সরকারি হাসপাতাল

ব্যয়বহুল বিনামূল্যের চিকিৎসাসেবা!

* নামমাত্র চিকিৎসা ফি নেওয়ার কথা * অবৈধ আবদারে অসহায় রোগী * দেদারসে চলে মধ্যস্বত্বভোগীদের অনিয়ম

নিখিল মানখিন
ব্যয়বহুল বিনামূল্যের চিকিৎসাসেবা!
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। ফাইল ছবি

সরকারি হাসপাতালের বিনামূল্যের চিকিৎসাসেবা হয়ে উঠছে ব্যয়বহুল। অনেক সময় পার্থক্য থাকছে না সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যয়ের মধ্যে। এমন অভিযোগ তুলেছেন বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগী ও তাদের অভিভাবকেরা। তারা অভিযোগ করেন, কাগজে-কলমে সরকারি হাসপাতালে নামমাত্র চিকিৎসা ফি নেওয়া হয়ে থাকে। যা সবার জন্য সহনীয়। কিন্তু মধ্যস্বত্বভোগীদের অবৈধ আবদার মেটাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয় দরিদ্র রোগী ও তাদের স্বজনদের। চিকিৎসাসেবা গ্রহণের প্রতি পদে দেওয়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র টাকার সমষ্টি হাসপাতাল থেকে বিদায়বেলার হিসেবে হয়ে উঠে পাহাড়সম। মধ্যস্বত্বভোগীদের অনিয়ম ও রোগীদের জিম্মি করে অর্থ আদায় করার কারণেই সরকারি হাসপাতালের বিনামূল্যের চিকিৎসাসেবার সুনাম হয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ অনেকের।

বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, বিনামূল্যের চিকিৎসায় ফি দিতে হয় সরকারি হাসপাতালে। জরুরি বিভাগ থেকে রোগীশয্যা পর্যন্ত পৌঁছার চিকিৎসা ব্যয় (ট্রলিম্যান ও শয্যা জোগানদাতা) লিখিত থাকে না। শয্যায় ওঠার পর চলে পরীক্ষা-নিরীক্ষার খেলা। প্রকৃতপক্ষে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রেও ফি নেয়। ইউজার ফি আদায়ের নামে এখানে রোগীদের ফি প্রদানে বাধ্য করা হয়েছে। অনেক পরীক্ষা বাইরে গিয়ে করাতে হয়। রোগীকে এক জায়গা থেকে আরেকটি জায়গায় নেওয়ার প্রতিবারই ট্রলিম্যানকে টাকা দিতে হয়। ওয়ার্ডবয় ও আয়াদের খুশি না করলে রোগী শয্যা ধরে রাখাটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। উচ্চমূল্যের ওষুধ এবং চিকিৎসকদের প্রেসক্রিপশনে লেখা কোম্পানির ওষুধ সংশ্লিষ্ট হাসপাতালে পাওয়া না গেলেই রোগীদের বাইরে থেকে ওষুধ কিনতে হয়। শুধু চিকিৎসককে এবং রোগীর খাবারের ক্ষেত্রে কোনো টাকা দিতে হয় না। তবে চুক্তিবদ্ধ বাইরের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষার জন্য রোগী পাঠিয়ে সরকারি হাসপাতালে ফ্রি রোগী দেখার টাকা উঠিয়ে নেন অনেক চিকিৎসক। আর বাইরে পরীক্ষা করানো মানেই বড় অংকের টাকা। অধিকাংশ রোগীর ক্ষেত্রেই ফ্রি বেড বলে কিছু নেই। টাকা ও তদবির না হলে ফ্রি বেড পাওয়া যায় না। সার্জারি ও আইসিইউ রোগী হলে তো খরচের শেষ নেই।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার ক্ষেত্রে ৯৫ শতাংশ ব্যয় সরকার বহন করে থাকে। সরকারি হাসপাতালে ৭০ শতাংশ বেড বিনামূল্যের এবং ৩০ শতাংশ বেডের জন্য সামান্য ভাড়া নির্ধারিত আছে। এছাড়া রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে রোগীকে স্বল্প পরিমাণ ইউজার ফি বহন করতে হয়। ভাড়ায় বেডে থেকে এবং ইউজার ফি প্রদানের মাধ্যমে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা নিলেও কোনো রোগীর মোট খরচের ১৫ শতাংশের বেশি ব্যয় হওয়ার কথা নয়। সরকারি হাসপাতালে একজন রোগীর আউটডোরে চিকিৎসা নিতে খরচ হয় ১০ টাকা আর ভর্তি হতে ১৫ টাকা। ভর্তির পর থাকা-খাওয়া ও চিকিৎসার সব ব্যয় সরকারই বহন করে থাকে। সব হাসপাতালে ওষুধ ও অন্য সামগ্রী বিনামূল্যে সরবরাহ করা হয়। জীবনরক্ষাকারী সব ওষুধ সরকারীভাবে সরবরাহ করা হয়ে থাকে। বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রসমূহের ওষুধের চাহিদা এবং সে অনুযায়ী ওষুধের সরবরাহ ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, শুধু বেসরকারি নয়; সরকারি হাসপাতালেও চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন রোগীরা। জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতালে হার্টের সমস্যা নিয়ে ভর্তি হন রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের দরিদ্র আবুল কালাম (৪৯)। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তিনটি রিং বসানোর পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। প্রায় সাড়ে তিন থেকে চার লাখ খরচ হবে বলে তারা রোগীর লোকজনকে জানিয়ে দেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ওষুধের পেছনে সাত দিনে তার চিকিৎসা খরচ ১৫ হাজার টাকা ছাড়িয়ে যায়। রিং বসানোর টাকা না থাকায় শেষ পর্যন্ত চিকিৎসা অসমাপ্ত রেখে হাসপাতাল ত্যাগ করেন আবুল কালাম। তিনি ভোরের আকাশকে জানান, রিং বসানোর খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, হাসপাতালে ফ্রি রিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। তবে পরিচালকের বিশেষ অনুমতি লাগে। সব রোগীর কপালে জোটে না।

ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত সাজেদা বেগম (৪৫) ভর্তি হন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। চিকিৎসাধীন থাকার পর কেমো ও রেডিওথেরাপির প্যাকেজ নিয়ে হাসপাতাল ত্যাগ করেন তিনি। এই দুই ধরনের থেরাপির পেছনে তার কাছ থেকে নেওয়া হয় প্রায় এক লাখ টাকা। শেষ পর্যন্ত তিনি মারা যান। সড়ক দুর্ঘটনায় পা মারাত্মক আহত হয়ে একই হাসপাতালে ভর্তি হন ময়মনসিংহের ভালুকা থানার মল্লিকবাড়ী গ্রামের ইসমাইল হোসেন (৩৮)। বিশ দিন হাসপাতালে থাকার পর হাসপাতাল থেকে যখন ছাড়া পেলেন, তত দিনে তার পরিবারের খরচের পরিমাণ দাঁড়ায় দেড় লাখ টাকা।

অথচ সরকারি হাসপাতাল হিসেবে এখানে ফ্রি চিকিৎসা পাওয়ার কথা তার। কিন্তু বাস্তব ঘটনা হলো, হাসপাতালের চিকিৎসার টাকা জোগান দিতে গিয়ে আক্ষরিক অর্থেই জমিজমা বিক্রি করতে হলো রোগীর পরিবারকে! রাজধানীর মিটফোর্ড হাসপাতালে স্ত্রীরোগ বিভাগে ভর্তি এক রোগিণীর জরায়ুর একটি অস্ত্রোপচার প্রয়োজন ছিল। ওষুধ এবং বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার খরচ মিলিয়ে খরচ হলো আট হাজার টাকা! একই হাসপাতালে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত এক তরুণকে ৫টি আইভি স্যালাইন দিতে হয়েছিল।

এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে সরকারি হাসপাতালে নামমাত্র খরচে চিকিৎসাসেবা পাওয়া যায় দাবি করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, অপারেশন, সিসিইউ, আইসিইউ ও ডায়ালাইসিস সেবার ক্ষেত্রে কোনো টাকা নেওয়া যাবে না। তবে বেশকিছু পরীক্ষা করাতে স্বল্প ফি নেয়া হয়। এক্ষেত্রেও সরকারি ফি বেসরকারি হাসপাতালের ফির তুলনায় অনেকগুণ কম। সরকারি হাসপাতালে করোনারি এনজিওগ্রামে ২ হাজার টাকা, সিটিস্ক্যানে ২ হাজার টাকা, এমআরআই ৩ হাজার টাকা, ইসিজি ৮০ টাকা, ইকোকার্ডিওগ্রাম ২০০ টাকা, এক্স-রে ২০০ টাকা, আল্ট্রাসনোগ্রাম ৩০০ টাকা, কার্ডিয়াক ক্যাথ ২ হাজার টাকা, ইউরিন ৩০ টাকা এবং রক্তের হিমোগ্লোবিন, টোটাল কাউন্ট করাতে লাগে মাত্র ১০০ টাকা।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী দুলাল ভোরের আকাশকে বলেন, আমাদের দেশে শুধু হাসপাতাল ব্যবসা নয়, কোনো কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ নেই, সেটারই প্রভাব পড়েছে। নিয়ন্ত্রণহীন এ খরচ থেকে বাঁচাতে রাষ্ট্রের বড় দায়িত্ব রয়েছে। এটি এসডিজি (টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা) অর্জনের সঙ্গে জড়িত। এছাড়া ২০৩২ সালের মধ্যে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জন লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এজন্য ‘পয়েন্ট’ ধরে কাজ করতে হবে। স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে বেসরকারি অংশীদারত্বের ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু সেবাদানের কোয়ালিটিতে ছাড় দেওয়া হচ্ছে। ইচ্ছেমতো সেবামূল্য নিচ্ছে। এটি বন্ধে সরকারকে প্রতিষ্ঠানের ক্যাটাগরি ভেদে চিকিৎসা মূল্য নির্ধারণ করে দিতে হবে।

দেশের সরকারি হাসপাতাল থেকে ৯৭ শতাংশ রোগী ওষুধ পান না। তাদের ওষুধ কিনতে হয় বিভিন্ন ফার্মেসি থেকে। একইভাবে বিভিন্ন রোগ নির্ণয়ের মাত্র ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়ে থাকে সরকারি হাসপাতালে। অর্থাৎ ৮৫ দশমিক ১ শতাংশ পরীক্ষা-নিরীক্ষাই রোগীকে করতে হয় বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। এর ফলে বেড়ে যায় রোগীর চিকিৎসা ব্যয়। অতিরিক্ত এই খরচের কারণে ১৬ শতাংশ জনগোষ্ঠীকেই চিকিৎসাবঞ্চিত থাকতে হয়। অন্যদিকে চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়েই প্রতি বছর নতুন করে দরিদ্র হয়ে পড়েন ৮৬ লাখ মানুষ।

মন্তব্য