-->
শিরোনাম

ক্যান্সার রোগীর চিকিৎসা মাঝপথেই বন্ধ

নিখিল মানখিন ও আরিফ সাওন
ক্যান্সার রোগীর চিকিৎসা মাঝপথেই বন্ধ
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠান গ্লোবোক্যানের সর্বশেষ হিসাব বলছে, ২০২০ সালে বাংলাদেশে নতুনভাবে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছেন ১ লাখ ৫৬ হাজার মানুষ।

চিকিৎসা অব্যাহত রাখতে না পারা ক্যান্সার রোগীর মৃত্যু অস্বাভাবিক হারে খোদ চিকিৎসকরাও চিন্তিত। তারা বলছেন, চিকিৎসকদের দক্ষতা বৃদ্ধি পেলেও অপর্যাপ্ত অবকাঠামো ও মেডিকেল উপকরণ এবং ব্যয়বহুল হওয়ায় ব্যাহত চিকিৎসা নিতে পারছেন না অনেক ক্যান্সার রোগী। টাকার অভাবে চিকিৎসা মাঝপথে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তাদের। আর অনেক রোগী মৃত্যুর প্রহর গুনছেন চিকিৎসাবিহীন অবস্থায়। পরীক্ষা-নিরীক্ষা, অস্ত্রোপচার, ওষুধ- প্রতিটি ক্ষেত্রে অনেক বেশি টাকা খরচ করতে হয়। মধ্যবিত্তরাই এ খরচ চালাতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে যান। দরিদ্ররা খরচের ভয়ে এই চিকিৎসা নেওয়া থেকে দূরে থাকেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠান গ্লোবোক্যানের সর্বশেষ হিসাব বলছে, ২০২০ সালে বাংলাদেশে নতুনভাবে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছেন ১ লাখ ৫৬ হাজার মানুষ। একই সময়ে ক্যান্সারে মারা গেছেন ১ লাখ ৯ হাজার জন। অন্যদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, দেশে বছরে যত মানুষ মারা যান, তার ৬৭ শতাংশ ক্যান্সার, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, কিডনি রোগ, শ্বাসতন্ত্রের দীর্ঘস্থায়ী রোগের মতো অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত।

এক বছর ধরে ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করে পরাজিত হয়েছেন ময়মনসিংহের ধোবাউড়া থানার ভালকাপাড়া গ্রামোর জমিন উদ্দিন (৩৭)। ক্যান্সার ধরা পড়ার পর ঢাকার একটি সরকারি হাসপাতালে দুই মাস ধরে চিকিৎসা নিয়েছেন। জসিম উদ্দিদের ছোট ভাই মো. ফয়সাল ভোরের আকাশকে বলেন, প্রথমে তারা ভারতে যাওয়ার কথা চিন্তা করলেও চিকিৎসা খরচের কথা চিন্তা করে দেশের সরকারি হাসপাতালেই চিকিৎসা শুরু সিদ্ধান্ত নেন। বাংলাদেশে চিকিৎসা আছে। তাই খরচের কথা ভেবে ভারতে যাইনি। কিন্তু এখানেও অনেক খরচ। এ রোগের চিকিৎসার একটি অংশ কেমোথেরাপি, যেটা বড় ভাইকে দেওয়া হয়েছে ১২টি। আর প্রতিবারেই এ বাবদ তাদের গুনতে হয়েছে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। জমি, গবাদি পশু বেচে ও অন্য আত্মীয়দের কাছ থেকে টাকা ঋণ নিয়ে চিকিৎসা চলেছে। পরবর্তীতে টাকার কারণে স্বাভাবিক চিকিৎসা চালু রাখতে না পারায় ভাইয়ের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে এবং মারা যান বলে জানান মো. ফয়সাল।

মিরপুরের ডেল্টা হাসপাতালের তেমনি একটি বিভাগে কেমোথেরাপি নিতে কুমিল্লা থেকে এসেছেন মো. বাবুল হোসেন (৪২)। তার সঙ্গে রয়েছেন ছেলে বেলাল হোসেন। তিনি ভোরের আকাশকে জানান, ডাক্তার ১০টি কোমেথেরাপি নেওয়ার কথা বললেও আপাতত ৬টার বেশির খরচ বহন করা তাদের পক্ষে সম্ভব না। বাবার চিকিৎসা খরচ নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছে বেলাল হোসেন।

শেফালী আক্তার, শেরপুর জেলা সদরের নয়াপাড়া লসমানপুর গ্রামের এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর মেয়ে। বয়স মাত্র ৫ বছর। সে দুরারোগ্য ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত। চিকিৎসার পেছনে সহায়-সম্বল হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছেন শিশুটির পিতা মো. গিয়াসউদ্দিন।

সোয়া দুই বছরের শিশু সায়েম। সে দুরারোগ্য ব্যাধি ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত। মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে সে। উন্নত চিকিৎসা দেওয়া হলে শিশুটি সুস্থ হয়ে উঠবে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। এজন্য প্রয়োজন প্রায় ৫০ লাখ টাকা। কিন্তু স্বল্প বেতনের চাকরি করা বাবা সৈয়দ আলীর পক্ষে শিশু সায়েমের চিকিৎসার এ ব্যয়ভার বহন করা সম্ভব হচ্ছে না। চিকিৎসার পেছনে ইতোমধ্যে পরিবারটির সহায়-সম্বল ফুরিয়ে গেছে। বর্তমানে টাকার অভাবে চিকিৎসা চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন শিশুটির বাবা সৈয়দ আলী।

জরায়ুমুখের ক্যান্সারে আক্রান্ত স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকায় আসেন ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার সিএনজি অটোরিকশাচালক দুলাল মিয়া। জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট হাসপাতালে ভর্তির জন্য সারা দিন ঘুরে ব্যর্থ হন তিনি। পরে এক স্বজনের পরামর্শে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যান স্ত্রীকে। সিটিস্ক্যানসহ নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর চিকিৎসকের ফিতেই তার খরচ হয়ে যায় অর্ধ লক্ষাধিক টাকা। পরদিন পরীক্ষার রিপোর্ট চিকিৎসককে দেখানোর পর জানানো হয়, দুলাল মিয়ার স্ত্রীর ক্যান্সার তৃতীয় স্টেজে রয়েছে, এ অবস্থায় অপারেশনের কোনো সুযোগ নেই। রেডিও আর কেমোথেরাপি চিকিৎসাই একমাত্র ভরসা। আর এ চিকিৎসার জন্য প্রায় সাড়ে ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা খরচ হবে। সঙ্গে নিয়ে আসা প্রায় সব অর্থ একদিনে শেষ হয়ে যায় দুলাল মিয়ার। তার ওপর পুরো চিকিৎসা প্রক্রিয়ার খরচ শুনে ভেঙে পড়েন তিনি। আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকায় রাজধানীর একজন হোমিও চিকিৎসক দেখিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ি ফেরেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট এবং জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষকরা বলছেন, একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে একজন ক্যান্সার রোগীর চিকিৎসায় বছরে প্রায় ৬ লাখ ৩৯ হাজার টাকা ব্যয় হয়। এর মধ্যে আছে চিকিৎসকের পরামর্শ ফি, রোগ নির্ণয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা, অস্ত্রোপচার বা চিকিৎসা, ওষুধ, ইনজেকশনসামগ্রী যাতায়াত, রোগী ও স্বজনদের থাকা-খাওয়ার খরচ।

প্রধান গবেষক ও ঢাবির স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, মূল চিকিৎসার বাইরে অন্য যে খরচ রোগী ও তার স্বজনদের করতে হয়, তা অনেক বেশি। ক্যান্সার শনাক্ত করা বা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য মানুষকে নানা জায়গায় ঘুরতে হয়। অনেকে দালাল চক্রের পাল্লায় পড়েন। প্রতিটি ক্ষেত্রে পকেট থেকে অর্থ বের হয়ে যায় বলে জানান তিনি।

দেশের চারটি প্রধান হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা ৭ ধরনের ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসা ও আনুষঙ্গিক খরচের হিসাব করেছেন গবেষকরা। প্রতিটি হাসপাতাল থেকে কমপক্ষে ৩০ রোগীর তথ্য নেওয়া হয়েছে। মোট ২৬২ জনের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন গবেষকরা। হাসপাতালগুলো হচ্ছেÑ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং আহ্ছানিয়া ক্যান্সার ও জেনারেল হাসপিটাল। এ গবেষণার তথ্য ‘বাংলাদেশে ক্যান্সার সেবায় অর্থায়ন : একটি বিকল্প পন্থা’ শিরোনামে প্রবন্ধ আকারে এ বছরের ১২ জানুয়ারি ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব সোশ্যাল অ্যান্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সায়েন্সেস সাময়িকীতে ছাপা হয়েছে।

চিকিৎসক দেখানো, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, অস্ত্রোপচার, ওষুধÑ প্রতিটি ক্ষেত্রে অনেক বেশি টাকা খরচ করতে হয়। মধ্যবিত্তরাই এ খরচ চালাতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে যান। দরিদ্ররা খরচের ভয়ে এই চিকিৎসা নেওয়া থেকে দূরে থাকেন। ব্যয়বহুল চিকিৎসা অব্যাহত রাখতে না পারা ক্যান্সার রোগীদের মৃত্যু অস্বাভাবিক হার বেড়েছে। চিকিৎসকদের দক্ষতা বৃদ্ধি পেলেও অপর্যাপ্ত অবকাঠামো ও মেডিকেল উপকরণ এবং ব্যয়বহুল হওয়ায় ব্যাহত চিকিৎসা নিতে পারছে না অনেক ক্যান্সার রোগী। টাকার অভাবে চিকিৎসার মাঝপথে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তাদের অনেকের চিকিৎসা। আর অনেক রোগী মৃত্যুর প্রহর গুনছেন চিকিৎসাবিহীন অবস্থায়।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, বাংলাদেশে ক্যান্সার চিকিৎসায় সাধারণভাবে তিনটি চিকিৎসা পন্থা অবলম্বন করা হয়- অস্ত্রোপচার, কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপি। ক্যান্সার বিশেষজ্ঞরা গবেষকদের বলেছেন, সব সরকারি হাসপাতালে একবার রেডিওথেরাপির জন্য ২৫ হাজার, একবার কেমোথেরাপির জন্য ২০ হাজার এবং অস্ত্রোপচারে ৬০ হাজার টাকা খরচ হয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করে বাংলাদেশে ৭০ শতাংশ ক্যান্সার রোগীর রেডিওথেরাপির প্রয়োজন হয়। এজন্য মেশিন দরকার ২৫০টি। তার বিপরীতে মেশিন রয়েছে মাত্র ৫৭টি। তার মধ্যে অনেক মেশিন অকার্যকর অবস্থায় রয়েছে। জনসংখ্যা অনুপাতে বর্তমানে দেশে সব ধরনের সুবিধাসংবলিত ১৫০টি ক্যান্সার চিকিৎসা কেন্দ্র থাকা অপরিহার্য। কিন্তু বাংলাদেশে এখন এমন কেন্দ্রের সংখ্যা আছে মাত্র ২৫টি।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব অধ্যাপক ডা. মো. এহতেশামুল হক ভোরের আকাশকে বলেন, দেশে ক্যান্সার রোগীর চিকিৎসাসেবা প্রদানে কিছু সমস্যা রয়েছে। চিকিৎসার পদ্ধতি নির্ধারণ করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। বেশিরভাগ বেসরকারি হাসপাতালে রেডিওথেরাপি দেওয়ার ব্যবস্থা থাকে না। কিন্তু বেশিরভাগ ক্যান্সার রোগীর রেডিওথেরাপির প্রয়োজন হয়। ক্যান্সার চিকিৎসা শুধু কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। সুচিকিৎসার জন্য আরো অনেক কিছু দরকার। তাই বিশেষজ্ঞদের একসঙ্গে বসে একটি পরিকল্পনা করা দরকার।

মেডিকেল অনকোলজি সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. পারভীন শাহিদা আখতার বলেন, আমাদের দেশে ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীরা একেবারে শেষ পর্যায়ে চিকিৎসার জন্য আসে। কিন্তু ক্যান্সারের মূল চিকিৎসার আগে রোগীকে প্রস্তুত করার বিষয় থাকে। সারা দেশে মাত্র তিনটি মেডিকেল অনকোলজি বিভাগ আছে, যা ঢাকা সদরে অবস্থিত। ক্যান্সার একটি সমন্বিত চিকিৎসা। এটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল, দীর্ঘমেয়াদি এবং কিছুটা জটিল। ঢাকা শহরে রোগীরা এসে যে কষ্টের মধ্যে পড়ে, তা অনেকখানি কমানো যায়, যদি জেলা পর্যায়ে ক্যান্সারে আক্রান্তদের উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। সরকার প্রতিটি বিভাগে ক্যান্সার সেন্টার করার ব্যবস্থা নিচ্ছে।

মন্তব্য

Beta version