-->
শিরোনাম

‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’ মানবতার এক নাম

প্রণব কর্মকার
‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’
মানবতার এক নাম
প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক মিল্টন সমাদ্দার। আমৃত্যু মানুষের সেবায় কাজ করে যেতে চান তিনি। ছবি- ভোরের আকাশ

চার সন্তানের জননী সাদেমা আমযাদ। লন্ডনে প্রবাস জীবন কাটিয়েছেন দীর্ঘদিন। এ সুবাদে চার সন্তানই লন্ডন প্রবাসী। কয়েক বছর আগে গর্ভধারিণী মাকে গ্রামের বাড়ি নড়াইলে রেখে যায় সন্তানেরা। এরপর আর মায়ের খোঁজখবর নেয়নি সন্তানেরা। নাড়িছেঁড়া ধনেরা ফেলে গেলেও এই জননী পেয়ে গেছেন আরেক সন্তান। তবে সেটা নিজের জন্ম দেওয়া নয়, হঠাৎ পেয়ে যাওয়া সন্তানের ঠিকানাই এখন এই জননীর ঠিকানা।

একসময় বিলাস জীবনে অভ্যস্ত সাদেমা আমযাদের ঠাঁই মিলেছে রাজধানীর মিরপুরের ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’-এ। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী মিল্টন সমাদ্দারই এখন ভাগ্যাহত ওই জননীর হঠাৎ পেয়ে যাওয়া সন্তান।

শুধুই সাদেমা আমযাদ নন, এরকমভাবে নোয়াখালীর নুরজাহান বেগমসহ ১৩৫ জন বয়োবৃদ্ধ/বৃদ্ধা আছেন ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’। এখানে আরো আছে ২৫ জন অসহায় প্রতিবন্ধী শিশু। শেকড় হারানো এসব মানুষের ঠিকানা এখন ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’।

আধুনিকতার দোহাই দিয়ে মানুষ ভুলে যাচ্ছে নিজের শেকড় মা, মাটি ও মানুষের কথা। হারিয়ে যাচ্ছে একান্নবর্তী পরিবারগুলো। সমাজে দেখা দিচ্ছে নানাবিধ সমস্যা। বাড়ছে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা। সন্তান ভুলে যাচ্ছে নিজের মায়ের কথা, বাবার কথা। বৃদ্ধ বাবা-মাকে রাস্তায় রেখে চলে যাচ্ছে পাষাণ সন্তান। যে বয়সে সন্তানই হওয়ার কথা বৃদ্ধ মা-বাবার আশ্রয়স্থল, সেখানে ঘটছে উল্টো ঘটনা। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তাদের আনন্দের জীবনে নেমে আসে অন্ধকার, জীবন হয়ে ওঠে নিরানন্দ। জনক-জননীর আর্তনাদ-হাহাকারে পৃথিবী হয়ে ওঠে নিস্তব্ধ। ব্যক্তিগত বোধের অভাব ও জীবন সম্পর্কে ভ্রান্তিকর দর্শনের কারণে সমাজে তৈরি হচ্ছে এ ধরনের অমানবিক গল্প।

এসব অমানবিক গল্পের মধ্যেও আড়ালে থেকে যায় কিছু ভালো গল্প। মানবতার গল্প। এমনই এক মানবতার প্রতীক হয়ে উঠেছে ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’।

গল্পটা শুরু হয়েছিল ২০১৪ সালের ২১ অক্টোবর কাজ সেরে বাসায় ফিরছিলেন প্রতিষ্ঠানের মালিক মিল্টন সমদ্দার। রাস্তার পাশে এক বৃদ্ধের দুই পায়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন তিনি। কোনো কিছু না ভেবেই মিল্টন তাকে সঙ্গে করে নিয়ে এলেন নিজের বাসায়। নিজ হাতে গোসল করালেন। পরিষ্কার জামা-কাপড় পরিয়ে খাওয়ালেন। পরিচয়হীন বৃদ্ধাকে পরম যত্নে মরণাপন্ন অবস্থা থেকে সুস্থ করে তোলেন। কিন্তু অসহায় বৃদ্ধের যাওয়ার কোনো জায়গা না থাকায় তাকে আশ্রয় দিলেন মিল্টন। সেই থেকে শুরু ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’ আশ্রম।

এ পর্যন্ত এই আশ্রমে ঠাঁই হয়েছে অনেক শিক্ষক, ব্যবসায়ী, নার্স ও ডাক্তারসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের। যাদের সবাই পথে পড়ে থাকা মানুষ। তবে আশার বাণী হলো, আশ্রয় নেওয়া অনেক বাবা-মাকে তাদের পরিবারের কাছে পৌঁছে দিতে পেরেছে এই প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে আশ্রমটির আশ্রইয়ে ১৩৫জন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ও ২৫ জন অসহায় প্রতিবন্ধী শিশু রয়েছে।

নুরজাহান বেগম এদের মধ্যে একজন। মধ্য বয়সি এই নারীর বাড়ি নোয়াখালী। নিঃসন্তান এই মহিলা কাজ করতেন চট্টগ্রামের একটি গার্মেন্টসে। চলাচলে অক্ষম হয়ে পড়েছিলেন রাস্তার পাশে। খবর পেয়ে চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ারের কর্মীরা নিয়ে আসে তাদের আশ্রয়ে। এখানে তিনি রয়েছেন প্রায় এক বছর ধরে। এখানে কেমন লাগে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি আমার বাড়ি আর নিজের বাড়িতে থাকতে সবারই ভালো লাগে।

ষাটের্ধ্ব অপর এক নুরজাহান বেগম। ছিলেন স্টাফ নার্স। বর্তমানে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে আশ্রয় হয়েছে রাজধানির চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ। তার ভাষ্য মতে, কেউ তাকে মিরপুর সারে এগারো নম্বরের খালের মধ্যে ফেলে রেখে গিয়েছিল। সেখান থেকে তাকে তাকে তুলে নিয়ে এসে সেবা দিচ্ছে চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ারের কর্মীরা। আশ্রমের এক কর্মীর কাছ থেকে জানতে পারি শোকে তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন। কিছুই মনে করতে পারেন না।

প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক মিল্টন সমাদ্দার। আমৃত্যু মানুষের সেবায় কাজ করে যেতে চান তিনি। তার মতে, মানুষ কখনো রাস্তায় থাকতে পারে না। আমরা চেষ্টা করছি পরিচয়হীন, অজ্ঞাত, অসুস্থ, রাস্তায় পড়ে থাকা বৃদ্ধ এবং প্রতিবন্ধী ও অসহায় শিশুদের পাশে দাঁড়াতে। বিশেষ করে রাস্তায় পড়ে থাকা যেসব ব্যক্তি চলাফেরার ক্ষমতাটুকু হারিয়ে অচল হয়ে পড়েছেন, কিংবা শরীরে পচন ধরেছে তাদের সুস্থ করে স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দিতে।

তিনি বলেন, সেই ২০১৪ সালে অনুষ্ঠানিকভাবে চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ারের যাত্রা। স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অসহায়, অসুস্থ বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ও প্রতিবন্ধী শিশুদের আশ্রয় দেব। পরিচয়হীনরা পরিচয় পাবে। ঘরহারা মানুষ পাবে নিরাপদ ঘর। বঞ্চিতরা পাবে সেবা। মহান আল্লাহ আমাকে সেই তাওফিক দান করেছেন। এটা প্রতিপালকের অসীম কৃপা। কে সেবা দেবেন আর কে সেবা গ্রহণ করবেন তিনিই একমাত্র নিয়ন্ত্রক।

একক উদ্যোগে একটি মানসম্পন্ন বৃদ্ধাশ্রম কেন্দ্র পরিচালনা করা একেবারেই অসম্ভব। মহান আল্লাহর অনুগ্রহে ও আপনাদের সহযোগিতায় এ পর্যন্ত ৮০০ জন অসহায়, অসুস্থ, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ও প্রতিবন্ধী শিশুদের নিরাপদ আশ্রয়সহ মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে পেরেছি। এছাড়া বার্ধক্যজনিত কারণে ইতোমধ্যে ২০৫ জন বয়স্ক ব্যক্তি ইন্তেকাল করেছেন। তাদেরকেও যথাযথ সম্মানের সঙ্গে বিদায় জানাতে পেরেছি। আমাদের আশ্রয়ে থাকা বাবা-মায়েদের সুষম খাদ্য, বস্ত্র, নিরাপদ আবাসন, উন্নত চিকিৎসাসহ সব ধরনের পরিচর্যা ও সেবা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছি। একই সঙ্গে পরিচয় বা ঠিকানা খুঁজে তাদের পরিবারের কাছে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করছি।

তিনি জানান, চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার স্থায়ী আবাসন নির্মাণ হতে যাচ্ছে। এরই মধ্যে সাভারে বিরুলিয়া তে ২৫ শতক জায়গায় ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। স্থায়ী আবাসন নির্মাণ হলে প্রথম অবস্থায় ৪০০ থেকে ৫০০ ব্যক্তিকে আশ্রয় দিতে পারব। বৃহৎ এই কাজ দেশের দানশীল মানুষদের সহযোগিতায় সম্ভব হচ্ছে। তিনি বিশ্বাস করেন, একদিন রাস্তায় থাকবে না কোনো অসহায় বৃদ্ধ বাবা-মা ও কোনো শিশু।

ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে উঠা দেশে বৃহৎ এই আশ্রমে প্রতি মাসে খরচ হয় ১৬ লাখ টাকা। কিন্ত কীভাবে ম্যানেজ হয় এত টাকা? জানতে চাইলে হিসাবরক্ষক মনির জানান, মিল্টন সমাদ্দার ও তার স্ত্রী দুজনেই পেশায় নার্স। এছাড়া ‘মিল্টন হোম কেয়ার প্রাইভেট লি:’ নামে তাদের একটি নার্সিং এজেন্সি আছে। যেখানে বাড়ি বাড়ি গিয়ে অসুস্থ বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের সেবা দেওয়া হয়।

মন্তব্য

Beta version