মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার হয়ে সংকটাপন্ন মো. সাইফুল আলম (৩৪)-এর জীবন। ময়মনসিংহের ধোবাউড়া থানাধীন মনসাপাড়া গ্রামে তার বাড়ি। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকেরা তাকে রেফার করেন জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপতাল)। ‘অ্যাম্বুলেন্স ’লেখা দেখেই রোগীকে তোলায় হয় গাড়িতে। মাঝপথে দেখা দেয় রোগীর শ্বাসকষ্ট। কিন্তু সচল ছিল না অক্সিজেন মাস্ক। শুরু হয় অ্যাম্বুলেন্সের চালক ও রোগীর লোকজনের মধ্যে তুমুল ঝগড়া। উপায় না দেখে জরুরি চিকিৎসাসেবা দিতে রোগীকে ভর্তি করানো হয় গাজীপুরের শ্রীপুরের একটি বেসরকারি ক্লিনিকে। এভাবে শুধু মো. সাইফুল আলম নন, প্রতিদিন অসংখ্য অসহায় রোগী মানহীন ও অনুমোদনহীন অ্যাম্বুলেন্সে উঠে জীবনঝুঁকিতে পড়ছেন। ন্যূনতম জরুরি চিকিৎসাসেবা না থাকায় মাঝপথে রোগী মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে আছে ‘অ্যাম্বুলেন্স ব্যবহার নীতিমালা’-এর খসড়া। এ সুযোগে অসাধু চক্রের সদস্যরা রুট পারমিট দিয়েই সাধারণ মাইক্রোবাস বা জিপ ব্যবহার করছে ‘অ্যাম্বুলেন্স ’ হিসেবে। অ্যাম্বুলেন্স ও চিকিৎসাসেবার বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কিন্তু দেশের অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসের সঙ্গে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কোনো যোগসূত্র নেই। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে নিতে হয় না কোনো অনুমোদন। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) লাইসেন্স নিয়ে লোক দেখানো কিছু মেডিকেল যন্ত্রণাংশ সংযোজন করে ‘অ্যাম্বুলেন্স’ পরিচয় দিয়ে ঠেলে দেওয়া হয় রাস্তায়। দেশের অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসাও নেই সরকারি নিয়ন্ত্রণে। এ সুযোগে আধুনিক চিকিৎসা উপকরণ ছাড়াই শত শত অ্যাম্বুলেন্স রাস্তায় নামছে। অ্যাম্বুলেন্স বিষয়ে সাধারণ মানুষের অনভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে অবাধে চলছে রমরমা অ্যাম্বুলেন্স বাণিজ্য।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম সাংবাদিকদের বলেন, মানহীন ও ভুয়া অ্যাম্বুলেন্স কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য মেনে নেওয়া যায় না। সংকটাপন্ন রোগীকে জরুরি চিকিৎসাসেবার সুযোগসুবিধা অবশ্যই একটি মানসম্মত অ্যাম্বুলেন্সে থাকতে হবে বলে জানান মহাপরিচালক।
রাজধানীর অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসা
শুধুমাত্র ঢাকার অভ্যন্তরে সার্ভিস দিয়ে থাকে এমন প্রতিষ্ঠানগুলো হলো হৃদরোগ হাসপাতাল অ্যাম্বুলেন্স, ঢাকা মেডিকেল অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস, আদ-দ্বীন অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস, সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস, মেডিনোভা মেডিকেল সার্ভিস লি.-এর অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস।
আর ঢাকা মহানগর অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমবায় সমিতি লিমিটেডের তত্ত্বাবধানে রয়েছে ২০০টি প্রতিষ্ঠান এবং তাদের মোট অ্যাম্বুলেন্সের সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন হাজার। স্কয়ার হাসপাতাল অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস, লাশবাহী ফ্রিজার ভ্যান (জাপান-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল), কার্ডিয়াক অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস, আলিফ অ্যাম্বুলেন্স ও আল মারকাজুল ইসলাম অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসের অ্যাম্বুলেন্সগুলো ঢাকাসহ সারাদেশে রোগী ও লাশ পরিবহনে সেবা দিয়ে থাকে।
এছাড়া নামে-বেনামে রাজধানীজুড়ে ভাড়ায় চলে শত শত অ্যাম্বুলেন্স, সেগুলোর তালিকা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হাতে নেই। অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসের প্রতিষ্ঠানে গিয়ে বা নির্ধারিত ফোন নম্বরে ফোন করে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করা যায়। ফোন করে ঠিকানা জানালে অ্যাম্বুলেন্স পৌঁছে যায়। যেকোনো সময়ই অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করা যায়। এই প্রতিষ্ঠানগুলো রোগীদের সেবায় ২৪ ঘণ্টাই সার্ভিস দিয়ে থাকে। হরতাল, অবরোধ ও অন্যান্য সরকারি ছুটির দিনগুলোতে ভাড়ার হারের কোনো তারতম্য হয় না।
বিআরটিএর লাইসেন্স নিলেই হয়ে যাচ্ছে অ্যাম্বুলেন্স
অ্যাম্বুলেন্স শব্দটির সঙ্গে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার বিষয়টি জড়িত থাকলেও অ্যাম্বুলেন্স পরিচালনাকারীদের সঙ্গে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কোনো যোগসূত্র নেই। দুই বছর আগে শুরুতে দেশের সকল সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে অ্যাম্বুলেন্সের তালিকা পাঠানোর নির্দেশ দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সেই প্রেক্ষিতে কিছু সংখ্যক প্রতিষ্ঠান অ্যাম্বুলেন্সের সংখ্যা ও গাড়ির নম্বর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে জমা দিয়েছে বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে আদ-দ্বীন ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) তারেকুল ইসলাম মুকুল ভোরের আকাশকে জানান, এই প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে বর্তমানে রয়েছে ৬০টি অ্যাম্বুলেন্স। সব কটি নন এসি। প্রতিটি গাড়ির জন্য বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ)-এর কাছ থেকে লাইসেন্স নেওয়া রয়েছে। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই।
রোগীবাহী একটি অ্যাম্বুলেন্সে যা যা থাকা দরকার
চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা জানান, অ্যাম্বুলেন্স কখনো প্রাইভেটকার বা যাত্রীবাহী গাড়ি হতে পারে না। অ্যাম্বুলেন্সের সঙ্গে রোগীর একটা যোগসূত্র রয়েছে। চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত রোগীকে সাময়িক কিছু চিকিৎসাসেবা দেওয়ার দায়িত্বও অ্যাম্বুলেন্সের ওপর বর্তায়। আর অ্যাম্বুলেন্স মানে শুধু সুন্দর গাড়ি (কার) হলেই চলবে না। এখানে থাকবে আইসিইউর প্রয়োজনীয় সব চিকিৎসা উপকরণ। প্রশিক্ষিত ডাক্তার, নার্স ও জীবন রক্ষাকারী ওষুধও থাকতে হবে। আর এসব সুবিধা থাকলেই একজন মুমূর্ষু রোগীকে হাসপাতালে আনার সময় পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব। এ দেশে জরুরি চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়েই এখন পর্যন্ত কোনো নীতিমালা নেই। আর এটা না থাকায় অ্যাম্বুলেন্স পরিচালনায় কোনো নীতিমালা হচ্ছে না। অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসায়ীদের কাছে মানুষের জীবনের চেয়ে টাকাই মুখ্য হয়ে ওঠে। এ সুযোগে এখন রেন্ট এ কারের মতোই অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবসা চলছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইমার্জেন্সি অ্যান্ড ক্যাজুয়ালটি বিভাগের আবাসিক সার্জন ডা. এইচ এ নাজমুল হাকিম জানান, অনেক সময় রোগীকে তাৎক্ষণিক হাসপাতালে নেওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। হাসপাতাল ও রোগীর অবস্থানের দূরত্ব বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সেক্ষেত্রে ইমার্জেন্সি মেডিকেল সার্ভিসের মধ্যে আগে হচ্ছে প্রি-হসপিটাল কেয়ার। এরপর হসপিটাল কেয়ার। রোগীকে হাসপাতালে প্রবেশ করানোর আগের চিকিৎসাটুকু খুবই জরুরি। এটার অভাবে বছরে অনেক লোকের মৃত্যু ঘটে। তিনি আরো বলেন, একটি অ্যাম্বুলেন্সে ভেনটিলেটর, অক্সিজেন, কার্ডিয়াক মনিটর, ইমার্জেন্সি ড্রাগসহ অন্যান্য জীবন রক্ষাকারী উপকরণসহ আইসিইউ (ইনসেনটিভ কেয়ার ইউনিট) থাকা জরুরি। কিন্তু দেশের কিছু অ্যাম্বুলেন্সে এসব সুবিধা থাকলেও বেশির ভাগ অ্যাম্বুলেন্সেই নেই বলে জানান ডা. এইচ এ নাজমুল হাকিম।
স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ ভোরের আকাশকে বলেন, মুমূর্ষ রোগীর জন্য মানহীন অ্যাম্বুলেন্স মোটেও নিরাপদ নয়। নজরদারি না থাকায় অ্যাম্বুলেন্স সেবার নামে চলছে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা। অথচ কিছু সাধারণ শর্ত মেনে স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি অ্যাম্বুলেন্সে রোগীর জন্য সব ধরনের সুযোগ সুবিধা থাকতে হয়। এর মধ্যে অ´িজেন সিলিন্ডার ও মাস্ক, স্ট্রেচার, জরুরি চিকিৎসা সরঞ্জাম, রোগীর শয্যা ও চিকিৎসক বসার ব্যবস্থা, লাইফ সার্পোটের ব্যবস্থা এবং কার্ডিয়াক মনিটর যার কোনো কিছুই নেই বেশির ভাগ অ্যাম্বুলেন্সে। অ্যাম্বুলেন্সে এসব সুযোগসুবিধা না থাকলে তা হয়ে উঠতে পারে মরণফাঁদ। এসব অ্যাম্বুলেন্সের ওপর বিআরটিএর দৃশ্যমান কোনো নজরদারি না থাকায় অ্যাম্বুলেন্স সেবা এখন বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে।
মন্তব্য