন। পৃথক দুটি জিনোম সিকোয়েন্সিং গবেষণায় দেখা গেছে, জানুয়ারিতে ৮০ শতাংশই ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট দ্বারা সংক্রমিত হয়েছেন এবং ২০ শতাংশ ডেল্টায়। যদিও এক মাস আগের চিত্র ছিল ঠিক উল্টো। তখন ডেল্টা ছিল ৮০ শতাংশ এবং ওমিক্রন ছিল ২০ শতাংশ।

গতকাল বৃহস্পতিবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) জিনোম সিকোয়েন্সিং গবেষণা ফল প্রকাশ করেছে। এর এক দিন আগে বুধবার জিনোম সিকোয়েন্সিং করে অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন তৈরি করেছে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। এই সিকোয়েসিং করেছে চারটি প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের পৃথক পৃথক জিনোম সিকোয়েন্সিং গবেষণায় করোনা রোগীর মৃত্যুর পেছনে বিভিন্ন কো-মরবিডিটির ভূমিকার বিষয়টি উল্লেখ করা হলেও ওমিক্রন ও ডেল্টার পৃথক ভূমিকার বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়নি।

কোভিড-১৯-এর জিনোম সিকোয়েন্সিং গবেষণার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, সার্স-কোভ-২-এর জিনোমের গঠন উন্মোচন ও পরিবর্তনের ধরন এবং বৈশ্বিক কোভিড-১৯ ভাইরাসের জিনোমের সঙ্গে এর আন্তঃসম্পর্ক বের করা, ভাইরাসের বিবর্তনীয় সম্পর্ক, রোগের উপসর্গ, রোগের প্রখরতা, তুলনামূলক হাসপাতাল অবস্থানের মেয়াদকাল এবং বাংলাদেশি কোভিড-১৯ জিনোম ডাটাবেস তৈরি করা। জিনোমিক ডাটাবেজে বিএসএমএমইউ-এর এই গবেষণা ফলাফল ভ্যাকসিন তৈরির ক্ষেত্রেও বৈজ্ঞানিক অবদানের একটি মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে বলে জানান উপাচার্য।

মৃত্যুর পেছনে ওমিক্রন, না ডেল্টা

করোনায় মৃত্যুর পেছনে ডেল্টার চেয়ে ওমিক্রনের ভূমিকা এগিয়ে রেখে আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ এস এম আলমগীর হোসেন ভোরের আকাশকে বলেন, বর্তমানে করোনায় মৃত্যুর পেছনে ডেল্টা ও ওমিক্রনের পৃথক ভূমিকা বের করা খুবই কঠিন কাজ। তবে মৃত্যুর পেছনে ওমিক্রনের ভূমিকাটাই এগিয়ে রাখতে পারি। কারণ, ডেল্টার চেয়ে ওমিক্রনের সংক্রমণ কয়েকগুণ বেশি। সংক্রমণ বেশি ঘটালে মৃত্যুও বেশি ঘটাবে-এটাই স্বাভাবিক। তিনি আরো বলেন, যেসব করোনা রোগীর কো-মরবিডিটি বেশি থাকে, টিকা গ্রহণ করেননি, মৃত্যুর তালিকায় রয়েছেন সেসব করোনা রোগী।

স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর জোর দেন এ এস এম আলমগীর।

এদিকে করোনায় মৃত্যুর পেছনে ডেল্টা ধরনকে এগিয়ে রেখে বিএসএমএমইউ-এর উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ ভোরের আকাশকে বলেন, সংক্রমণে ওমিক্রন এগিয়ে থাকলেও মৃত্যুর পেছনে এখনো ডেল্টাই বেশি ভূমিকা রাখছে। আর উচ্চ রক্তচাপ, ফুসফুল, ক্যান্সার ও কিডনি জটিলতা থাকা এবং টিকা গ্রহণ করেননি এমন করোনা রোগীদের বেশি মৃত্যু হচ্ছে বলে জানান উপাচার্য।

বয়স, কো-মরবিডিটি ও টিকা না নেওয়ায় মৃত্যু বেশি

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বর্তমানে ৩০ থেকে ৫৯ বছর বয়সের রোগীদের সংখ্যা বেশি। শিশুদের মধ্যেও কোভিড সংক্রমণ পাওয়া গেছে। পুরুষ ও নারীদের আক্রান্তের হার প্রায় সমান সংখ্যক; ৪৯ শতাংশ পুরুষ, ৫১ শতাংশ নারী।

কোভিড আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে যাদের কো-মরবিডিটি রয়েছে, যেমন- ক্যান্সার, উচ্চরক্তচাপ, শ্বাসতন্ত্রের রোগ, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস তাদের রোগের প্রকটতা বেশি। চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি থেকে ৯ ফেব্রুয়ারি হাসপাতালে ভর্তি রোগী এবং বহির্বিভাগ রোগীর মধ্যে ৮২ শতাংশ ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত ও ১৮ শতাংশ ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট পেয়েছেন বিএসএমএমইউর গবেষক দল।

এদিকে জানুয়ারি মাসে ১ থেকে ৩১ তারিখ পর্যন্ত চার প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সংগ্রহ করা ১৪৮ নমুনায় ৮০ শতাংশ ওমিক্রন ও ২০ শতাংশ ডেল্টা পাওয়ার তথ্য প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে আইইডিসিআরসহ চার প্রতিষ্ঠান। তারা সারা দেশ থেকে এই নমুনা সংগ্রহ করে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বয়স্করাই করোনায় বেশি মারা গেছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, গত ৩১ জানুয়ারি থেকে ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মারা যাওয়া ২২৬ জনের মধ্যে ৬৫ জন টিকা নিয়েছিলেন অর্থাৎ ২৮ দশমিক ৮ শতাংশ। টিকা নেননি ১৬১ জন অর্থাৎ ৭১ দশমিক ২ শতাংশ। এই সপ্তাহের মৃতদের মধ্যে ১১৭ জনের অর্থাৎ ৫১ দশমিক ৮ শতাংশের কো-মরবিডিটি ছিল। মৃতদের মধ্যে নারী পুরুষের তফাৎ খুব বেশি নয়। ১২৯ জন পুরুষ অর্থাৎ ৫৭ দশমিক ১ শতাংশ এবং নারী ৯৭৬ জন অর্থাৎ ৪২ দশমিক ৯ শতাংশ।

ওমিক্রন আক্রান্ত রোগীর দুই ডোজ ভ্যাকসিন দেওয়া ছিল জানিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, এতে এটা প্রমাণ করে যে, ভ্যারিয়েন্ট নয় টিকা নেওয়ার জন্য রোগের প্রখরতা কম হয়েছে। তৃতীয়বারের মতো আক্রান্ত হয়েছে এরকম রোগীরও ওমিক্রন পাওয়া গেছে।

তিনি আরো বলেন, হাসপাতালে ভর্তিরোগী জিনোম সিকোয়েন্স করে আমরা ৬৫ শতাংশ রোগীতে ওমিক্রন এবং ৩৫ শতাংশ রোগীতে ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট পেয়েছি। মৃদু উপসর্গের কারণে ওমিক্রন রোগীদের থেকে দ্রুত সংক্রমণ প্রবণতাও দেখা যাচ্ছে। ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট থেকে কম মাথাব্যথা এবং সর্দির মতো উপসর্গ হয়। ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত হলে হাসপাতালে ভর্তির সম্ভাবনা কম।

জানতে চাইলে আইইডিসিআরের উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মুশতাক হোসেন ভোরের আকাশকে বলেন, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া করোনা রোগীর সংখ্যা কম হলে দেশে করোনায় মৃত্যুর আশঙ্কাও কম থাকে।

অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, এই গবেষণা জিনোমিক ডাটাবেজ থেকে বাংলাদেশে ভ্যাকসিন তৈরির ক্ষেত্রে সম্ভবনা সৃষ্টি করে। প্রত্যেক করোনা ভাইরাস ভ্যারিয়েন্ট বিপজ্জজনক এবং তা মারাত্মক অসুস্থতা এমনকি মৃত্যুও কারণও হতে পারে। পাশাপাশি ভাইরাসের নিয়মিত মিউটেশনে আমাদের প্রচলিত স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ঝুঁকিপূর্ণ করতে পারে। তাই করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে ও টিকা গ্রহণ করতে হবে।

বিএসএমএমইউ ২০২১ সালের ২৯ জুন থেকে জিনোম সিকোয়েন্সিং গবেষণা করে আসছে। চলতি বছরের ৯ ফেব্রæয়ারি পর্যন্ত কোভিড-১৯ আক্রান্ত দেশব্যাপী রোগীদের ওপর এই গবেষণা পরিচালিত হয়। এই গবেষণায় বাংলাদেশের সকল বিভাগের রিপ্রেজেন্টেটিভ স্যাম্পলিং করা হয়েছে।

গবেষণায় ৯৩৭ কোভিড-১৯ পজিটিভ রোগীর ন্যাযোফ্যারিনজিয়াল সোয়াব স্যাম্পল থেকে নেক্সট জেনারেশন সিকোয়েন্সিংয়ের মাধ্যমে করোনাভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্সিং করা হয় এবং জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের সঙ্গে রোগীর তথ্য-উপাত্তের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করা হয়।

মন্তব্য

Beta version