উচ্চরক্তচাপের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি বরিশালে, কম সিলেটে। চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে ঢাকা। সারা দেশে ৩৫ বছর ও তদূর্ধ্ব জনগোষ্ঠীর মধ্যে উচ্চরক্তচাপের প্রকোপ নিয়ে সম্প্রতি করা এক জরিপে উঠে এসেছে এসব তথ্য। বরিশালে প্রকোপ বেশির পেছনে জলবায়ুর প্রভাব থাকতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
অপর এক ছোট জরিপে পটুয়াখালীতে উচ্চরক্তচাপ বেশি পাওয়ার কথা জানিয়েছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে হাইপারটেনশনসহ কী কী সমস্যা উপকূলীয় এলাকায় বাড়ছে, তা খতিয়ে দেখতে সার্ভে করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোথায় কেমন প্রকোপ, তা দেখার জন্য জেলায় জেলায় জরিপ করা প্রয়োজন। জরিপে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সেই অনুযায়ী এলাকাভিত্তিক ব্যবস্থা নেওয়া।যেখানে কম সেখানে প্রতিরোধে জোর দেওয়া, আর যেখানে বেশি সেখানেও প্রতিরোধের সাথে সাথে সব রোগীকে চিকিৎসার আওতায় আনা।
ব্র্যাক জেমস পি গ্রান্টস স্কুল অব পাবলিক হেলথের সেন্টার ফর নন কমিউনিকেবল ডিজিজ অ্যান্ড নিউট্রিশন বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মলয় কান্তি মৃধা বলেন, ‘আমরা ২০১৮ সালে একটি জরিপ করেছি। বাংলাদেশে বিভিন্ন বিভাগে দেখেছি যে উচ্চরক্তচাপের পিভিলেন্স বিভিন্ন রকমের। উচ্চরক্তচাপের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে বরিশালে। এরপর চট্টগ্রামে, তারপর ময়মনসিংহে। ঢাকার অবস্থার চতুর্থ। আমাদের কিন্তু এটা বিস্মিত করেছে। বরিশালে আমরা পেয়েছি ২৫ শতাংশ মানুষের উচ্চরক্তচাপ। চট্টগ্রামে ২৩ দশমিক ৫ শতাংশ, ময়মনসিংহে ২২ শতাংশ, ঢাকায় ২১ শতাংশ, রাজশাহী ২০ দশমিক ৬ শতাংশ, রংপুরে ১৮ দশমিক ৬ শতাংশ, খুলনা ১৮ দশমিক ২ শতাংশ ও সিলেটে ১৮ দশমিক ১ শতাংশ মানুষের উচ্চরক্তচাপ।
বরিশালে প্রকোপ বেশির পেছনে জলবায়ু পরিবর্তনের সম্পর্ক থাকতে পারে উল্লেখ করে অধ্যাপক ডা. মলয় কান্তি মৃধা বলেন, ‘উচ্চরক্তচাপের সাথে লবণের সম্পর্ক আছে। জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে। আমরা যে পানি খাচ্ছি, সেখানে লবণের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে।-এগুলো নিয়ে গবেষণা দরকার।’
জিএইচএআই বাংলাদেশ কান্ট্রি লিড মো. রূহুল কুদ্দুস বলেন, ‘প্রথমে স্কিনিং করতে হবে। স্কিনিংয়ে আসার পর যাদের আছে। তাদের সেই হিসেবে ট্রিটমেন্ট দেওয়া। আর যাদের নেই তাদের যাতে না হয় সে হিসেবে কী কী লাইফস্টাইল চেঞ্জ করতে হবে সে বিষয়ে আমরা বলব। প্রথম কাজ হচ্ছে সবাইকে স্কিনিংয়ের আওতায় নিয়ে আসা।’ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (জনস্বাস্থ্য অনুবিভাগ) সৈয়দ মজিবুল হক বলেন, ‘পটুয়াখালী এরিয়াতে ক্লাইমেট চেঞ্জের কারণে বর্তমান সময়ে কিন্তু হাইপার টেনশন অনেক বেড়ে গেছে। ক্লাইমেট চেঞ্জের কারণে আমাদের যে হাইপারটেনশন বাড়ছে, হাইপারটেনশনের কারণে যে ওই এরিয়াতে বিভিন্ন ধরনের রোগ দেখা দিচ্ছে, সেই বিষয়ে আমরা কাজ করছি।’
পটুয়াখালী সিভিল সার্জন ডা. এস এম কবির হাসান বলেন, ‘হাইপারটেনশন অনেক বেড়েছে। রোগী আগের তুলনায় বেশি পাওয়া যাচ্ছে। আগে যে বয়সিদের বেশি হাইপার টেনশন দেখা যেত, এখন তার চেয়ে অনেক কম বয়সি রোগী পাওয়া যাচ্ছে।’
২০১০ সালে এসটিইপিএসের জরিপ অনুযায়ী ২৫ বছরের ঊর্ধ্বে শহর এলাকায় ২১ দশমিক ১ শতাংশ পুরুষের এবং ১৮ দশমিক ৮ শতাংশ নারীর উচ্চরক্তচাপ ছিল। শহরের চেয়ে গ্রামাঞ্চলে এই হার বেশ কম ছিল। গ্রামে ১৫ দশমিক ৯ শতাংশ পুরুষের এবং ১৫ দশমিক ৯ শতাংশ নারীর উচ্চরক্তচাপ ছিল। ১৮ থেকে ৬৯ বছর বয়সিদের মধ্যে ১৭ দশমিক ৯ শতাংশ পুরুষের এবং ২৪ দশমিক ১ শতাংশ নারীর উচ্চরক্তচাপ ছিল।
দেশে উচ্চরক্তচাপের মাত্রা অনেক বেশি। পুরুষদের চেয়ে মহিলাদের মধ্যে মাত্রাটা এখন বেশি। দেশে জনসংখ্যার মধ্যে ৩ কোটি ২০ লাখ মানুষের উচ্চরক্তচাপ রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন- অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস যেমন, খাদ্যের সঙ্গে অতিরিক্ত লবণ (সোডিয়াম) গ্রহণ, স্যাচুরেটেড ফ্যাট এবং ট্রান্স ফ্যাটযুক্ত খাবার, তামাক ও অ্যালকোহল সেবন উচ্চরক্তচাপের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে থাকে। অস্বাস্থ্যকর জীবন-যাপনও উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বৃদ্ধি করতে পারে যেমনÑ শারীরিকভাবে কর্মঠ না থাকা, অপর্যাপ্ত ঘুম, অতিরিক্ত ওজন, মানসিক চাপ এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে ফলমূল ও শাকসবজি না খাওয়া। এছাড়াও পারিবারিকভাবে উচ্চরক্তচাপের ইতিহাস থাকলে, বয়স বাড়ার সাথে সাথে (৬৫ বছরের পরে) এবং ডায়াবেটিস বা কিডনি রোগের সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বৃদ্ধি পেয়ে থাকে।
বাংলাদেশে উচ্চরক্তচাপ পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। ‘বাংলাদেশ এনসিডি স্টেপস সার্ভে, ২০১৮’ অনুযায়ী ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে জনগোষ্ঠীর মধ্যে ২১ শতাংশ (নারী ২৪.১ শতাংশ, পুরুষ ১৭.৯ শতাংশ) উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত এবং এদের মধ্যে ওষুধ গ্রহণের মাধ্যমে রোগটি নিয়ন্ত্রণে রেখেছে মাত্র ১৪ শতাংশ অর্থাৎ প্রতি ৭ জনে একজনেরও কম।
অন্যদিকে ‘বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে ২০১৭-১৮’ অনুযায়ী, ২০১১ থেকে ২০১৭-১৮ সাল সময়ের মধ্যে, ৩৫ বছর ও তদূর্ধ্ব জনগোষ্ঠীর মধ্যে উচ্চ রক্তচাপের প্রকোপ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে, পুরুষের মধ্যে ২০ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩৪ শতাংশে এবং নারীর ক্ষেত্রে এই হার ৩২ শতাংশ থেকে ৪৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা রয়েছে এমন নারী এবং পুরুষের মধ্যে উচ্চরক্তচাপে আক্রান্ত হওয়ার হার যথাক্রমে ৪৯ শতাংশ এবং ৪২ শতাংশ, যেখানে স্বাভাবিক ওজনের নারী এবং পুরুষের মধ্যে এই হার যথাক্রমে ২৫ শতাংশ এবং ২৪ শতাংশ । উচ্চরক্তচাপে আক্রান্ত ৫১ শতাংশ এবং ৬৭ শতাংশ পুরুষই জানে না যে তাদের উচ্চরক্তচাপ রয়েছে। উচ্চরক্তচাপে আক্রান্ত ৬৪ শতাংশ রোগী কোনো ওষুধ সেবন করে না।
উচ্চরক্তচাপের তেমন কোনো লক্ষণ না থাকায় রোগী সহজে বুঝতে পারে না। তাই ১৮ বছরের পর থেকে প্রতি বছর ব্লাড পেশার মেপে দেখার পরামর্শ দিয়েছেন ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্স ইনস্টিটিউটের উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ প্রোগ্রামের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. শামীম জোয়াদ্দার।
মন্তব্য