-->

করোনা-আতঙ্কে দুই বছর

* হয়েছে সম্পর্কের অগ্নিপরীক্ষা * এলোমেলো হয়েছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা * মহামারি মোকাবিলায় সফল বাংলাদেশ

নিখিল মানখিন ও আরিফ সাওন
করোনা-আতঙ্কে দুই বছর
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে টিকা প্রত্যাশীদের ভিড়

দেশে করোনাভাইরাস শনাক্তের দুই বছর পূর্ণ হয়েছে আজ। ২০২০ সালের এই দিনে দেশে প্রথম করোনা শনাক্তের খবর জানায় স্বাস্থ্য বিভাগ। বিশেষজ্ঞরা বলেন, করোনা মহামারি মোকাবিলায় সফলতা দেখিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। করোনা মহামারিকেন্দ্রিক নানা প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে ঘুরে দাঁড়ানোর সূচকে বিশ্বের অনেক উন্নত দেশকেও পেছনে ফেলে দিয়েছে দেশটি। সীমিত সম্পদ ও আয়তনের বিপরীতে বিপুল জনসংখ্যা নিয়ে বাংলাদেশের এই সাফল্যে ইতিমধ্যে বিস্ময় প্রকাশ করেছে বিশ্ববাসী।

দক্ষতার সঙ্গে করোনা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণসহ জীবন ও জীবিকা সচল রাখায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী ফোর্বস ম্যাগাজিনসহ আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রশংসা করা হয়েছে। দেশে বর্তমানে সার্বিক করোনা পরিস্থিতি সহনীয় ও স্থিতিশীল থাকলেও ভবিষ্যতে বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের করোনাবিষয়ক তথ্যসমূহ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২০ সালে সংক্রমণের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা শুরু হয় এপ্রিলে। জুন পর্যন্ত সংক্রমণ উঠতে থাকে। জুলাই থেকে নিম্নমুখী প্রবণতা শুরু হয়। আগস্ট, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর পর্যন্ত নিম্নমুখী থেকে নভেম্বরে আবার কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা শুরু হয়ে ডিসেম্বরে আবার কমতে শুরু করে। ২০২১ সালের জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি একেবারেই কমে গিয়ে মার্চে উর্ধ্বমুখী প্রবণতা শুরু হয়। এপ্রিলে অনেক বেড়ে যায়।

মে মাসে কমে আবার জুন মাসে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা জুলাই পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। আগস্টে কমতে শুরু করে নভেম্বর পর্যন্ত কমে ডিসেম্বরের শেষের দিকে কিছুটা বাড়তে শুরু করে। আর ২০২২ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ থেকে অবনতি ঘটতে থাকে দেশের করোনা পরিস্থিতির। তবে এই অবনতি বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকে দেশের করোনা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটতে শুরু করে, যা ৭ই মার্চ পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে।

গতকাল সোমবার দুপুরে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যানভিত্তিক ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডোমিটারের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিশ্বের করোনা আক্রান্ত দেশগুলোর মধ্যে রোগী শনাক্তকরণে সফলতা পেয়েছে বাংলাদেশ। মোট করোনা রোগী শনাক্তকরণে সক্ষমতা দেখানোর বিবেচনায় পূর্বের ৪৮তম থেকে উন্নতি ঘটিয়ে সামনে ৪১তম স্থানে চলে এসেছে বাংলাদেশ। মোট পরীক্ষিত নমুনা সংখ্যা বৃদ্ধির বিবেচনায় দুই ধাপ সামনে ৪৯তম স্থানে এসেছে।

দুই সপ্তাহের ব্যবধানে বাংলাদেশ বিশ্বে মোট সুস্থতার ভিত্তিতে চল্লিশটি ধাপ এগিয়ে ২৭তম স্থানে এসেছে, যা দুই সপ্তাহ আগেও ছিল ৬৭তম স্থানে। মোট শনাক্তকৃত করোনা রোগী, রোগী শনাক্তরণে সক্ষমতা এবং মোট সুস্থ হওয়া করোনা রোগীর সংখ্যার বিবেচনায় অবস্থান যত বেশি সামনে যাবে, তত বেশি উন্নতি বোঝাবে।

আর দুই সপ্তাহের ব্যবধানে মোট মৃতের সংখ্যার ভিত্তিতে তিন ধাপ পেছিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বে ৩১তম এবং দৈনিক মৃতের সংখ্যার ভিত্তিতে ২২টি ধাপ পিছিয়ে ২৯তম স্থানে চলে এসেছে। দুই সপ্তাহ আগেও বাংলাদেশ মোট মৃতের সংখ্যার ভিত্তিতে বিশে^ ২৮তম এবং দৈনিক মৃতের সংখ্যা ৫১তম স্থানে ছিল। এখানে অবস্থান যত বেশি পেছনে যেতে থাকবে তত বেশি উন্নতি বোঝাবে।

সম্পর্কের অগ্নিপরীক্ষা

বিশেষজ্ঞরা বলেন, দেশে প্রথমবার করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর প্রায় এক বছর ধরে দেশজুড়ে বিরাজ করে করোনা আতঙ্ক। করোনায় আক্রান্ত হলেই সেই রোগী হয়ে পড়ে অসহায় ও একাকী। চলে সম্পর্কের অগ্নিপরীক্ষা। মৃত্যু আতঙ্কে করোনা রোগীর সংস্পর্শে যেতে সাহস করেনি মানুষ। রক্তের সম্পর্কও এই সাহস যোগাতে পারেনি। করোনা আক্রান্ত স্বামীর পাশে ছিলেন না স্ত্রী এবং স্ত্রীর পাশে ছিলেন না স্বামী। পিতা-মাতার সঙ্গে ছিলেন না সন্তানেরা।

এককথায় করোনা রোগী যেন আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও শুভাকাক্সক্ষীদের কাছেও হয়ে ওঠেন মৃত্যু আতঙ্ক। তবে এমন পরিস্থিতি এমনি এমনি সৃষ্টি হয়নি। শুরু দিকের সেই সময় থেকেই অনেকের মনে এমন একটা ধারণা প্রতিষ্ঠা হয়ে গিয়েছিল, এ রোগের কোনো চিকিৎসা নেই। একসময় কারো কারো ধারণা হয়ে গেল, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলেই অক্সিজেন নিতে হবে, লাইফ সাপোর্ট মেশিনে দিতে হবে, ভর্তি হতে হবে আইসিইউতে। এ রোগে মৃত্যু যেন অবধারিত। প্রিন্ট মিডিয়া, ইলেকট্রনিক মিডিয়া কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নানা খবর, নানা ‘আপডেট’ নিতে নিতে মানুষের মনে সৃষ্টি হয়েছিল ভীতি।

এলোমেলো স্বাভাবিক জীবন

বিশেষজ্ঞরা বলেন, কারণ যেটাই হোক, দ্বিতীয় ঢেউ পর্যন্ত করোনার সংক্রমণ নিয়ে অতিরিক্ত ভয় ব্যাঘাত ঘটিয়েছে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে। কেউ হয়ে পড়েন গৃহবন্দি, প্রয়োজনেও বের হতে চান না ঘর থেকে, পরিবারের সদস্যদেরও আটকে রাখেন ঘরে। তার নিষেধ অমান্য করে কেউ বাইরে গেলে বাঁধিয়ে ফেলেন লঙ্কাকাণ্ড।

কারো হয়তো হাত ধোঁয়াটা হয়ে গিয়েছিল প্রয়োজনের থেকে অতিরিক্ত, যা মানসিক অসুস্থতার লক্ষণ। কেউ আবার দরজার হাতল ঠিকভাবে স্পর্শই করেননি। আতঙ্ক ছিল যে, কোনো বস্তু স্পর্শ করলেই ভাইরাস ঢুকে যাবে শরীরে। বাইরে থেকে আনা জিনিসকে বারবার স্যানিটাইজারের সাহায্যে পরিষ্কার করে হয়ে পড়েন ক্লান্ত।

লকডাউন

করোনা প্রতিরোধে চলে লকডাউন খেলা। করোনার সুবাদে ভিন্ন মাত্রা পায় ‘লকডাউন’ শব্দটি। করোনা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে জোনভিত্তিক লকডাউন শুরু করেও শেষ করতে পারেনি সরকার। করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকির মাত্রা অনুযায়ী সরকার রেড, ইয়েলো ও গ্রিন- এই তিনটি জোনে চিহিৃত করে। বেশি আক্রান্ত এলাকাকে রেড, অপেক্ষাকৃত কম আক্রান্ত এলাকাকে ইয়োলো ও একেবারে কম আক্রান্ত বা আক্রান্তমুক্ত এলাকাকে গ্রিন জোন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

সরকারি উদ্যোগসমূহ

২০২০ সালের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার অনেক আগে থেকেই বিশ্ব পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে করোনা প্রতিরোধ ও মোকাবিলায় নানা কর্মসূচি গ্রহণ করে সরকার। করোনা শনাক্তকরণের পরিধি বাড়ানোর পাশাপাশি বিস্তার ঘটানো হয় করোনা রোগীদের চিকিৎসাসেবা প্রদানের অবকাঠামোর।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, করোনা মোকাবিলায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে এ পর্যন্ত মোট ৪০টি কমিটি গঠিত হয়েছে। দেশের ৪৩টি মন্ত্রণালয়ের প্রতিটির রয়েছে করোনা মোকাবিলাবিষয়ক একাধিক কমিটি ও কর্মসূচি বলে জানায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রসমূহ জানায়, দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা এবং পাবলিক পরীক্ষা স্থগিত করে সরকার। অনলাইন, টেলিভিশনের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। চিকিৎসক-নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রশাসনসহ করোনা যুদ্ধে ফ্রন্ট লাইন যোদ্ধাদের জন্য পিপিই-মাস্কসহ স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী নিশ্চিত করা হয়। টেস্টিং কিট আমদানি, দেশের বিভিন্ন স্থানে ল্যাব স্থাপনসহ পরীক্ষার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করা হয়।

করোনা মোকাবিলার ফ্রন্টলাইন যোদ্ধাদের জন্য ৫-১০ লাখ টাকার স্বাস্থ্যবিমা এবং এর ৫ গুণ জীবন বিমা ঘোষণা করা হয়। ২ হাজার ডাক্তার ও ৫ হজার ৫৪ জন নার্স নিয়োগ। স্বাস্থ্যবিষয়ক পরামর্শের জন্য ৩টি হটলাইন (১৬২৬৩; ৩৩৩ ও ১০৬৫৫) চালু করা হয়। করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিভাগ, জেলা, উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিটি গঠন করা হয়। ভিডিও কনফারেন্সিংয়ে সংযুক্ত হয়ে জেলার কর্মকর্তাদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলা এবং প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।

প্রধানমন্ত্রী সংকট মোকাবিলায় ১ এপ্রিল ৩১টি, ১৬ এপ্রিল ১০টি, ২০ এপ্রিল ১৩টি এবং ২৭ এপ্রিল ১০টি নির্দেশনা দেন। করোনা পরিস্থিতিতে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতিকে চাঙা রাখতে ১৯টি প্যাকেজে ১ লাখ ৩ হাজার ১১৭ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়। যা জিডিপির ৩.৭ শতাংশ। ৫০ লাখ মানুষের জন্য রেশন কার্ড করা আছে যারা ১০ টাকায় চাল পান। নতুন আরো ৫০ লাখ রেশন কার্ড দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।

অবনতির শঙ্কা কাটেনি, মানতে হবে স্বাস্থ্যবিধি

দেশের করোনা পরিস্থিতির অবনতির শঙ্কা কেটে যায়নি বলে সতর্ক করে দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, দেশে বর্তমানে করোনা পরিস্থিতি স্থিতিশীল রয়েছে। তা সত্ত্বেও সবাইকে মাস্ক পরতে হবে, মেনে চলতে হবে স্বাস্থ্যবিধি। এখনই মাস্ক খুলে ফেলার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

গত রোববার করোনা পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত অনলাইন বুলেটিনে এ সতর্কবার্তা দেন অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ বিভাগের প্রধান ও অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন। তিনি বলেন, কোভিড পরিস্থিতি বর্তমানে অনেকটা স্বাভাবিক পর্যায়ের কাছাকাছি নিয়ে আসতে পেরেছি। এই প্রথম চলতি বছরে দুই থেকে তিন শতাংশের ঘরে রয়েছে শনাক্তের হার। এভাবে যদি সংক্রমণ কমতে থাকে তাহলে অচিরেই আমরা দুই শতাংশের নিচে চলে আসতে সক্ষম হবে বলে আশাবাদী।

স্বাস্থ্যবিধি মেনে বলা এবং মাস্ক ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দিয়ে অধ্যাপক রোবেদ আমিন বলেন, কিন্তু ভাইরাসের মিউটেশন হচ্ছে, ভাইরাসের এখনো ইভালুয়েশন হচ্ছে। আবারও নতুন করে কোনো ভ্যারিয়েন্ট আসবে কি না সে শঙ্কাটা থেকেই যাচ্ছে। ওমিক্রনের যেসব নতুন নতুন উপধরন বিএ.২ বা অন্য কিছু, তা চলে আসার আশঙ্কা থাকবে। আমাদের যেসব রিস্কি গ্রুপ আছে-ডায়াবেটিস, হাইপার টেনশন, ক্যানসারের রোগী তাদের ক্ষেত্রে ওমিক্রনও সিরিয়াস হতে পারে।

অধ্যাপক রোবেদ আমিন আরো বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে বলতেই হবে। বাইরে বের হলে ন্যূনতম মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। বিশে^র অনেক দেশ এখনো করোনায় জর্জরিত। বিশে^ দৈনিক সাত থেকে আট হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটছে। আক্রান্ত হচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। এমন পরিস্থিতিতে সাবধানতা অবলম্বনের বিকল্প নেই।

মন্তব্য

Beta version