টিকা নিতে লাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা

নিখিল মানখিন ও আরিফ সাওন
টিকা নিতে লাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে টিকা প্রত্যাশীদের ভিড়

রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকার সেন্ট্রাল রোডের বাসিন্দা মো. ইসমাইল (২৫)। করোনা টিকার প্রথম ডোজ নিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের টিকাকেন্দ্রে শনিবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) সকাল সাড়ে আটটা থেকেই লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। পরীবাগ ফুটওভার ব্রিজের কাছের সরু গলিপথে এই টিকা সেন্টার। সকাল ১১টা পেরিয়ে গেলেও টিকা সেন্টার ভবনটির গেটে পৌঁছাতে পারেননি মো. ইসমাইল। তার মতো শত শত মানুষ টিকা নিতে দীর্ঘ লাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করেছেন।

আর শুধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় টিকাকেন্দ্র নয়, সারা দেশের টিকা কেন্দ্রগুলোতে টিকাগ্রহণকারীদের উপচেপড়া ভিড় ছিল বলে খবর পাওয়া গেছে। শনিবার সরকারঘোষিত এক কোটি মানুষকে করোনা টিকার প্রথম ডোজ প্রদান কর্মসূচিতে এমন চিত্র দেখা গেছে।

সরকার এক দিনে এক কোটি মানুষকে করোনা টিকা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল অনেক আগেই। পাশাপাশি জানানো হয়েছিল যে, ২৬ ফেব্রুয়ারির পর দেশে আর করোনা টিকার প্রথম ডোজ দেওয়া হবে না। পরবর্তীতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে ২৬ ফেব্রুয়ারির পরও প্রথম ডোজ চালু থাকার বিষয়টি প্রচার হয়। তবে ২৬ ফেব্রুয়ারির পর প্রথম ডোজ চালু থাকা, না থাকার বিষয়টি জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। প্রথম ডোজ বন্ধ হওয়ার আশঙ্কায় গত কয়েক দিন ধরে প্রথম ডোজ দেওয়ার টিকা কেন্দ্রগুলোতে মানুষের উপচেপড়া ভিড় লক্ষ করা যাচ্ছে। ২৬ ফেব্রুয়ারি প্রথম ডোজ টিকা গ্রহণকারীদের চাপ যেন কয়েকগুণ বেড়ে যায়।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে টিকা প্রত্যাশীদের ভিড়। (ছবি: ভোরের আকাশ)

 

সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনেও টিকা প্রত্যাশীদের প্রচণ্ড ভিড়। টিকা নেওয়ার জন্য সকাল সাড়ে সাতটায় এসে লাইনে দাঁড়ান ২২ বছর বয়সী সাজ্জাদ। বেলা ১০টায়ও তিনি টিকা নিতে পারেননি। সামনে যে সংখ্যক লোক আছে তাতে ১১টায়ও পারবেন কিনা সন্দেহ তার। সকাল সাড়ে ১০টায় জরুরি বিভাগের সামনে গেটের বাইরে একটি শিশুকে নিয়ে বসে ছিলেন তিনজন। একজন নারী, দুইজন পুরুষ। তাদের মধ্যে মো. শাকিল ভোরের আকাশকে জানান, তিনি ২৪ জানুয়ারি রেজিস্ট্রেশন করেছেন কিন্তু আজও এসএমএস পাননি। ২৬ তারিখ গণটিকার কথা শুনে স্ত্রী ও ভাইকে নিয়ে এসেছেন টিকা দিতে। তিনি বলেন, ‘সকাল ৯টায় এসে লাইনে দাঁড়িয়েছি। সেখান থেকে ৪ তলায় পাঠাল। সেখান থেকে নিচে এসে ফটোকপি জমা দিয়ে এসেছি। এখন পর্যন্ত মেসেজ আসেনি। মেসেজ আসবে বলে জানানো হয়েছে। কখন আসবে তা জানি না। বাসাও দূরে, নন্দীপাড়ায়। তাই বাসায়ও যাচ্ছি না। এখানে বসে আছি।’ কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে জানেন না মো. শাকিল।

টিকা নিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর থেকে ঢাকায় এসেছেন নিত্যানন্দ। তিনি জানান, ৯ ফেব্রুয়ারি টিকার রেজিস্ট্রেশন করেন। পরে জানতে পারেন তার টিকাকেন্দ্র দেওয়া হয়েছে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের টিকাকেন্দ্রে। দুই দিন আগে তিনি টিকা নেওয়ার জন্য ঢাকায় এসেছেন। বৃহস্পতিবার দেড়টায় আসেন। দেরি হওয়ার কথা বলে এদিন টিকা দেওয়া হয়নি। শনিবারও এসেছেন তিনি। সকাল আটটায় লাইনে দাঁড়িয়ে ১০টার সময়ও টিকা নিতে পারেননি নিত্যানন্দ।

মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সকাল নয়টায় গিয়ে দেখা যায়, এন্ট্রি লাইন এন্ট্রি কাউন্টার থেকে নদীর মতো এঁকেবেঁকে গেছে হাসপাতাল ভবনের প্রবেশ গেট পর্যন্ত। শত শত লোক দাঁড়িয়ে লাইনে। বেলা বাড়ার সাথে সাথে এই লাইন আরো দীর্ঘ হতে থাকে। বেলা সাড়ে ১০টায় এই লাইন হাসপাতাল ভবনের বাইরে সড়কে চলে যেতে দেখা গেছে।

মুগদা মেডিকেলে ১১টা বুথে টিকা দেওয়া হচ্ছে। আগে যারা এসএমএস পেয়েছেন শুধু তাদেরই এখানে টিকা দেওয়া হচ্ছে। ফলে অনেকে লাইনে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর ছুটছেন উত্তর মুগদা ঝিলপাড় নগর মাতৃসদনে। সেখানেও দীর্ঘ লাইন। সকাল ৯টা থেকে বেলা ১১ পর্যন্ত মুগদা আইডিয়ালের গেট পর্যন্ত টিকা প্রত্যাশীদের লাইন দেখা গেছে।

লাইনে দাঁড়িয়ে থাকাদের মধ্যে বনশ্রী থেকে আসা বেল্লাল হোসেন জানান, তিনি সকাল ৭টায় এসে লাইনে দাঁড়িয়েছেন। বেলা পৌনে ১১ পর্যন্ত টিকা নিতে পারেননি। সামনে আরো অন্তত একশর বেশি মানুষ আছে। আরো কত সময় লাগবে তা নিশ্চিত না। এই লাইনের একেবারে শেষের দিকে দাঁড়িয়ে থাকা আব্দুর রহিম এসেছেন ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার থেকে। বয়স তার ষাটের ওপর।

তিনি জানান, ‘সকাল আটটায় এসে এখানে লাইনে দাঁড়াই। রেজিস্ট্রেশনে একটু সমস্যার জন্য ঘণ্টা খানেক পরে মুগদা মেডিকেলে গিয়ে লাইনে দাঁড়াই। সেখানে গিয়ে জানতে পারি, মেসেজ না গেলে ওখানে টিকা নেওয়া যাবে না। আব্দুর রহিম বলেন, পরে ১০টার দিকে আবার এখানে এসে দাঁড়াই। এই তো প্রায় ৪৫-৫০ মিনিট হয়ে গেল। স্কুলের গেটের সামনে ছিলাম। এই এত সময়ে ১৫-২০ হাত সামনে এসেছি।

আব্দুর রহিম যেখানে দাঁড়ানো ছিলেন সেখান থেকে কেন্দ্র দেখা যাচ্ছিল না। সামনে এত লোক লাইনে দাঁড়ানো আছেন, শেষ পর্যন্ত পাবেন কিন্তু সেই অনিশ্চিয়তায় তিনি। তবু হতাশ নন, আশাবাদী টিকা পাবেন। টিকা না পাওয়া পর্যন্ত লাইনে দাঁড়িয়ে থাকবেন বলে জানান তিনি। মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং উত্তর মুগদা ঝিলপাড় নগর মাতৃসদন সেন্টার দুই সেন্টারে নারীদের উপস্থিতি একেবারেই কম দেখা গেছে। সকাল ১০টা পর্যন্ত খুব একটা নারীদের উপস্থিতি দেখা যায়নি। ১০ টার পরে নারীদের উপস্থিতি বাড়তে থাকে। লাইনে শিশুদের নিয়ে বেশ ভোগান্তিতে ছিলেন অনেকে। মাঝে মাঝে সন্তান কোলে থাকা দু-একজন মাকে আগে সুযোগ দেওয়া হলেও বেশির ভাই পাননি এই সুযোগ। তাদের লাইনে দাঁড়িয়েই নিতে হয়েছে টিকা।

মুগদা মেডিকেলে স্বেচ্ছাসেবক ও আনসার শৃঙ্খলার চেষ্টায় নিয়োজিত থাকলেও নগর মাতৃসদনে টিকা নেওয়ার জন্য লাইনে দাঁড়ানোদের শৃঙ্খলার বিষয়টি তেমন চোখে পড়েনি। যে কারণে সড়কে একসঙ্গে গাদাগাদি করে দুই-তিন লাইনের মতো করে লোকজন দাঁড়িয়ে ছিলেন। অল্প একটু জায়গা বাঁশ গিয়ে ঘেরা ছিল। স্বেচ্ছাসেবক ছিলেন কেন্দ্রের ভেতরে। এই সেন্টারের বাইরে লাইনে ছিল একপ্রকার হ-য-ব-র-ল অবস্থা। গরমে প্রচণ্ড রোদে হাফিয়ে উঠছিলেন নারী-পুরুষ-শিশু সবাই।

রাজধানীর খিলক্ষেতের আল মানার মডেল হাইস্কুল টিকাকেন্দ্রে দেখা গেছে, সকাল সাতটা থেকে দীর্ঘ  লাইনে নারী ও পুরুষরা দাঁড়ালেও টিকাদানকারী কর্মীরা সেখানে পৌঁছান সাড়ে ১০টার পর। এরমধ্যেই কেন্দ্রটির অপ্রশস্ত গেটে শুরু হয় টিকা প্রত্যাশীদের হুড়োহড়ি। টিকার তথ্য লেখার মতো জনবল না থাকায় টিকাদানকারী স্বাস্থ্যকর্মী পড়েন প্রচণ্ড সমস্যায়। কেন্দ্রটিতে টিকাদানকারীদের সহায়তায় ছিল না কোনো স্বেচ্ছাসেবক।

টিকাপ্রত্যাশীদের লাইন চলে গেছে রাস্তায়।

 

এ বিষয়ে ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের কাছে জানতে চাইলে তিনি অস্বস্তির সঙ্গে জানান, হঠাৎ করে স্থানীয় কাউন্সিলর তাকে ফোন করে জানান তার স্কুলটিতে টিকাকেন্দ্র করা হবে। টিকাদানকারীদের সহযোগিতা কারা করবে এমন প্রশ্নে তাকে স্থানীয় কয়েকজন রাজনৈতিক দলীয় নেতার নাম জানানো হয়। বলা হয়, তারা স্বেচ্ছাসেবকের ব্যবস্থা করবেন। এজন্য বিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরও তিনি এ কাজে সহযোগিতার জন্য আসতে বলেননি। তবে নির্ধারিত দিনে সহায়তা করার মতো কেউ সেখানে আসেননি।

এখানে নারীদের উপচেপড়া ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। টিকাকেন্দ্র টিকা নিতে আসা নূরজাহান, সারবানু, নীলা বেগম প্রমুখ নারীর কাছে ভোরের আকাশ জানতে চায়, সরকার একবছর ধরে টিকা দিলেও এতদিন টিকা নেননি কেন? এর উত্তরে তারা জানান, তারা আগেই টিকা নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু, ঘরের পুরুষদের আপত্তির কারণে টিকা নিতে পারেননি। তবে টিকা শেষ হয়ে যাচ্ছে এ তথ্য জেনে তাদের গৃহকর্তারা অনুমতি দিয়েছেন।

অন্যদিকে, রাজধানীর কুর্মিটোলা হাইস্কুলসহ বাড্ডার কয়েকটি কেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে টিকা প্রত্যাশীদের দীর্ঘ লাইন। কোথাও কোথাও লাইনে দাঁড়ানো ও লাইন ভেঙে সামনে যাওয়ার চেষ্টাকালে উপস্থিত টিকা প্রত্যাশীদের মধ্যে বাদানুবাদ এবং মারামারির ঘটনাও ঘটেছে।

তবে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল কেন্দ্রে দীর্ঘ লাইন দেখা গেলেও সেখানে খুবই নিয়ম মেনে টিকা দেওয়া হয়। সেখানে প্রশিক্ষিত কর্মী বাহিনী থাকায় লাইনে দাঁড়ানো টিকা প্রত্যাশীদের টিকা পেতে অনেক বেগ পেতে হয়নি। লাইনে দাঁড়িয়ে টিকা নেওয়া অনেকের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।

এদিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকেন্দ্রে ১৬টি বুথের মধ্যে ১২টি বুথে প্রথম ডোজের টিকা দেওয়া হচ্ছে। রাজধানীর চানখারপুলবাসী শেফালী বেগম (২১) লাইনে দাঁড়িয়ে ভোরের আকাশকে জানান, দেড় ঘণ্টা ধরে লাইনে আছি। ধীরে ধীরে এগুচ্ছে। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে গেছি।

দেরিতে প্রথম ডোজ নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি জানান, ফুটপাতে চা দোকান চালাতে স্বামীকে সাহায্য করে থাকি। সকালে দোকানে বসি, রাতে বাসায় ফিরি। তাই এত দিনে টিকা দেওয়া হয়নি’ বলে জানান শেফালী বেগম।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কেন্দ্র পরিদর্শন শেষে স্বাস্থ্যসেবা সচিব লোকমান হোসেন মিয়া বলেন, প্রথম ডোজের জন্য যে টার্গেট করা হয়েছে তার চেয়ে বেশি হবে আজ, কার্যক্রম সন্ধ্যা পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে চলবে, পরিস্থিতি বুঝে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

অবশ্য এরপর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়, করোনার প্রথম ডোজের টিকা কার্যক্রম আরো দুদিন বাড়িয়ে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত করা হয়েছে।

মন্তব্য