সামনে বর্ষাকাল। বর্ষা একইসঙ্গে এডিস মশার বিস্তারের সময়, আরেকভাবে বলা যায় ডেঙ্গু রোগের মৌসুম। কিন্তু, রাজধানীতে তার আগেই এই গরমের সময়েও এডিস মশার বিস্তার দেখা যাচ্ছে। এ মশার বিস্তার এখনই ঠেকানো না গেলে ভরা মৌসুমে এবার ভয়াবহতার আশঙ্কা করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
রাজধানীতে এক জরিপে দেখা গেছে, ডেঙ্গুর বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে দুই সিটি করপোরেশনের ২২টি ওয়ার্ড। এর মধ্যে উত্তর সিটিতে ৮টি এবং দক্ষিণ সিটিতে ১৪টি। দক্ষিণ সিটির ১৪ ওয়ার্ডের মধ্যে তিন ওয়ার্ড বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
বুধবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পুরাতন ভবনের সভাকক্ষে প্রাক মৌসুম এডিস জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করেন জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিস বাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. মো. একরামুল হক। সেখানে এসব তথ্য জানানো হয়।
তিনি জানান, এ জরিপে দেখা গেছে, মশার ঘনত্ব পরিমাপক সূচক সর্বোচ্চ ব্রুটো ইনডেক্স পাওয়া গেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ২০ ও ৩২ নং ওয়ার্ডে ১৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ। ৬ নং ওয়ার্ডে ১৩ দশমিক ০৪ শাতংশ। ১০, ১৩, ১৬, ২৭, ৩০ ও ৩৫ নং ওয়ার্ডে ১০ শতাংশ।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ৪৫, ৩৮ ও ৪০ নং ওয়ার্ড। ৪৫ নং ওয়ার্ডে ঘনত্ব ২৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ। ৩৮ ও ৪০ নং ওয়ার্ডে ২০ শতাংশ। ২১ নং ওয়ার্ডে ১৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ। ১৫ ও ২৩ নং ওয়ার্ডে ১৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ। ১৩ নং ওয়ার্ডে ১১ দশমিক ১১ শতাংশ। ৮, ১৪, ২০, ৩৫, ৪৬ ও ৫১ নং ওয়ার্ডে ১০ শতাংশ।
এবার যাতে কোনো বড় ধরনের বিপর্যয় না হয় সেজন্য আগাম সতর্ক করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এরই অংশ হিসেবে ঢাকার দুই সিটিতে প্রাক মৌসুম এডিস সার্ভে পরিচালনা করা হয়।
এই জরিপে দেখা গেছে, রাজধানীতে যে মশা রয়েছে তার মধ্যে ৫ শতাংশ এডিস মশা। বাকিগুলোর মধ্যে বেশি কিউলেক্স মশা। এডিসের প্রজনন বেশি নির্মাণাধীন ভবনে। এরপর বেশি বহুতল ভবনে। পজিটিভ কনটেইনারের মধ্যে মশার বেশি লার্ভা মেঝেতে জমানো পানিতে; এরপর বেশি প্লাস্টিকের ড্রাম, বালতি ও পানির ট্যাংকে। ফুলের টব, মেটাল ড্রাম, প্লাস্টিক মগ, পাত্র, বদনায়ও পাওয়া গেছে এডিসের লার্ভা।
জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিস বাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. মো. একরামুল হক জানান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার ২০টি টিম ঢাকা দুই সিটি করপোরেশনে ৮০টি ফাঁদ পেতে ২ হাজার ৬৭১টি কিউলেক্স মশা এবং ১৪৩টি এডিস মশা পায়। তাতে দেখা গেছে ঢাকা শহরে ৫ শতাংশ এডিস মশা রয়েছে। উত্তর সিটির চেয়ে দক্ষিণ সিটিতে এডিস মশা বেশি। উত্তরের ৪০ ফাঁদে ধরা পড়েছে ৩৭টি এডিস মশা এবং দক্ষিণের ৪০ ফাঁদে ধরা পড়েছে ১০৬টি মশা।
তিনি বলেন, জরিপে সর্বাধিক পজিটিভ কনটেইনারের মধ্যে মেঝেতে জমানো পানিতে সর্বোচ্চ ২৩.৯৮ শতাংশ, প্লাস্টিক ড্রাম ২১.৬৪ শতাংশ, প্লাস্টিক বালতি ১৪.০৪ শতাংশ, পানির ট্যাংকি (সিমেন্ট) ১০.৫৩ শতাংশ, ফুলের টব ৪.০৯ শতাংশ, মেটাল ড্রাম- ২.৩৪ শতাংশ, প্লাস্টিক মগ, পাত্র, বদনা ২.৩৪ শতাংশ, পানির ট্যাংক (প্লাস্টিক) ২.৩৪ শতাংশ এবং অন্যান্য ৪.০৯ শতাংশ মশার লার্ভা পাওয়া গেছে।
এডিস মশার পজিটিভ প্রজনন স্থানের প্রাপ্যতার ভিত্তিতে পজিটিভ বাড়ির শতকরা হার নির্মাণাধীন ভবনে ৪২.১১ শতাংশ, বহুতল ভবনে ৩১.৫৮ শতাংশ, একক ভবনসমূহে ১৫.২০ শতাংশ, সেমিপাকা/বস্তি এলাকায় ৯.৯৪ শতাংশ, এবং পরিত্যক্ত (ফাঁকা) জমিতে ১.১৭ শতাংশ মশার লার্ভা দেখা গেছে।
দুই সিটি করপোরেশনের ৯৮ ওয়ার্ডে ১১০টি স্থানে গত ২৩ মার্চ থেকে ৩ এপ্রিল পর্যন্ত ১০ দিনের এই ‘প্রাক মৌসুম এডিস সার্ভে-২০২২’ পরিচালনা করা হয়। সার্ভে শেষে পজিটিভ বাড়িগুলোর ঠিকানাসহ তথ্য সিটি করপোরেশনকে অবহিত করা হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ বি এম খুরশীদ আলম বলেন, এ জরিপে দেখা গেছে, যেসব কারণে এই মশাগুলো বাড়ছে তার বেশির ভাগই মানুষের তৈরি। মানুষের তৈরি বলে সেটা প্রিভেন্টেবল। ইচ্ছা করলে সেটা প্রিভেন্ট করা যায়। কোভিডের ক্ষেত্রে যা হয়েছে, আমরা জানতেই পারিনি কোথায় সোর্স, কীভাবে আসছে। এখন কোভিডের যে পরিস্থিতি আমরা মনে করি অনেকখানি ভালো অবস্থায় আমরা আছি। এটা ধরে রাখতে হবে আমাদের।
তিনি বলেন, ঠিক তেমনই করে আবার এখন যদি ডেঙ্গু বাড়ে এবং ডেঙ্গুজনিত মৃত্যু বাড়ে, তাহলে আবার আমাদের স্বাস্থ্যের এই স্বাভাবিক সেবা আবার ব্যাহত হবে। কমিউনিকেবল ডিজিসের চেয়ে নন কমিউনিকেবল ডিজিসের সংখ্যা বেশি এবং সেই রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাও বেশি। তাহলে পরে কোভিডের সময় যেরকম করে তাদের স্বাস্থ্যসেবাটা ব্যাহত হয়েছিল আবারো তাই ঘটবে। কারণ আমাদের সব মনোযোগ যাবে ডেঙ্গুরোগীর পেছনে। তাই আমাদের এখনই এডিস মশার বিস্তার প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
মন্তব্য