গত ১৩ বছরে দেশে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত ও মৃত্যু হ্রাসের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। এই সময়ে ম্যালেরিয়াজনিত অসুস্থতার হার ৯৪% এবং মৃত্যু ৯৩% কমেছে। একসময়ের এই প্রাণঘাতী রোগটি প্রতিরোধে ব্যাপক সাফল্য এসেছে। তবে ওষুধ-প্রতিরোধী ম্যালেরিয়ার কোনো ঘটনা বাংলাদেশে পাওয়া না গেলেও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ওষুধ প্রতিরোধী ম্যালেরিয়ার প্রকোপ থাকায় বাংলাদেশও এই ঝুঁকিতে আছে বলে আশঙ্কা জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের। আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবস। দিবসটির এবারের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়Ñ ‘উদ্ভাবনী কাজে লাগাই, ম্যালেরিয়া রোধে জীবন বাঁচাই’।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার (ম্যালেরিয়া ও এডিসবাহিত রোগ) ডা. ইকরামুল হক ভোরের আকাশকে বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল কার্যক্রমের আওতাধীন দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ১৬টি জেলার ৭২টি উপজেলায় ম্যালেরিয়ার প্রকোপ রয়েছে। রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান - এই তিন পার্বত্য জেলায় ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত ও মৃত্যুহার সর্বাধিক। তিনটি জেলাকে উচ্চ ম্যালেরিয়া প্রবণ অঞ্চল হিসেবে গণ্য করা হয়। গ্লোবাল ফান্ড টু ফাইট এইডস, টিবি অ্যান্ড ম্যালেরিয়ার আর্থিক সহায়তা বাংলাদেশে ম্যালেরিয়া কার্যক্রমকে আরো সম্প্রসারিত, শক্তিশালী ও গতিশীল করেছে। বাংলাদেশে ম্যালেরিয়া নির্মূলের জন্য জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল কার্যক্রমের সঙ্গে ব্র্যাকসহ ৪টি এনজিওর সমন্বয়ে গঠিত একটি কনসোর্টিয়াম যৌথ অংশীদারিত্বের মাধ্যমে কাজ করছে।
ডা. একরামুল হক আরো বলেন, ম্যালেরিয়া প্রবণ অঞ্চলে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় ম্যালেরিয়ার চিকিৎসা সেবা বিনামূল্যে প্রদান করা হচ্ছে। গত ২০০৮-২০২১ সালে দেশে ম্যালেরিয়া রোগীর সংখ্যা ও ম্যালেরিয়ায় মৃত্যু হ্রাসের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। ২০২১ সালে বাংলাদেশে ম্যালেরিয়া রোগীর মোট সংখ্যা ছিল ৭,২৯৪ জন, ও মারা গেছেন ৯ জন। উচ্চ ম্যালেরিয়া প্রবণ তিন পার্বত্য জেলাতেই মোট ম্যালেরিয়া রোগীর ৯৪ শতাংশ পাওয়া গেছে। ম্যালেরিয়া নির্মূলের আওতাধীন ময়মনসিংহ ও সিলেট অঞ্চলের ৮টি জেলায় মোট ম্যালেরিয়া রোগীর সংখ্যা ছিল মাত্র ১০ জন। আশা করা যাচ্ছে, এই জেলাগুলোতে ম্যালেরিয়া নির্মূলের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে।
ডা. একরামুল হক বলেন, ১১ জেলায় ম্যালেরিয়া শূন্যের পথে। দেশের ১৩ জেলার ৭২টি উপজেলা ম্যালেরিয়া প্রবণ এলাকা। এই ১৩ জেলার মধ্যে ১১টি জেলায় ম্যালেরিয়া প্রায় শূন্যের পথে। এখন শুধু তিন পার্বত্য জেলাতেই ম্যালেরিয়ার সংক্রমণ রয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশের বাকি ৫১ জেলায় ম্যালেরিয়া নেই। এসব জেলাকে এন্ডেমিক বা স্থানীয় পর্যায়ে সংক্রমিত জেলা বলে। এই জেলাগুলোকে ম্যালেরিয়ামুক্ত জেলা বলা হয়। ১১ জেলায় ম্যালেরিয়া শূন্যের কোটায়। এসব জেলায় খুবই সামান্য দুই-একটা রোগী আছে, যারা অন্য জেলা থেকে ইমপোর্টেড, স্থানীয় সংক্রমণ নয়।
এদিকে, ওষুধ-প্রতিরোধী ম্যালেরিয়ার ঝুঁকিতে বাংলাদেশ রয়েছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ওষুধ-প্রতিরোধী ম্যালেরিয়ার কোনো ঘটনা এখনো বাংলাদেশে পাওয়া যায়নি। তবে, লাওস, কম্বোডিয়াসহ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ওষুধ প্রতিরোধী ম্যালেরিয়ার প্রকোপ থাকায় বাংলাদেশও এই ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, বাংলাদেশে এখন মোট ১৩টি জেলায় ম্যালেরিয়ার প্রকোপ রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক পর্যায়ে রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাগুলো। দেশে রোগীদের মাঝে এখনো ওষুধ-প্রতিরোধী কোনো ম্যালেরিয়ার লক্ষণ পাওয়া যায়নি। তবে, লাওস, কম্বোডিয়াসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ওষুধ প্রতিরোধী ম্যালেরিয়ার প্রকোপ থাকায় বাংলাদেশও এই ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আরো জানায়, মিয়ানমারে প্রায় চার কোটি মানুষ বসবাস করছে ম্যালেরিয়া ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায়। শুধু তাই নয়, সেখানে ওষুধ-প্রতিরোধী ম্যালেরিয়ারও প্রকোপ দেখা যাচ্ছে। মিয়ানমারের সঙ্গে সীমানা সম্পর্কিত দেশ হওয়ায় চীন, ভারত ও থাইল্যান্ডও রয়েছে বেশ ঝুঁকিতে। এ ছাড়া কম্বোডিয়া, লাওস ও ভিয়েতনামেও ইতোমধ্যেই ওষুধ-প্রতিরোধী ম্যালেরিয়ার প্রকোপ রয়েছে।
এদিকে ম্যালেরিয়ার লক্ষণ ও প্রতিকার সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক, ইউজিসি অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ ভোরের আকাশকে বলেন, ম্যালেরিয়া বিশ্বের প্রাচীনতম এবং পরজীবীবাহী ভয়ংকর জীবনসংহারী ব্যাধি। প্রতি বছর এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশে অসংখ্য মানুষ এ সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। ম্যালেরিয়া হচ্ছে মশক বাহিত প্লাজমোডিয়াম পরজীবী দ্বারা সৃষ্ট রোগ। এটি কেবল সংক্রমিত স্ত্রী অ্যানোফেলিস মশার কামড়ে হয়।
এ পর্যন্ত ষাটের অধিক প্রজাতির ম্যালেরিয়া পরজীবী আবিষ্কার করা সম্ভব হলেও এর মধ্যে ৪টি প্রজাতি মানুষের ম্যালেরিয়ার জন্য দায়ী। প্লাজমোডিয়াম ভাইভাক্স, ফ্যালসিপ্যারাম, ম্যালেরি ও ওভাল-এর যেকোনো একটি জীবাণু বহনকারী মশার দংশনে ম্যালেরিয়া হতে পারে। এর মধ্যে ফ্যালসিপ্যারাম ম্যালেরিয়ার জটিলতা সবচেয়ে বেশি, এমনকি মস্তিষ্ক আক্রান্ত করে জীবনসংহারী হতে পারে। সংক্রমিত মশা যখন কোনো ব্যক্তিকে কামড়ায়, তখন ওই ব্যক্তির রক্তে ম্যালেরিয়ার জীবাণু প্রবেশ করে এবং সে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়।
লক্ষণ সম্পর্কে ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, নির্দিষ্ট সময় পরপর কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসা এই রোগের প্রধান লক্ষণ। জ্বর সাধারণত ১০৫-১০৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত হতে পারে। তবে নিয়মিত ও নির্দিষ্ট বিরতিতে জ্বর আসা-যাওয়া করে যেমন- একদিন পর পর জ্বর, তা তিন চার ঘণ্টা দীর্ঘ হওয়া এবং এরপর ঘাম দিয়ে জ্বর কমে যায়। জ্বর ছেড়ে গেলে শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়েও কমে যেতে পারে।
এ ছাড়াও মাঝারি থেকে তীব্র কাঁপুনি বা শীত শীত অনুভব, গায়ে প্রচণ্ড ব্যথা, মাথাব্যথা, অনিদ্রা, খাবারের প্রতি আগ্রহ কমে যাওয়া বা ক্ষুদামন্দা, কোষ্ঠকাঠিন্য, বমিবমি ভাব অথবা বমি, হজমে গোলযোগ, অত্যধিক ঘাম হওয়া, খিঁচুনি, পিপাসা লাগা, ক্লান্তি বা অবসাদ অনুভব করা, মাংসপেশি, তলপেটে ব্যথা অনুভব, প্লীহা ও যকৃৎ বড় হয়ে যাওয়াসহ লোহিত রক্তকণিকা ধ্বংস হওয়ার কারণে অ্যানিমিয়া বা রক্তশূন্যতা দেখা দেয়। ম্যালেরিয়া রোগের জটিলতম ধরণ হলো ‘ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া’।
সাধারণ ম্যালেরিয়ার মতো উপসর্গ দেখা দেওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের জটিলতা যেমন রক্তশূন্যতা, কিডনি বৈকল্য, শ্বাসকষ্ট হওয়া, জণ্ডিস, খিঁচুনি, রক্তে গ্লুকোজ কমে যাওয়ার লক্ষণ প্রকাশ পায়। জরুরি চিকিৎসা না পেলে এসব রোগী অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে, এমন কি মৃত্যুও হতে পারে। ম্যালেরিয়া সন্দেহ হলে প্রথমবার পরীক্ষায় যদি ম্যালেরিয়ার কিছু না পাওয়া যায়, তবে পর পর তিন দিন পরীক্ষাটি করা উচিত। যদি ম্যালেরিয়া শনাক্ত হয়, তাহলে দেরি না করে বা উদ্বিগ্ন না হয়ে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।
মন্তব্য