# নামমাত্র বেড দিয়ে বেশি ফি আদায় # ঘণ্টা হিসাবে চিকিৎসক ভাড়া করা হয় # ওষুধের নামে চলে অস্বাভাবিক টাকা আদায় # আইসিইউ চিকিৎসাসেবা সীমিত
দেশের বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের (আইসিইউ) মান এবং উচ্চ মুনাফা আদায় নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা দীর্ঘদিনের। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, সংকটাপন্ন রোগীকে সব রকমের সাপোর্ট দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনাই এই ব্যবস্থাার মূল লক্ষ্য।
কিন্তু জীবনরক্ষার এই চিকিৎসাসেবা নিয়েও চলে অমানবিক ও উচ্চ মুনাফার ব্যবসা। প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সুবিধা ও উপকরণ ছাড়াই উচ্চ ফি আদায় করার ঘটনা ঘটছে অহরহ। আইসিইউ চিকিৎসাসেবা নিয়ে ধারণা নেই অধিকাংশ মানুষের।
আইসিইউ কক্ষে প্রবেশে থাকে নিষেধাজ্ঞা। দায়িত্বরত চিকিৎসক ও নার্সদের কাছ থেকেই রোগীর অবস্থাা সম্পর্কে জেনে নিতে হয়। এ সুযোগে চলে অবৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জন। রোগীর পরিবার হয়ে পড়ে নিঃস্ব।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমনিতেই দেশে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ) চিকিৎসা সুবিধা খুবই সীমিত। দেশের চার ভাগের তিন ভাগ সরকারি হাসপাতালে এ চিকিৎসা সুবিধা নেই। প্রয়োজনের সময় আইসিইউ চিকিৎসা সুবিধা না পেলে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে অনেক রোগী।
অনেক প্রাইভেট হাসপাতালে এ চিকিৎসা সুবিধা থাকলেও তা ব্যয়বহুল। গরিব রোগীর পক্ষে আকাশচুম্বী এ চিকিৎসা ব্যয় বহন করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। অনেক বেশি চিকিৎসা ফি আদায় করছে অনেক বেসরকারি হাসপাতাল।
সার্বক্ষণিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক থাকেন না এসব হাসপাতালে। সরকারি হাসপাতাল থেকে চিকিৎসক ডেকে নিয়ে নামমাত্র আইসিইউ সেবার কাজ চালানো হয়। দেশের বেসরকারি হাসপাতালে এর মান তদারকিতে বহুবার মাঠে নেমেছে স্বাস্থ্যা অধিদপ্তরের বিশেষ মনিটরিং টিম। কিন্তু থামেনি অসাধুচক্রের অবৈধ ব্যবসা।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানান, আইসিইউতে জটিল ও মুমূর্ষু রোগীকে রেখে বিশেষ ব্যবস্থাায় চিকিৎসা করা হয়। মানব শরীরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কিডনি, লিভার, ফুসফুস ও মস্তিষ্ক বিকল হয়ে গেলে তখন আইসিইউতে রেখে বিশেষ কিছু যন্ত্রের সাহায্যে এগুলো সচল করা যায়। বড় কোনো সার্জারি বা অপারেশনের পর কিছু রোগীর দরকার হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানেসথেসিয়া, অ্যানালজেসিয়া অ্যান্ড ইনটেনসিভ কেয়ার মেডিসিনের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানান, আইসিইউতে রোগীকে ওঠানামা, কাত করানোসহ বিভিন্ন অবস্থাানে রাখার জন্য বিশেষায়িত শয্যার দরকার।
প্রত্যেক রোগীর জন্য পৃথক ভেন্টিলেটর ও কার্ডিয়াক মনিটর, ইনফিউশন পাম্প দরকার। শক মেডিশন, সিরিঞ্জ পাম্প, ব্লাড ওয়ার্মার থাকবে। পাশাপাশি কিডনি ডায়ালাইসিস মেশিন, আল্ট্রাসনোগ্রাম, এবিজি মেশিন থাকতে হবে। জরুরি পরীক্ষার জন্য আইসিইউসির সঙ্গে একটি পরীক্ষাগার থাকাও আবশ্যক বলে জানান বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।
কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের ক্রিটিক্যাল কেয়ার মেডিসিন বিভিাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান জানান, আইসিইউ দরকার পড়ে তাদের, যাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের হার প্রতি মিনিটে ৩০-এর বেশি হচ্ছে; রক্তে অক্সিজেনের ঘনত্ব বা স্যাচুরেশন শতকরা ৯৩ ভাগের নিচে নেমে এসেছে এবং রোগীর অক্সিজেনের চাহিদা ধীরে ধীরে বাড়ছে।
রোগীর আঙুলে পাল্স অক্সিমিটার নামের একটি যন্ত্র লাগিয়ে কিংবা ল্যাবরেটরিতে রক্তের এবিজি করে এর মাত্রা নিরূপণ করা সম্ভব। যাদের আগে থেকেই ফুসফুসের বা শ্বাসযন্ত্রের বিভিন্ন অসুখ রয়েছে যেমন অ্যাজমা, সিওপিডি।
এ ছাড়া যারা ধূমপায়ী ও যাদের দীর্ঘদিন থেকে ডায়াবেটিস আছে- তাদেরও শারীরিক অবস্থাার দ্রুত অবনতি ঘটতে পারে। তাদের আইসিইউ লাগতে পারে।
ঢাকা কমিউনিটি মেডিকেল কলেজের অ্যানেসথেসিওলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. শাহেরা খাতুন জানান, আইসিইউ বা নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র হাসপাতালের একটি বিশেষায়িত বিভাগ।
এখানে জটিল রোগীর চিকিৎসা করা হয়। অ্যানেসথেসিয়া বিষয়ের যে পাঁচটি স্তম্ভ রয়েছে- এর মধ্যে একটি হলো আইসিইউ। আমাদের শরীরে তো অনেক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কাজ করে, যেমন-কিডনি, লিভার, হার্ট, ফুসফুস, মস্তিষ্ক।
এর মধ্যে তো হার্ট ও ফুসফুসের তুলনা হয় না। কোনো কারণে যদি এই অঙ্গগুলো বিকল হয়ে যায়, কাজ করতে না পারে, তখন বিশেষ যন্ত্রের সহযোগিতায় আমরা ওই অঙ্গগুলো সচল করতে পারি।
সচল করার জন্য ওই রোগীদের সাধারণ ওয়ার্ডে রাখা সম্ভব নয়। তখন তাদের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে নেওয়া হয়। আইসিইউ মানে কিন্তু এই নয় যে তাকে কৃত্রিমভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
এই যে পাঁচ/ছয়টি অঙ্গের কথা বললাম, এর মধ্যে একটি খারাপ হয়ে গেলেই তার আইসিআইর সহযোগিতার প্রয়োজন হয় বলে জানান অধ্যাপক ডা. শাহেরা খাতুন।
একজন আইসিইউ রোগীর চিকিৎসাব্যয় ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে। সরকারি হাসপাতালে নামমাত্র খরচেই ভর্তি টিকিট বাবদ ১০ টাকাতেই মিলছে আইসিইউসহ বাকি সব চিকিৎসা।
আর বেসরকারি হাসপাতালে লাগছে হাজার হাজার টাকা। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন মো. সাইফুল আযম (৪৩)। শ্বাসজনিত সমস্যায় আক্রান্ত শ্বশুরকে নিয়ে শুরুতে ভর্তি হয়েছিলেন রাজধানীর এশটি বেসরকারি হাসপাতালে।
রোগীর অবস্থাা কিছুটা অবনতি ঘটলে আইসিইউতে নেওয়ার কথা বলা হয়। কিন্তু খরচ সম্পর্কে জানতে চাইলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, দুই সপ্তাহে কমপক্ষে ১০-১৫ লাখ টাকা বিল আসতে পারে, যা ব্যবস্থাা করা তাদের জন্য অনেকটাই দুরূহ।
অবশেষে রোগীকে নিয়ে চলে আসেন মহাখালী ডিএনসিসি মার্কেটে নির্মিত করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে। মাত্র ১০ টাকাতে রোগীকে ভর্তি করে আইসিইউ সেবা পাচ্ছেন তিনি একেবারেই বিনামূল্যে।
এ বিষয়ে মো. সাইফুল আযম ভোরের আকাশকে বলেন, শ্বশুরের চিকিৎসার জন্য মাত্র ১০ টাকায় ডিএনসিসির কোভিড হাসপাতালে আইসিইউ বেড পেয়েছি।
প্রাইভেট হাসপাতালে জানিয়েছিল, প্রতিদিন অন্তত ৫০ হাজার টাকা খরচ হবে এবং দুই সপ্তাহের জন্য রাখা লাগতে পারে। এর ওপর নানা খরচ তো আছেই। মানে হলো, অন্তত ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকার ব্যাপার।
তিন দিন প্রাইভেট মেডিকেলে থেকে প্রতিদিন গড়ে ১৫ হাজার টাকার ওষুধের বিল দিতে হয়েছে। কিন্তু ডিএনসিসির হাসপাতালে বেশিরভাগ ওষুধই তারা দিচ্ছে। আমাদের কিনে দিতে হচ্ছে ৪শ-৫শ টাকার ওষুধ।
সাইফুল আযম আরো বলেন, আমাদের মতো মানুষ করোনা আক্রান্ত হয়ে পরিস্থিাতি জটিল হলে সরকারি চিকিৎসাসেবা না পেলে বিনাচিকিৎসায় মরতে হবে। এর চিকিৎসাব্যয় জোগাড় করা আমাদের মতো মানুষদের পক্ষে দুঃসাধ্য। ফলে করোনা থেকে দূরে থাকার চেষ্টাই চলমান মহামারি মোকাবিলায় আমাদের মূল কৌশল হওয়া উচিত।
গণস্বাস্থ্যোর ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ভোরের আকাশকে বলেন, রোগী আইসিউতে থাকলে খরচ বেশি আসবে এটা স্বাভাবিক।
তবে তিনি বলেন, বেসরকারি হাসপাতালে একদিনে আইসিইউর বিল ৪০ হাজারের বেশি আসার কথা না। তার বেশি হলে এটা প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়। সরকারকে এ বিষয়ে অবশ্যই নজর দেওয়া উচিত।
মন্তব্য