-->

জোড়া শিশুর অস্ত্রোপচারে বাংলাদেশের সাফল্য

নিখিল মানখিন
জোড়া শিশুর অস্ত্রোপচারে বাংলাদেশের সাফল্য
গত সোমবার রাতে সফল অস্ত্রোপচারের পর জোড়া শিশু লাবিবা-লামিসার জ্ঞান ফিরেছে। ছবি- সংগৃহীত

নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও জোড়া লাগা শিশু অস্ত্রোপচারে সফলতা পাচ্ছেন দেশের স্বনামধন্য চিকিৎসকেরা। মণি-মুক্তার হাতের টিউমার কেটে বাদ দেওয়া সম্ভব নয়- সাফ জানিয়ে দিয়েছিল সিঙ্গাপুরের নামকরা একটি হাসপাতাল। কিন্তু চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকরা। বেঁচে আছে মণি-মুক্তাসহ আরো অনেকে। গত সোমবার রাতে সফল অস্ত্রোপচারের পর জোড়া শিশু লাবিবা-লামিসার জ্ঞান ফিরেছে। হাসপাতালের বিছানায় একে অপরকে খুঁজছে তারা। আবার তারা বাবা-মায়ের কোলেও আসতে চাচ্ছে।

সফল অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে পৃথক হওয়ার পর সুস্থ শরীর নিয়ে বেঁচে আছে জোড়া শিশু তোফা-তহুরা, মণি-মুক্তা, রাবেয়া-রোকাইয়াসহ অনেকে। তবে সারাবিশ্বে অস্ত্রোপচারের পরও ৭০ শতাংশের বেশি জোড়া লাগা শিশুর মৃত্যু ঘটেছে। সফল অস্ত্রোপচারের পর নানা কারণে তাদের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকেরা। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম নয়।

গত সোমবার জোড়াশিশু লাবিবা-লামিসার অস্ত্রোপচারের বিশেষজ্ঞ দলের প্রধান ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক আশরাফ উল হক কাজল সংবাদ সম্মেলনে বলেন, জোড়া শিশুদের অস্ত্রোপচারের বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর ও ঝুঁকিপূর্ণ। সময় নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে অস্ত্রোপচার করার সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়নে নামতে হয় বলে জানিয়েছেন অধ্যাপক আশরাফ উল হক কাজল।

গতকাল মঙ্গলবার হাসপাতালের বিছানায় একে অপরকে খুঁজছে লাবিবা ও লামিসা। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে আলাদা হওয়া জোড়া শিশু লাবিবা-লামিসার বিষয়ে এসব কথাগুলো বলছিলেন তাদের বাবা লাল মিয়া। তিনি বলেন, সকাল থেকে তাদের পানি খাওয়ানো হচ্ছে। শুধু একে অপরের কাছে যেতে চাচ্ছে। আবার আমাদের কোলেও আসতে চাচ্ছে।

লাল মিয়া বলেন, আমাদের খুব ভালো লাগছে। গ্রামে খবর পৌঁছানো হয়েছে। সেখানে থাকা আত্মীয়-স্বজনরা খুব আনন্দে আছে। লাবিবা-লামিসাকে দেখার জন্য আগ্রহ নিয়ে বসে আছে। সবাই আমার লাবিবা-লামিসার জন্য দোয়া করবেন যেন সম্পূর্ণ সুস্থ করে গ্রামে ফিরতে পারি। ঢাকা মেডিকেলের পরিচালক থেকে শুরু করে চিকিৎসক নার্স সবাই আমার লাবিবা-লামিসার জন্য কষ্ট করেছেন।

গতকাল মঙ্গলবার শিশু পেডিয়াট্রিক সার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. আশরাফ উল হক কাজল বলেন, ভালো আছে লাবিবা-লামিসা। আজ তাদের দুজনকে পানি খাওয়ানো হয়েছে। এখন পর্যন্ত আইসিইউতে দুজন আলাদা বিছানায় আছে। আশা করি, দ্রুত তাদের কেবিনে শিফট করা হবে।

বেঁচে আছে তোফা-তহুরা, মণি-মুক্তা, রাবেয়া-রোকাইয়া

তোফা ও তহুরা একজন আরেকজনের শরীরের সঙ্গে জোড়া লাগানো অবস্থায় জন্ম নিয়েছিল। জন্মের পর এভাবেই ছিল ১০ মাস। ২০১৭ সালের ১ আগস্ট ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগের ২০ থেকে ২২ জন অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক চিকিৎসক ৯ ঘণ্টা যুদ্ধ করে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তাদের আলাদা করেন।

২০১৬ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ঝিনিয়া গ্রামে তোফা-তহুরার জন্ম হয়। মায়ের স্বাভাবিক প্রসবের মাধ্যমে জন্ম নেওয়া শিশু দুটির কোমরের কাছে জোড়া লাগানো ছিল। তাদের শরীরের অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আলাদা থাকলেও প্রস্রাব-পায়খানার রাস্তা ছিল একটি। যেভাবে জোড়া লেগে জন্ম নেয় শিশু দুটি চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় তাকে ‘পাইগোপেগাস’ বলা হয়। ২০১৬ সালের ৮ অক্টোবর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তোফা-তহুরার পায়ুপথ আলাদা করা হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ ধরনের অস্ত্রোপচারের ঘটনা এটাই প্রথম বলে জানান চিকিৎসকেরা।

এদিকে ঢাকা শিশু হাসপাতালে সফল অস্ত্রোপচারের পর বেঁচে আছে আরেকটি জোড়া শিশু মণি-মুক্তা। দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার শতগ্রাম ইউনিয়নের পালপাড়া গ্রামের শরৎচন্দ্র পালের ছেলে জয় প্রকাশ পাল।

জয় প্রকাশ পালের স্ত্রী কৃষ্ণা রানী পালের গর্ভে ২০০৯ সালের ২২ আগস্ট পার্বতীপুর ল্যাম্ব হাসপাতালে সিজারিয়ান সেকশনে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে মণি ও মুক্তা জোড়া লাগা অবস্থায় জন্ম নেয়। পরে রংপুরের চিকিৎসকরা ঢাকা শিশু হাসপাতালে নিয়ে যমজ বোনকে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে পৃথক করার পরামর্শ দেন। তাদের পরামর্শক্রমে ২০১০ সালের ৩০ জানুয়ারি ঢাকা শিশু হাসপাতালে মণি-মুক্তাকে ভর্তি করা হয়।

৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকা শিশু হাসাপাতালে শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. এ আর খানের সফল অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে মণি-মুক্তা ভিন্ন সত্তা লাভ করে। বাংলাদেশের চিকিৎসা বিজ্ঞানে সৃষ্টি হয় এক নতুন ইতিহাস।

আর ২০১৯ সালের ১ আগস্ট রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ৩৩ ঘণ্টা ধরে একটি বিরল অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে মাথা জোড়া লাগানো যমজ শিশু রাবেয়া ও রোকাইয়ার সফল অস্ত্রোপচার সম্পন্ন হয়। ২০১৬ সালের ১৬ জুলাই পাবনার চাটমোহরের আটলংকা গ্রামের রফিকুল ইসলাম ও তাসলিমা খাতুন দম্পতির ঘরে জোড়া মাথা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে যমজ শিশু রাবেয়া-রোকাইয়া।

মন্তব্য

Beta version