২০২২ সালের ৭ এপ্রিল, বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস আন্তর্জাতিকভাবে এবং জাতীয় পর্যায়ে দেশে দেশে অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উদযাপিত হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস ৭ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হয়। এর কারণ হচ্ছে জাতিসংঘের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’-এর জন্মদিন ৭ এপ্রিল ১৯৪৮। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রতিষ্ঠার ২ মাস পর ২৪ জুন ১৯৪৮ সালে এই সংস্থার প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল জেনেভায়। সেই সময় সারাবিশ্বের ৪৬টি সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। সেই সম্মেলন থেকেই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য সচেতনতা তৈরিতে ১৯৫০ সালের ৭ এপ্রিল থেকে প্রতি বছর নিয়মিত বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস পালন করা হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রতি বছর এমন একটি প্রতিপাদ্য বিশ্ববাসীর সামনে নিয়ে আসে; যা বিশ্বব্যাপী জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৫০ সালের বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ‘নো ইউর হেলথ সার্ভিসেস’- যার অর্থ ‘নিজের স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে সচেতন হোন’। এভাবে ৭০ বছর ধরে ৭ এপ্রিল বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস’। প্রতি বছর বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণের জন্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় ওই সংস্থার সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধিদের নিয়ে। দিবসটি উদযাপন উপলক্ষে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং স্বাস্থ্যবিষয়ক কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো নানা ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ করে থাকে।
এবারের বিশ্ব গত দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে কোভিড-১৯ নামক অদৃশ্য শক্রর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যাচ্ছে এবং বিশ্বজুড়ে সব সেক্টরেই কঠোরভাবে আঘাত করেছে এই প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস। এখন পর্যন্ত সারাবিশ্বে প্রায় ৪৯ কোটি ৫০ লক্ষাধিক মানুষ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে এবং প্রায় ৬২ লক্ষাধিক মানুষ এই প্রাণঘাতী ভাইরাসে মৃত্যুবরণ করেছেন। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত প্রায় ৯ লাখ ৫২ হাজার আক্রান্ত এবং মৃত্যুবরণ প্রায় ২৯ হাজার ২০০ জন।
২০২২ সালের ৭ এপ্রিল এবারের প্রতিপাদ্য- ‘Our Planet, our Health’। আমরা বর্তমানে একটি অসম পৃথিবীতে বসবাস করছি। যেখানে কিছু লোক স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করছে, অন্যদের তুলনায় মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবায় বেশি সুযোগ পাচ্ছে, কাজের ক্ষেত্রে- বসবাসের ক্ষেত্রে অধিক পরিমাণ সুযোগসুবিধা ভোগ করছে। অপরদিকে সারাবেশ্বর অধিকাংশ মানুষ দৈনিক আয়ের জন্য রীতিমতো যুদ্ধ করছে জীবনের সঙ্গে, আবাসন সংকট প্রকট এবং সুশিক্ষার ক্ষেত্রে সীমিত সুযোগ পাচ্ছে, কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে সুযোগের অভাব, বৃহত্তর লিঙ্গ বৈষম্য, নিরাপদ পরিবেশ, বিশুদ্ধ পানি- নির্মল বায়ু ও নিরাপদ খাদ্য সংকট এবং সংকটাপন্ন স্বাস্থ্য পরিসেবা। এসব বিষয় আমাদের সমাজ এবং অর্থনীতিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এ সমস্যাগুলোর প্রতিকার ও প্রতিরোধ সম্ভব। এ জন্য আমাদের প্রত্যেকের জীবনযাত্রার মান উন্নতকরণে, সুস্বাস্থ্য এবং সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বিশ্ব নেতৃত্বকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে বিশ্বনেতাদের বদ্ধপরিকর হতে হবে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিকনির্দেশনায় বাংলাদেশ বেশ ভালোভাবেই করোনাকে সামাল দিতে সক্ষম হয়েছেন। করোনা মোকাবিলায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেন। তবে এ কথা সত্য যে, তার নিরলস পরিশ্রম অদম্য মনোবলের কারণে বিশ্বের অনেক উন্নত দেশের আগেই করোনা মোকাবিলায় বাংলাদেশ ইতিবাচক সাফল্য অর্জন করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যা প্রায় ৩৪ কোটি সেখানে বাংলাদেশে জনসংখ্যা মাত্র ১৭ কোটি। কোভিড ১৯-এর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এ পর্যন্ত মারা গেছে প্রায় ৯ লাখ মানুষ, সেখানে বাংলাদেশে মারা গেছে ২৯ হাজার। আয়তনের দিক দিয়েও বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় অনেক ছোট। সে তুলনায় করোনা মোকাবিলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বাংলাদেশ অনেক ভালো অবস্থানে আছে। জার্মানির আয়তন বাংলাদেশের প্রায় তিনগুণ আর জনসংখ্যা বাংলাদেশের অর্ধেক। অপরদিকে নিউজিল্যান্ডের আয়তন বাংলাদেশের দ্বিগুণ আর জনসংখ্যা বাংলাদেশের প্রায় পঁয়ত্রিশ ভাগের এক ভাগ। সে হিসেবে বলা যায় করোনা মোকাবিলায় বাংলাদেশের তুলনায় উল্লিখিত দেশ তিনটির কাজ সহজ ছিল।
মূলত সীমিত আয়তন ও বিপুল জনসংখ্যার বাংলাদেশের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত দৃঢ়চিত্ততা মোকাবিলা করে চলেছেন। কিছুদিন পূর্বে গণটিকা কর্মসূচিতে ১ দিনে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ মানুষকে টিকা দেওয়া হয়েছে। এত বিপুলসংখ্যক মানুষকে একদিনে টিকা দেওয়া সম্ভব হয়েছে একমাত্র মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে। বিশে^র ১১৭টি দেশের মধ্যে ৪২টি দেশে জনসংখ্যার পরিমাণ ১ কোটি ২০ লাখ। যেখানে ৪২টি দেশে সর্বমোট জনসংখ্যাই ১ কোটি ২০ লাখ, সেখানে আমরা ১ দিনে ১ কোটি ২০ লাখ মানুষকে টিকা দিয়ে বিশে^র মধ্যে অন্যতম দেশ হিসেবে সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছি।
গত ২৯ মার্চ ২০২১ তারিখে উপাচার্য হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিষয়ে বেশ কয়েকটি কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে।
উল্লেখযোগ্য কার্যক্রমসমূহ হলো:
Haematological Parameters and Antibody Titre After Vaccination Against SARS-COV-2 শীর্ষক গবেষণার ফলাফল প্রকাশ, বিএসএমএমইউ-এর জেনোম সিকোয়েন্সিং রিসার্চ প্রজেক্ট-এর গবেষণা, কোভিড ১৯-এর ৭৬৯টি জেনোম সিকোয়েন্সিং গবেষণার ফলাফল, শহীদ ডা. মিল্টন হলে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে খাদ্যে ক্ষতিকারক উপাদানের উপস্থিতি (ফুড হ্যাজার্ড) নিয়ে ৩টি গবেষণার ফলাফল, এবং বিশ্ব প্রবীণ দিবসে প্রবীণদের পুষ্টিসহ ৩টি গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয়।
সব জল্পনাকল্পনার অবসান ঘটিয়ে সাধারণ জরুরি বিভাগ চালু, বেতার ভবনে ১০০ শয্যা করোনা ইউনিট এবং নন- কোভিড রোগীদের জন্য ১০ বেডের নতুন আইসিইউ ইউনিট, ২০ হাজার লিটার ধারণক্ষমতাসম্পন্ন অক্সিজেন প্ল্যান্ট, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ফিল্ড হাসপাতাল চালু, রোগীদের সুবিধার্থে বৈকালিক স্পেশালাইজড আউটডোর চালু, ফরেনসিক মেডিসিন ও টক্সিকোলজি বিভাগ চালু, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ২৩ বছর পর প্রথমবারের মতো হেলথ কার্ড চালু, পেডিয়াট্রিক এন্ডোক্রাইনোলজি ক্লিনিক, পেডিয়াট্রিক থাইরয়েড ক্লিনিক ও গ্রোথ ক্লিনিক, রেটিনোপ্যাথি অব প্রিমেচিউরিটি (আরওপি) ক্লিনিক, রিপ্রোডাকটিভ এন্ডোক্রাইনোলজি অ্যান্ড ইনফার্টিলিটি বিভাগে ডিম্বাশয়ে স্টেম সেল থেরাপি প্রতিস্থাপনের মহতী কার্যক্রম, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড ইমিউনোলজি বিভাগে স্থাপিত স্বয়ংক্রিয় জীবাণু শনাক্তকরণ, অ্যান্টিবায়োটিকের সংবেদনশীলতার মাত্রা নির্ধারণের মেশিনের কার্যক্রম, শিশু সার্জারি বিভাগে স্কিল ল্যাব, ডিজিটাল লাইব্রেরি ও ৩টি ডিভিশন এবং হিজরা নামে পরিচিত তৃতীয় লিঙ্গের শিশুদের চিকিৎসার জন্য ডিসঅর্ডার অব সেক্স ডেভেলপমেন্ট বহির্বিভাগ ক্লিনিক, কলোরেক্টাল ক্যানসার স্ক্রিনিং টেস্ট (ফিকাল ইমিউনোকেমিকেল টেস্ট-ফিট)-এর উদ্বোধন, মেলনিউট্রিশন ক্লিনিক, অটোল্যারিংগোলজি হেড অ্যান্ড নেক সার্জারি বিভাগের উদ্যোগে স্কিল ল্যাব, শিশুদের মেরুদণ্ডের বাঁকা হাড় সোজাকরণ ইউনিট, গাইনোকোলজিক্যাল অনকোলজি ওপিডি স্পেশাল ক্লিনিক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয়ের ই-ব্লকে পেডিয়াট্রিক হেমাটোলজি অ্যান্ড থ্যালাসেমিয়া ডে-কেয়ার সেন্টার ও শিশু পালমোলজি ওয়ার্ড এবং মুভমেন্ট ফর থ্যালাসেমিয়া ইরাডিকেশন ইন বাংলাদেশ-এর উদ্বোধন, প্যাথলজি বিভাগের সাইটোজেনেটিকস ল্যাব এ ফিস টেস্ট এবং ল্যাবরেটরি মেডিসিন বিভাগে ইমারজেন্সি ল্যাবের শুভ উদ্বোধন করা হয়।
এ ছাড়াও নন-রেসিডেন্ট ছাত্রছাত্রীদের ভাতা প্রদান, অর্থোপেডিক সার্জারি বিভাগে আরথ্রোস্কোপি ইউনিটে না কেটেই সফলভাবে শোল্ডার জয়েন্ট আরথ্রোস্কোপির মাধ্যমে ব্যাংকার্ট রিপেয়ার কার্যক্রম অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন, সফলভাবে ইনফার্টিলিটির চিকিৎসায় স্টেম সেল প্রয়োগ, টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়, ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর, কোর্স আউটদের সুযোগ, রেসিডেন্ট, নন-রেসিডেন্টদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা ইত্যাদি সম্পন্ন করা হয়।
এক সঙ্গে কাজ করার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসেবার অসম্পূর্ণ দিকগুলো বস্তুনিষ্ঠভাবে তুলে ধরতে হবে। সমাধানগুলো বাস্তবায়ন করতে হলে ক্ষতিগ্রস্ত সম্প্রদায় এবং মানুষের সঙ্গে একত্রে কাজ করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রয়োজন হবে নির্ভরযোগ্য তথ্য/ডাটা সংগ্রহ করা। সময়োপযোগী এবং নির্ভরযোগ্য স্বাস্থ্য তথ্য এমনভাবে সংগ্রহ করতে হবে যেন লিঙ্গ, বয়স, উপার্জন, শিক্ষা, মাইগ্রেশনের স্থিতিশীলতা, অক্ষমতা, ভৌগোলিক অবস্থান এবং জাতীয় প্রসঙ্গ ইত্যাদি পৃথকভাবে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ প্রাধান্য পায়। কেবল তখনই বিশ্ব জনসংখ্যার উপগোষ্ঠীগুলোতে অসম্পূর্ণতাগুলো মূল্যায়ন এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব হবে।
অসমতার মূল কারণগুলো মোকাবিলায় এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় বিনিয়োগ বাড়াতে সরকারি সাহায্য সহযোগিতার পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। সবার স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ এবং আগামী দিনের স্থিতিশীলতা বাড়ানোর জন্য আজকের দিনের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করা খুবই জরুরি।
জাতীয় সীমানা ছাড়িয়ে স্বাস্থ্যসেবায় আইনের প্রয়োগ হতে হবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কেবল যখন আমরা দেশের সীমানা পেরিয়ে গোটা বিশ্বব্যাপী সুরক্ষা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে পারব তখনই কেবলমাত্র কোভিড-১৯ মহামারিকে শেষ করা সম্ভব হবে। ভ্যাকসিন, পরীক্ষা এবং চিকিৎসার ন্যায়সঙ্গত সরবরাহের আশ্বাস প্রদানের পাশাপাশি আমাদের অবশ্যই জাতীয় এবং আন্তজার্তিক বিভিন্ন প্রত্রিুয়াগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে। বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যসেবায় সবার সমান সুযোগ নিশ্চিত করার মাধ্যমে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে আস্থা ও অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করতে হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত নিয়মিত মাস্ক পরাসহ সব ধরনের স্বাস্থবিধি মেনে চলব। ‘করোনামুক্ত বিশ্ব, অসমতাবিহীন মানবিক সমাজ আমরা গড়ব’ এই হোক ২০২২ সালের ৭ এপ্রিল বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসে আমাদের দৃঢ় অঙ্গীকার।
লেখক: উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য