-->
শিরোনাম

আক্রান্ত অধিকাংশই জানেন না তাদের উচ্চরক্তচাপ

* কন্ট্রোলে নেই ৮৫ শতাংশ নারী এবং ৯১ শতাংশ পুরুষের ব্লাডপ্রেশার * ১৮ বছরের পর থেকেই প্রতি বছর ব্লাডপ্রেশার মাপার পরামর্শ

আরিফ সাওন
আক্রান্ত অধিকাংশই জানেন না তাদের উচ্চরক্তচাপ
প্রতীকী ছবি

জোহরা বেগম (৫৬)। বাড়ি বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার আফরা গ্রামে। মাস দুয়েক আগে শারীরিক বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে চিকিৎসকের কাছে যান তিনি। তখন চিকিৎসক জানান, তার উচ্চরক্তচাপ রয়েছে। এর আগে কখনোই তিনি বুঝতেই পারেননি, তার এ সমস্যা থাকতে পারে। শুধু জোহরা বেগম নন; বর্তমানে দেশে উচ্চরক্ত চাপ থাকা ৩ কোটি ২০ লাখ মানুষের মধ্যে ৬৭ শতাংশ পুরুষ ও ৫১ শতাংশ নারীই জানেন না, তাদের উচ্চরক্তচাপ রয়েছে।

উচ্চরক্তচাপ বা হাইপারটেনশন একটি দীর্ঘস্থায়ী স্বাস্থ্যগত সমস্যা, যা অকালমৃত্যু ঘটায়। অধিকাংশ সময় উচ্চরক্তচাপের নির্দিষ্ট কোনো লক্ষণ এবং উপসর্গ থাকে না। যে কারণে উচ্চরক্তচাপে ভোগা অনেক রোগী জানেনই না, তার উচ্চরক্তচাপ রয়েছে। এজন্য উচ্চরক্তচাপকে নীরব ঘাতক বলা হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চরক্তচাপের কারণে হৃদরোগ, স্ট্রোক এবং কিডনি রোগে আক্রান্ত হওয়া এবং মৃত্যুঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়। শুধু উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে ৮০ শতাংশ স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটার্ক প্রতিরোধ করা সম্ভব। সেজন্য স্ক্রিনিয়ের পরামর্শ তাদের। ১৮ বছরের পর থেকেই প্রতি বছর ব্লাডপ্রেশার মেপে দেখা যেতে পারে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বাংলাদেশের ন্যাশনাল প্রফেশনাল অফিসার (এনসিডি) ডা. সৈয়দ মাহফুজুল হক বলেন, হাইপারটেনশন এবং ডায়াবেটিসের একটা বড় সমস্যা- এদের বলা হয় নীরব ঘাতক। একজনের যদি হাইপারটেনশন থাকেও অথবা ডায়াবেটিস থাকেও অনেক সময় লক্ষণ হয় না। অনেকটা সময় চলে যায়, কিন্তু সে বুঝতে পারে না, সে আক্রান্ত। এমন সময় ধরা পড়ে অন্য কোনো রোগের জন্য চিকিৎসকের কাছে গিয়ে, যখন ভেতরে ভেতরে খেয়ে ফেলে। ফলে এটাকে নীরক ঘাতক বলা হয়।

ব্র্যাক জেমস পি গ্রান্টস স্কুল অব পাবলিক হেলথের সেন্টার ফর নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ অ্যান্ড নিউট্রিশন বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মলয় কান্তি মৃধা বলেন, ‘রিসেন্ট যে ডাটা আছে ১৮ থেকে ৬৯ বছরের প্রতি চারজনের একজন হাইপারটেনশনে ভুগছেন অর্থাৎ ২৯ শতাংশ। পুরুষের মধ্যে ৬৭ শতাংশই জানেন না, তারা হাইপারটেনসিভ। যেসব নারী উচ্চরক্তচাপে ভুগছেন, তাদের মধ্যে ৫১ শতাংশই জানেন না, তারা হাইপারটেনসিভ। যারা জানেন, তাদের মধ্যে অনেকেই নিয়মিত কোনো ওষুধই খান না। লাইফস্টাইল মোডিফিকেশ বা এ ধরনের কোনো কিছুর সঙ্গে তারা জড়িত না। যারা জানেন এবং ওষুধ খাচ্ছেন, অনেকেই হচ্ছে ঠিকমতো ওষুধ খাচ্ছেন না। আজকে খেলাম, একটু ভালো লাগল, কালকে আমি ওষুধটা বন্ধ করে দিচ্ছি। এরকম করছেন।’

‘বাংলাদেশ এনসিডি স্টেপস সার্ভে-২০১৮’ অনুযায়ী, ওষুধ গ্রহণের মাধ্যমে রোগটি নিয়ন্ত্রণে রেখেছে মাত্র ১৪ শতাংশ অর্থাৎ প্রতি সাতজনে একজনেরও কম। উচ্চরক্তচাপে আক্রান্ত অধিকাংশ রোগীই অর্থাৎ ৬৪ শতাংশ কোনো ওষুধ সেবন করে না। অধ্যাপক ডা. মলয় কান্তি মৃধা বলেন, পুরুষের যাদের উচ্চরক্তচাপ এবং ব্লাডপ্রেশার কন্ট্রোলে আছে, এদের সংখ্যা মাত্র ৯ শতাংশ। মহিলাদের মধ্যে এ সংখ্যাটা একটু বেশি; ১৫ শতাংশ। তার মানে ৮৫ শতাংশ নারী এবং ৯১ শতাংশ পুরুষের ব্লাডপ্রেশার কন্ট্রোলে নেই।

তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে যে কিডনি ডিজিস, স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটার্ক, চোখের সমস্যা এ জিনিসগুলো আমরা যে দেখতে পাচ্ছি, এর একটা কারণ- যাদের উচ্চরক্তচাপ, তারা তাদের ব্লাডপ্রেশার কন্ট্রোলে রাখতে পারছেন না। মানুষের যে হার্ট অ্যাটার্ক হয়, স্ট্রোক হয়। হার্ট অ্যাটার্ক থেকে মারা যেতে পারে, অক্ষম হয়ে যেতে পারে। স্ট্রোক হলে কিন্তু অক্ষম হয়ে যাওয়া, মারা যাওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। ৮০ শতাংশ স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক আমরা কিন্তু প্রতিরোধ করতে পারি, যদি আমরা ব্লাডপ্রেশার কন্ট্রোলে রাখি। কন্ট্রোলে রাখার জন্য আগে দরকার চিহ্নিত করা।’

গ্লোবাল বার্ডেন অব ডিজিস স্টাডি (জিবিডি) ২০১৯-এর তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে মৃত্যু এবং পঙ্গুত্বের প্রধান তিনটি কারণের একটি উচ্চরক্তচাপ। বাংলাদেশে বছরে ২ লাখ ৭৭ হাজার মানুষ হৃদরোগজনিত অসুস্থতায় মারা যান, যার অন্যতম প্রধান কারণ উচ্চরক্তচাপ। ডব্লিউএইচওর তথ্য মতে, বাংলাদেশে প্রতি বছর ৫ লক্ষাধিক মানুষ অসংক্রামক রোগে মৃত্যুবরণ করেন, যার প্রায় অর্ধেক হৃদরোগজনিত।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে লক্ষণ প্রকাশ না পেলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে সকালের দিকে মাথাব্যথা, নাক দিয়ে রক্ত পড়া, হৃৎপিণ্ডের অনিয়মিত ছন্দ, দৃষ্টিতে পরিবর্তন এবং কানে গুঞ্জন অনুভূতি প্রভৃতি উপসর্গ দেখা দিতে পারে। অত্যধিক উচ্চরক্তচাপ ক্লান্তি, বমি বমি ভাব, বমি, বিভ্রান্তি, উদ্বেগ, বুকে ব্যথা এবং পেশি কম্পনের কারণ হতে পারে। উচ্চরক্তচাপ শনাক্ত করার একমাত্র উপায় হলো চিকিৎসক বা পেশাদার স্বাস্থ্যকর্মী দ্বারা রক্তচাপ পরিমাপ করা। অধ্যাপক ডা. মলয় কান্তি মৃধা বলেন বলেন, ‘পপুলেশন বেইসড যদি স্কিনিং করা যায়, তাহলে কিন্তু সবাইকইে শনাক্ত করা যায়। সবাইকেই শনাক্ত করা সম্ভব, যদি আমরা সঠিকভাবে তার রক্ত চাপটা মাপতে পারি।’

এ প্রসঙ্গে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বাংলাদেশের ন্যাশনাল প্রফেশনাল অফিসার (এনসিডি) ডা. সৈয়দ মাহফুজুল হক বলেন, ‘কনসেপ্টটা এরকম যে একটা রাষ্ট্র তার প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীকে বছরে একবার চেক করবে যে তার পেশার আছে কিনা? তার ব্লাডসুগার কত, তার কোলেস্টেরল কত? এডলান্ট জনগোষ্ঠীর ডেফিনেশন কি? ১৮ থেকে আরম্ভ করে ঊর্ধ্বে পর্যন্ত। এ পার্টিকুলার প্রোগ্রামের জন্য এ কাট অব পয়েন্টটা রাষ্ট্র নির্ধারণ করবে তার পকেটে কত টাকা আছে তার ওপর। যদি অনেক টাকা থাকে আপনি আঠারোয় করেন, যদি আরেকটু কম টাকা থাকে আপনি ত্রিশে করেন। যদি আরো কম টাকা থাকে আপনি ৪০ বছর কাট অব পয়েন্ট করেন।’

তিনি বলেন, বর্তমানে সরকার যে পলিসি নিয়েছেন, তাতে ওনারা কার্ট অব পয়েন্ট নির্ধারণ করেছেন ৪০ বছর। বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন ডাইরেক্টার জেনারেল অব হেলথ সার্ভিস যে প্রোগ্রামটা নিয়েছেন আস্তে আস্তে এটা এক্সপ্যান্ড করছে। সিলেটে, ময়মনসিংহ, কক্সবাজারসহ আরো কিছু জায়গায় এক্সপ্যান্ড করেছে। উদ্দেশ্য হচ্ছে ৪০ বছর তদুর্ধ্ব জনগোষ্ঠী আছে তাদের সবাইকে বছরে একবার স্ক্রিন করা। স্ক্রিন করে যাতে ভালো পাওয়া যাবে, তাদের আবার এক বছর পরে আসতে বলা হবে। আর যাতের ব্লাডপ্রেশার বেশি পাওয়া যাবে, তাদের প্রটোকল অনুযায়ী চিকিৎসার মধ্যে নিয়ে আসা এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করা।

জিএইচএআই বাংলাদেশ কান্ট্রি লিড মো. রুহুল কুদ্দুস বলেন, প্রথমে স্কিনিং করতে হবে। স্কিনিংয়ে আসার পর যাদের আছে, তাদের সেই হিসেবে ট্রিটমেন্ট দেওয়া। আর যাদের নেই তাদের যাতে না হয়, সেজন্য কী কী লাইফস্টাইল চেঞ্জ করতে হবে, সে বিষয়ে সচেতন করতে হবে। ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হসপিটল অ্যান্ড রিসার্স ইনস্টিটিউটের উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ প্রোগ্রামের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. শামীম জোয়াদ্দার বলেন, ১৮ বছর বয়সে ব্লাডপ্রেশার মাপবেন। যদি দেখেন নরমাল। ৬ মাস এক বছরের মধ্যে মাপতে হবে না। এক বছর পরে আবার মাপবেন।

মন্তব্য

Beta version