-->
শিরোনাম

ডেঙ্গু নিয়ে আগাম সতর্কতা

আরিফ সাওন
ডেঙ্গু নিয়ে আগাম সতর্কতা

প্রতিবছরই জুন মাস থেকে ডেঙ্গু রোগী বাড়তে শুরু করে। এভাবে বাড়ে আগস্ট-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। এরপর অক্টোবর মাস থেকে শুরু করে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত কমতে থাকে। গত চার বছরের মধ্যে সময়ের ব্যতিক্রম ছিল ২০২০ সাল। ওই বছর অক্টোবর থেকে নভেম্বরেও বাড়ে ডেঙ্গু রোগী। কমে আসে ডিসেম্বরে। ২০১৮, ১৯ এবং ২১ সালের ডেঙ্গু পরিস্থিতি বিবেচনা করে এবার আগাম সতর্ক করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ।

২০১৯ সালে দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি ছিল খুবই ভয়াবহ। এক মাসের মধ্যে পরিস্থিতি অনেকটা অস্বাভাবিক হয়ে যায়। উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন সংশ্লিষ্টরা। ভারত থেকে আসেন বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার একজন আঞ্চলিক কার্যালয়ের কর্মকর্তা। মশার উৎপত্তিস্থল ধ্বংস করাসহ তিনি কয়েকটি পরামর্শ দেন।

ওই বছর সরকারি হিসেবে ডেঙ্গুতে প্রাণ যায় ১৭৯ জনের। ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন। যা তার আগের বছর অর্থাৎ ১৮ সালের তুলনায় অন্তত ১০ গুণ বেশি। এরপর বেশি আক্রান্ত ও মৃত্যু হয়েছে ২০২১ সালে। প্রাণ গেছে ১০৫ জনের।

১৮ থেকে ২১ সাল, এই চার বছরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে- ১৮ সালে যে সংখ্যক আক্রান্ত হয়েছিল, ১৯ সালে তার কয়েকগুণ বেশি আক্রান্ত ও মৃত্যু হয়। ২০ সালে পরিস্থিতি কিছুটা ভালো থাকলেও ২১ সালে করোনা মহামারির মধ্যেও ডেঙ্গু পরিস্থিতি বেশ খারাপ হয়। ১৮ সালের তুলনায় ১৯ সালে যে পরিস্থিতি হয়েছিল, ২১ সালের তুলনায় ২২ সালেও যদি সেই পরিস্থিতি হয়, তাহলে ১৯ সালের ভয়াবহ পরিস্থিতি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ুগত কারণে এবার আবহাওয়া এডিশ মশার বিস্তারে অনেকটা অনুকূলে। সেজন্য আগাম সতর্ক করছে দেশের স্বাস্থ্য বিভাগ।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। বাতাসের আদ্রতা বেশি আছে। রোদের তাপ আছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমরা দেখছি এডিস মশার বংশ বৃদ্ধি হচ্ছে। আমরা মনে করি এডিশ মশার প্রজননের উৎকৃষ্ট সময় হচ্ছে এই সময়টি।

তিনি বলেন, এই সময় আমরা যদি একটু সতর্ক হই, এই সময়ে যদি নিজ নিজ বাসাবাড়িতে ফুলের টবসহ ঘরের ভেতরে বাইরে জমে থাকা পানি যদি আমরা পরিষ্কার না করি, মশারি ব্যবহার না করি তাহলে কিন্তু ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, আমরা সব সময়ই বলে আসছি মশার উৎপত্তিস্থল ধ্বংসের বিষয়ে। এডিশ মশা পরিষ্কার পানিতে জন্মায়। এই মশা যাতে বংশ বিস্তার করতে না পারে সেজন্য এর লার্ভার ধ্বংস করে ফেলতে হবে। এজন্য ব্যক্তি পর্যায়ে সচেতন হতে হবে। বাসাবাড়ির আশপাশে, বাড়ির ছাদে বেলকনিতে ফুলের টবে, নির্মাণাধীন বাড়ির যেসব জায়গায় পানি জমে থাকতে পারে সেগুলো দুই একদিন পর পর পরিষ্কার করতে হবে।

বিভিন্ন সময়ে মশা মারার কার্যক্রম গ্রহণ করার তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, আমরা বলে আসছি দুই তিনদিনের ক্রাস প্রোগ্রামের কথা। কারণ যখন এক এলাকায় মশার ওষুধ দেওয়া হয়, তখন মশা উড়ে আরেক এলাকায় চলে যায়। তাই সারা দেশে একসঙ্গে মশার ওষুধ দেওয়ার ক্রাশ প্রোগ্রাম হাতে নেওয়া। দুই ধরনের ওষুধ দিতে হবে। একসঙ্গে লার্ভা নষ্টের জন্য লার্বিসাইট এবং বড় মশা মারার জন্য ওষুধ দেওয়া। তাহলে হয়তো ভালো ফল পাওয়া যেতো। আরেকটা বিষয়, ফিল্ডে মশা মারার যে ওষুধ দেওয়া হয় সেই ওষুধের কার্যকারিতা পরীক্ষা করা।

বিভিন্ন সময়ে শোনা যায়, মশার ওষুধের বদলে অন্য কিছু আসে। সেগুলো যাতে না হয়, সেই বিষয়ে মনিটরিং করারও তাগিদ দেন তিনি।

গতকাল রোববার সকাল ৮ টা থেকে তার আগের ২৪ ঘণ্টায় দেশে ডেঙ্গু নিয়ে দু’জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। চলতি বছরে এ পর্যন্ত ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৭১ জন।

অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, সন্দেহজনক ডেঙ্গু জ্বরের রোগীদের পরীক্ষার জন্য এনএসওয়ান এন্টিজেন কিটের সরবরাহ আছে সিভিল সার্জন অফিসসহ সরকারি হাসপাতালগুলোতে। সেখানে পরীক্ষাগুলো হতে পারে। আমরা মনে করি চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করার পাশাপাশি আমাদের সতর্ক থাকাও প্রয়োজন আছে। আমাদের ঘরের আশপাশে যদি জমা পানি থাকে তা ফেলে দিতে হবে।

মাটিতে গর্ত থাকলে তা ভরাট করে দিতে হবে, যাতে সেখানে পানি জমে থাকতে না পারে। কেউ যদি নিজের বাসাবাড়ির বাইরে দীর্ঘদিনের জন্য কোথাও যেতে চান তাহলে বের হওয়ার আগে জমাপানি ফেলে দিতে হবে। ছাদবাগানের টবের পানি ফেলে দিতে হবে। কমোডের প্যানটিকে ঢাকনা দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে এডিস নির্মূলে আমাদের সকলের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ জরুরি। জমাপানি অবশ্যই তিনদিনে একদিন ফেলে দিতে হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে জানা যায়, ২০২১ সালে ১০৫ জনের মৃত্যু হয়। ২০২০ সালে মারা যায় সাতজন। ২০১৯ সালে সবচেয়ে বেশি মারা যায়, ১৭৯ জন। এর আগের বছর ২০১৮ সালে মারা যায় ২৬ জন।

২০১৮ সালে প্রথম পাঁচ মাসে ১৩৩ জন আক্রান্ত হয়। এর পরের সাত মাসে আক্রান্ত হয় ১০ হাজার ১৫ জন। এরমধ্যে জুনে ২৯৫ জন, জুলাইয়ে ৯৪৬ জন, আগস্টে ১ হাজার ৭৯৬ জন, সেপ্টেম্বরে ৩ হাজার ৮৭ জন, অক্টোবরে ২ হাজার ৪০৬ জন, নভেম্বরে ১ হাজার ১৯২ জন এবং ডিসেম্বরে ২৯৩ জন। মোট আক্রান্ত হয় ১০ হাজার ১৪৮ জন।

এ বছর প্রথম পাঁচ মাসে কেউ মারা যায়নি। পরবর্তী সাত মাসে ২৬ জনের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে জুনে ৩ জন, জুলাইয়ে ৪ জন, আগস্টে ৬ জন, সেপ্টেম্বরে ৪ জন, অক্টোবরে ৬ জন, নভেম্বরে ২ জন এবং ডিসেম্বরে ১ জনের মৃত্যু হয়।

গত ৪ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ও মৃত্যু হয় ২০১৯ সালে। এ বছর প্রথম ৫ মাসে ৩২৪ জন আক্রান্ত হয়। এপ্রিলে মারা যায় দু’জন। এরপর জুন থেকে বাড়তে শুরু করে। পরবর্তী সাত মাসে আক্রান্ত হয় ১ লাখ ১ হাজার ৩০ জন। এরমধ্যে জুনে ১ হাজার ৮৮৪ জন আক্রান্ত হয়। জুলাই মাসে কয়েকগুন বেড়ে ১৬ হাজার ২৫৩ জন আক্রান্ত হয়।

এর পরের মাসে আগস্টে জুলাইয়ের তিনগুন বেড়ে যায়, ৫২ হাজার ৬৩৬ জনের শনাক্ত হয়। সেপ্টেম্বরে আবার কমে আসে, আক্রান্ত হয় ১৬ হাজার ৮৫৬ জন। সেপ্টেম্বরের অর্ধেকে নামে অক্টোবরে, আক্রান্ত হয় ৮ হাজার ১৪৩ জন। নভেম্বরে আক্রান্ত হয় ৪ হাজার ১১ জন। ডিসেম্বরে আক্রান্ত হয় ১ হাজার ২৪৭ জন। এ বছর মোট আক্রান্ত হয় ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন।

এ বছর সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয় আগস্ট মাসে, ৯০ জন। এরপর বেশি মারা যায় জুলাই মাসে, ৪০ জন। সেপ্টেম্বরে ২৭ জন, অক্টোবরে ১১ জন, জুনে ৭ জন, এপ্রিল ও নভেম্বরে ২ জন করে মারা যায়।

২০২০ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয় ১ হাজার ২০৬ জন। বেশি আক্রান্ত হয় অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে। অক্টোবরে ১৬৪ জন, নভেম্বরে ৫৪৬ জন এবং ডিসেম্বরে ২৩১ জন।

২০২১ সালের প্রথম ছয় মাসে ডেঙ্গুতে কারো মৃত্যু হয়নি। পরবর্তী ছয়মাস জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১০৫ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। জুলাই মাসে মৃত্যু হয় ১২ জনের, আগস্টে সবচেয়ে বেশি মারা যায়, ৩৪ জন। সেপ্টম্বরে ২৩ জন, অক্টোবরে ২২ জন, নভেম্বরে সাতজন, ডিসেম্বরে ৭ জনের মৃত্যু হয়।

ওই বছরে ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয় ২৮ হাজার ৪৫১ জন। এরমধ্যে প্রথম ছয়মাসে ভর্তি হয় ৩৭২ জন। এর পরের ছয়মাসে ভর্তি হয় ২৮ হাজার ৫৭ জন। এরমধ্যে জুলাইয়ে ২ হাজার ২৮৬ জন, আগস্টে ৭ হাজার ৬৯৮ জন, সেপ্টেম্বরে সবচেয়ে বেশি, ৭ হাজার ৮৪১ জন, অক্টোবরে ৫ হাজার ৪৫৮ জন, নভেম্বরে ৩ হাজার ৫৬৭ জন এবং ডিসেম্বরে ১ হাজার ২০৭ জন।

মন্তব্য

Beta version