-->
শিরোনাম
লাশকাটা ঘরের গল্প শেষ পর্ব

ঘুমঘোরে শোনেন নারীর কান্নার শব্দ

রুদ্র মিজান
ঘুমঘোরে শোনেন নারীর কান্নার শব্দ
প্রতীকী ছবি

কান্নার শব্দ। গুমড়ে গুমড়ে কাঁদছেন এক নারী। নানা অভিযোগ করছেন। তার বাঁচার ইচ্ছা ছিল খুব। কিন্তু স্বামী, শ^শুরবাড়ির লোকজনের মানসিক অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে টিকতে পারেননি দুনিয়ায়। নারীর মুখটি অস্পষ্ট। দিনে লাশকাটা ঘরে দেখা নিথর দেহের সেই নারীর মতো প্রায়। গভীর রাতে এমন স্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙে শ্যামল চন্দ্রগুপ্তের। শরীর দিয়ে ঘাম বের হয়। তারপর বেশ কিছুদিন ধরে লাশকাটা ঘরমুখো হননি তিনি।

এই স্বপ্ন দেখার আগের দিন গিয়েছিলেন লাশকাটা ঘরে। পুরান ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরাজীর্ণ এই ঘরে ছিল দুটি লাশ। একজন মহিলা ও একজন পুরুষের। ভেতরের কক্ষে কাটা ছেঁড়া করে ডোমরা। পাশে দাঁড়িয়ে লাশটি দেখেছিলেন তারুণ্য ছুঁই ছুঁই শ্যামল চন্দ্রগুপ্ত। তখন বাবার সঙ্গে মর্গে গিয়েছিলেন তিনি। শ্যামলের বাবা মর্গ সহকারী হিসেবে কাজ করতেন। সেদিন বাসায় ফেরার পর রাতে স্বপ্ন দেখে জেগে উঠেন। আর ঘুম হয়নি। বারবার লাশের কথা মনে হচ্ছিল। সেই নারীর মুখটি ভাসছিল। একজন প্রাণবন্ত মানুষ মুহূর্তেই কীভাবে লাশ হয়ে গেলেন। নিজেই কেন নিজেকে হত্যা করলেন। এসব ভাবছিলেন খুব। অবশ্য এই ভাবনা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। কয়েক দিনের মধ্যেই সব ভুলে যান। নতুন করে যাতায়াত শুরু করেন মর্গে।

তবে প্রথম যেদিন মর্গে যান সেদিন কয়েকবার বমি করেছিলেন তিনি। লাশ কাটাঘরের চারদিকে উৎকট, অসহ্য গন্ধ। এরই মধ্যে স্বাভাবিকভাবে কাজ করছেন ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসক, শিক্ষার্থী ও ডোমরা। একইভাবে লাশকাটা ঘরের বারন্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন মৃত ব্যক্তিদের স্বজনরা। উৎকট গন্ধ সহ্য করেই তারা ছিলেন। নিয়মিত যারা যান তাদের কাছে অভ্যস্ত হয়ে গেছে এসব।

২০০২ সালে মর্গে কাজ শুরু করেন শ্যামল চন্দ্রগুপ্ত। দীর্ঘ সময়ে লাশকাটার অনেক অভিজ্ঞতা তার। কিন্তু লাশ কাটা-ছেঁড়া, ডোম... এসব নিয়ে কথা বলতে চান না শ্যামল। তিনি জানান, কাজটি ভালো। ডোমরা যেমন করেন, একই কাজ ডাক্তাররাও করেন। কিন্তু মানুষ ডোমদের এখনো ইতিবাচকভাবে দেখে না। এই দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই নিজের পেশা, জীবনযাপন নিয়ে কথা বলতে আগ্রহী নন তিনি। উত্তরাধিকার সূত্রে ডোম হিসেবে কাজ করেন তিনি। তার পরিবারে আর কেউ এই পেশা বেছে নেননি।

জানা গেছে, বুড়িগঙ্গরা তীরে অবস্থিত স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বা মিডফোর্ট হাসপাতালটি ১৮৫৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিদিন চার থেকে পাঁচটি লাশ পাঠানো এই হাসপাতালের মর্গে। কিন্তু বিস্ময়ের বিষয় হচ্ছে সরকারি কোনো ডোম নেই গুরুত্বপূর্ণ এই হাসপাতালে। ২০০৭ সালে হাসপাতালের অ্যানাটমি বিভাগে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মচারী শ্যামলকে দিয়েই চালানো হচ্ছে ডোমের কাজ। তার সঙ্গে কাজ করেন আরো দুজন। নিয়োগ না থাকায় সরকারি বেতন নেই অন্যদের। মৃতদের স্বজনরা খুশি হয়ে ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা দেন। এই টাকাতেই চলে তাদের সংসার।

স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে গিয়ে দেখা গেছে, লাশগুলো সেখানে সংরক্ষণ করতে বেগ পেতে হয় সংশ্লিষ্টদের। সংরক্ষণের জন্য দুটি ফ্রিজ থাকলেও তা অকেজো। এজন্য ডোমদের বিপাকে পড়তে হয়। বিকালের পর ময়নাতদন্ত হয় না। লাশকাটা বন্ধ। রাতভর তখন লাশ পড়ে থাকে মর্গে। লাশ পাহারা দেওয়ার জন্য কেউ থাকেন না তখন। অনেক সময় লাশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মর্গে রয়েছে ইঁদুর ও বেজির উৎপাত। এজন্য মৃতদের স্বজনরা অনেক সময় ডোমদের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করেন। কিন্তু এক্ষেত্রে তারা অসহায়।

স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সোহেল মাহমুদ বলেন, লাশ সংরক্ষণের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। বিষয়টি দ্রুত সমাধান হবে বলে আশা করি। তাছাড়া লাশ পাহারার জন্য মর্গে পুলিশ নিয়োগ করা যেতে পারে। মর্গের সঙ্গে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ছাড়াও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পৃক্ত বলে জানান তিনি। ডোমদের বিষয়ে ডা. সোহেল মাহমুদ বলেন, এখানে কোনো ডোম নেই। যারা ডোম হিসেবে কাজ করেন তাদের সরকারি কোনো বেতন নেই। বিষয়টি অমানবিক। ডোম নিয়োগের বিষয়ে তাদের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে বলে জানান তিনি।

মন্তব্য

Beta version