-->

ডায়রিয়ায় প্রকোপের তুলনায় মৃত্যু কম

* চিকিৎসাসুবিধা সুলভ হওয়ায় মৃত্যু কম * করণীয় সম্পর্কে সবার ধারণা রয়েছে * চিকিৎসায় বিশ্বে সুনাম কুড়িয়েছে বাংলাদেশ

নিখিল মানখিন
ডায়রিয়ায় প্রকোপের তুলনায় মৃত্যু কম
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডায়রিয়া রোগ ও তাৎক্ষণিক করণীয় সম্পর্কে অবগত আছেন দেশের মানুষ। ফাইল ছবি

প্রকোপের তুলনায় রাজধানীতে ডায়রিয়ায় মৃত্যুর হার কম। প্রকোপ শুরু হওয়ার পর নগরীর মহাখালীর আইসিডিডিআর,বিতে চিকিৎসাধীন রোগীর কেউ মারা যায়নি। হাসপাতালে আনার পথে কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে আইসিডিডিআর,বি। নগরীর অন্য সব হাসপাতালে ডায়রিয়ায় মৃত্যুর খবর নেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডায়রিয়া রোগ ও তাৎক্ষণিক করণীয় সম্পর্কে অবগত আছেন দেশের মানুষ। সময়মতো রোগীর সেবা ও চিকিৎসা শুরু হলে ডায়রিয়ায় দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা থাকে না। সাধারণ মানুষের মধ্যে চিকিৎসা অভিজ্ঞতা থাকায় এবং চিকিৎসাসুবিধা হাতের মুঠোয় হওয়ায় দেশে ডায়রিয়ায় মৃত্যু কম। আতঙ্কিত না হয়ে বাড়তি সতর্কতা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা।

বাংলাদেশে ডায়রিয়া পরিস্থিতির শিগগিরই উন্নতি হচ্ছে না। মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে শুরু হওয়া ডায়রিয়া পরিস্থিতি আরো কিছুদিন ভোগাবে বলে জানিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসকরা। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি) হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী। ১৫ মার্চ থেকে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীর চাপ বাড়তে থাকে আইসিডিডিআর,বি হাসপাতালে। বাড়তি রোগীর চাপ সামলাতে বিশেষায়িত এই হাসপাতালের বাইরে তাঁবু খাটিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। আইসিডিডিআর,বিতে এমন চিত্র দেখা গেলেও রাজধানীর অন্যান্য সরকারি হাসপাতালে রোগীর চাপ তেমন দেখা যায়নি।

আইসিডিডিআর,বির জরুরি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ১৬ মার্চ ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হন ১০৫৭ জন, ১৭ মার্চ ভর্তি ছিল ১১৪১ জন, ১৮ মার্চ ১১৭৪, ১৯ মার্চ ১১৩৫, ২০ মার্চ ১১৫৭, ২১ মার্চ ১২১৬, ২২ মার্চ ১২৭২, ২৩ মার্চ ১২৩৩, ২৪ মার্চ ১১৭৬, ২৫ মার্চ ১১৩৮, ২৬ মার্চ ১২৪৫, ২৭ মার্চ ১২৩০, ২৮ মার্চ ১৩৩৪, ২৯ মার্চ ১৩১৭, ৩০ মার্চ ১৩৩১ এবং ৩১ মার্চ ১২৮৫ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। চলতি এপ্রিল মাসের ১ তারিখে ১২৭৪ জন, ২ এপ্রিল রাত ৮টা পর্যন্ত ১০৭১ জন এবং ৪ এপ্রিল রাত ৮টা পর্যন্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৯৮৭ জন।

আইসিডিডিআর,বি হাসপাতালের ডায়রিয়া পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিষ্ঠানের হাসপাতাল শাখার প্রধান ডা. বাহারুল আলম ভোরের আকাশকে বলেন, কবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে পারে, তা এখনই ঠিক করে বলা সম্ভব নয়। ডায়রিয়ার তীব্রতা এখনো আছে। আমরা ডায়রিয়া পরিস্থিতির চূড়ায় বসে আছি। অভিজ্ঞতা থেকে যদি বলি, তাহলে বলতে হবে ডায়রিয়ার প্রদুর্ভাব সাধারণত ৬ সপ্তাহের মধ্যে চলে যায়। আমরা ৩ সপ্তাহের বেশি সময় পার করেছি। আরো ২ থেকে ৩ সপ্তাহের মধ্যে হয়তো প্রাদুর্ভাব কমে আসবে।

চিকিৎসা অভিজ্ঞতা থাকায় ডায়রিয়ায় মৃত্যু কম: বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক

আইসিডিডিআর,বির হাসপাতাল শাখার প্রধান ডা. বাহারুল আলম ভোরের আকাশকে বলেন, আইসিডিডিআর,বির চিকিৎসা সব সময় আন্তর্জাতিকমানের। এই হাসপাতালে রোগী মারা যাওয়ার তেমন ঘটনা খুবই কম। তিনি আরো বলেন, ডায়রিয়া রোগী ও তা প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কে ধারণা রাখেন না দেশে এমন মানুষের সংখ্যা খুবই কম। সঠিক সময়ে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করলে মৃত্যুঝুঁকি কম। সচেতনতা ও চিকিৎসাসুবিধা হাতের মুঠোয় হওয়ায় ডায়রিয়ায় মৃত্যুহারও কম বলে জানান ডা. বাহরুল আলম।

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এএসএম আলমগীর ভোরের আকাশকে বলেন, অনেক আগেই ডায়রিয়া রোগীর চিকিৎসায় বিশে^ সুনাম কুড়িয়েছে বাংলাদেশ। ডায়রিয়া রোগ ও তাৎক্ষণিক করণীয় সম্পর্কে অবগত আছেন দেশের মানুষ। সময়মতো রোগীর সেবা ও চিকিৎসা শুরু হলে ডায়রিয়ায় দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা থাকে না। নিতে হবে বাড়তি সতর্কতা। ওরস্যালাইনসহ প্রয়োজনীয় ওষুধ পাওয়া যায় বাসাবাড়ির পাশের ওষুধের দোকানে। দূরে যেতে হয় না। বাংলার মানুষ নিজেরাই তৈরি করতে পারেন স্যালাইন। ডায়রিয়ার বিষয়টি এত বেশি প্রচার হয়েছে যে, দেশের প্রত্যেক মানুষই রোগটি সম্পর্কে ধারণা রাখেন।

ডায়রিয়া সম্পর্কে ডা. এসএম আলমগীর বলেন, ডায়রিয়া বা কলেরার মূল কারণ ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়া। এটি ছড়ানোর মাধ্যম হচ্ছে জীবাণু দ্বারা দূষিত পানি ও পচা-বাসি খাবার। কিন্তু কলেরার জীবাণুর উপস্থিতি সরকারিভাবে স্বীকার করা হয় না। কলেরা শব্দটি এড়িয়ে মারাত্মক ডায়রিয়া বলা হয়। কলেরা প্রতিরোধে কার্যকরী টিকা রয়েছে। সেটি বছরে দুইবার করে দিতে হয়। কিন্তু দেশের বাস্তবতায় সেটি কঠিন। একই সঙ্গে কলেরায় আগের মতো মানুষ এখন মারা যায় না। কারণ, চিকিৎসাব্যবস্থা অনেক উন্নত হয়েছে।

তিনি বলেন, ২৪ ঘণ্টায় তিনবার পাতলা পায়খানা হলে সেটিকে ডায়রিয়া বলা হয়। শুরুর দিকে বমি, পেট কামড়ানো হয়ে থাকে। এ ছাড়া ডায়রিয়া হলে পানিশূন্যতা দেখা দেয়। আর কলেরা হলে সেটিকে রাইস ওয়াটার স্টুল বলা হয়। অর্থাৎ চাল ধোয়া পানির মতো দেখতে প্রচুর পাতলা পায়খানা হয়। বাথরুমে যাওয়ার মতো আর সময় থাকে না। কলেরায় খুব দ্রুতই শরীরে পানিশূন্যতা তৈরি হয়। সে ক্ষেত্রে রোগী দ্রুত নিস্তেজ হয়ে পড়েন। একই সঙ্গে শকেও চলে যেতে পারেন। সুতরাং কলেরার ক্ষেত্রে হাসপাতালে নিতে কোনোভাবেই বিলম্ব করা যাবে না। ই-কোলাই থেকে ডায়রিয়া হলে তাতে বমি হবে, পেট কামড়াবে এবং পাতলা মল হবে।

রোটা থেকে ডায়রিয়া হলে মলের রং সবুজাভ হবে। শিগেলার হলে অল্প করে নরম মল হবে। একই সঙ্গে মিউক্যাস, রক্ত ও গা গোলানো ভাব থাকতে পারে। এ ক্ষেত্রে বাড়িতে স্যালাইন খেয়ে চিকিৎসা চালানো যেতে পারে। খুব খারাপ অবস্থা হলে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। তবে সব ধরনের ডায়রিয়ার চিকিৎসা একটাই, সেটি হলো শরীর থেকে বের হয়ে যাওয়া পানি ও লবণ আগের জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া। ডায়রিয়া হলে রোগীকে স্বাভাবিক খাবার দিতে হবে। স্যালাইনের পাশাপাশি ডাবের পানি ও অন্যান্য তরল খাবার দিতে হবে। সুতরাং সবার প্রতি আহ্বান থাকবে, গরমের এই সময়ে যাতে কেউ বাইরের খাবার গ্রহণ না করে। ঘরে তৈরি খাবার গ্রহণ করা ভালো। একই সঙ্গে ফুটিয়ে পানি পান করতে হবে। তাহলে ডায়রিয়ার ঝুঁকি অনেকাংশে কমে আসবে।

মন্তব্য

Beta version