জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রোগীদের দেহে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ক্ষমতা বেড়ে যাওয়া নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা চলছে। জীবাণুর বিরুদ্ধে প্রথাগত অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করছে না। মানবদেহে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ক্ষমতা বৃদ্ধি মানবসভ্যতার জন্যই বিরাট হুমকি। এবার মৎস্য ও গবাদিপশুর খামারেও ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিক মানুষের দেহের অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। বিশ্বে যে পরিমাণ অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি হচ্ছে তার অর্ধেকই ব্যবহৃত হয় গবাদিপশু উৎপাদনে, যা মানুষকে ব্যাপক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ফেলছে। এছাড়া বিভিন্ন কারণে বিশ্বে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জটিল আকার ধারণ করেছে।
* মুরগি ও মাছের মাধ্যমেও অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করছে মানুষ
* রোগ-জীবাণুর বিরুদ্ধে প্রথাগত অ্যান্টিবায়োটিক কাজে আসছে না
* মাত্রাতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিকে ২০৫০ সালে ভয়াবহ সংকটে পড়বে দেশ
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী বলতে এমন এক অবস্থাকে বোঝায়, যখন কতিপয় ব্যাকটেরিয়া অ্যান্টিবায়োটিকের আক্রমণ থেকে বেঁচে থাকার ক্ষমতা অর্জন করে। এসব ব্যাকটেরিয়াকে বলা হয় অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ ব্যাকটেরিয়া। এরা অ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতিতেও স্বাভাবিক গতিতে বেড়ে উঠতে ও বংশবিস্তার করতে পারে। এতে মানুষ বা পশুর শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায়। আগে যে অ্যান্টিবায়োটিকে রোগ সেরে যেত, সেই অ্যান্টিবায়োটিকে তা সারে না বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনায় বলা হয়েছে। মানবদেহে একের পর এক অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর হয়ে পড়ার বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনায় রয়েছে।
এ ঝুঁকির মাত্রা আরো কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে মৎস্য ও গবাদিপশুর খামারে অ্যান্টিবায়োটিকের অবাধ ব্যবহার, যা পরবর্তীতে মানদেহে প্রবেশ করে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী বাড়িয়ে দিচ্ছে। অ্যান্টিবায়োটিক নিয়ে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালের রোগীদের ওপর একটি গবেষণা পরিচালনা করে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)।
দেশের সরকার স্বীকৃত গবেষণাগারে এসব পরীক্ষা করা হয় বলে জানায় পবা। পবার গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, মানবদেহে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ক্ষমতা বৃদ্ধি মানবসভ্যতার জন্যই বিরাট হুমকি। শরীরে অপরিকল্পিত অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার এর অন্যতম কারণ। মুরগি ও মাছের খামারেও ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিকে এসব ঝুঁকি বাড়ছে।
বিষয়টি জনস্বাস্থ্যের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ এবং সব দেশের সরকার ও সমাজকে এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বিভিন্ন হাসপাতালের ওষুধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বে যে পরিমাণ অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি হচ্ছে, তার অর্ধেকই ব্যবহৃত হয় গবাদিপশু উৎপাদনে, যা মানুষের জন্য ব্যাপক স্বাস্থ্যঝুঁকি বয়ে আনছে। এভাবে বিভিন্ন কারণে বিশ্বে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জটিল আকার ধারণ করেছে। ফার্স্টফুডের বার্গার, স্টেক বা গরুর দুধ এগুলোর বেশিরভাগই আসে এভাবে উৎপাদিত প্রাণী থেকে।
এসব খাবার খাওয়ার ফলে মানুষের সাধারণ শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করার মাত্রা কমে যাচ্ছে। চিকিৎসা ব্যবস্থাকে ব্যয়বহুল করে তোলার পাশাপাশি অকালে মৃত্যু ডেকে আনছে। বাংলাদেশে গবাদিপশু উৎপাদনে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার কতটা রয়েছে এবং তা মানবদেহের জন্য কী ধরনের ক্ষতি ডেকে আনতে পারে এ সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক ভোরের আকাশকে বলেন, সমস্যাটা হলো প্রাণী দেহের জীবাণুর কারণে যে অসুখ হবে, তার জন্য প্রাণী দেহের নির্দিষ্ট অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসা করতে হবে। কিন্তু এখন যেটা হচ্ছে মানুষের জন্য নির্দিষ্ট অ্যান্টিবায়োটিক, সেগুলো দিয়ে প্রাণীর চিকিৎসা করা হচ্ছে। মানবদেহের অ্যান্টিবায়োটিক বেশি মাত্রায় কড়া এবং নতুন ধরনের হয়ে থাকে। বলা আছে, মানবদেহের অ্যান্টিবায়োটিক যেন প্রাণীদের না খাওয়ানো হয়। কিন্তু এখন সেটাই করা হচ্ছে।
অধ্যাপক ফারুক আরো বলেন, ‘অনেক কোম্পানি আছে, যারা ফিস ফিড, ক্যাটেল ফিড, পোলট্রি ফিড তৈরি করার সময় অ্যান্টিবায়োটিক মিশিয়ে দিচ্ছে। সেখানে মানুষের চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিক এবং পশুর চিকিৎসার জন্য নির্দিষ্ট অ্যান্টিবায়োটিক মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ফলে জীবাণুর শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিট্যান্স তৈরি হচ্ছে।’
খাবারে অ্যান্টিবায়োটিক মিশিয়ে পশু মোটাতাজাকরণের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক আছে এর উত্তরে অধ্যাপক ফারুক বলেন, কোম্পানিগুলো বলছে সামান্য পরিমাণ অ্যান্টিবায়োটিক মিশিয়ে দেওয়ার ফলে গরু, মুরগি, মাছ রোগমুক্ত থাকবে, তাদের সুস্বাস্থ্য বজায় থাকবে এ বিষয়ে বৈজ্ঞানিক কোনো ভিত্তি নেই। কিন্তু ব্যবসায়িক দিক চিন্তা করে এ কাজটা করছে। শুধু আামদের দেশে নয়, সারা বিশ্বে ও খামারিরা সরল বিশ্বাসে এগুলো কিনে নিচ্ছে।
অধ্যাপক ফারুক বলেন, যেসব পশুকে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ানো হচ্ছে, সেই পশুর রক্তের সংস্পর্শে, পশুর সংস্পর্শে আমরা সংক্রমিত হতে পারি। আরেকটা বিষয় হলো, যেসব পশুর শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিট্যান্স জীবাণু তৈরি হয়েছে, তারা যে মলত্যাগ করছে, সেগুলো পরিবেশের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে এবং সেখান থেকে অন্যান্য জিন ট্রান্সফরমেশন ঘটছে। এভাবে একটা মহামারি ব্যাপার নীরবে ঘটে যাচ্ছে কিন্তু আমরা টের পাচ্ছি না। আমরা সে কারণে বলছি দুধ, মাছ, মাংস যাই খাই না কেন, এগুলোর মধ্যে সামান্য পরিমাণে অ্যান্টিবায়োটিক চলে আসছে। ফলে প্রধান ঝুঁকিটা হলো আমরা ওই অ্যান্টিবায়োটিক রেজিট্যান্স হয়ে যাই। এর ফলে সাধারণ সমস্যাগুলো অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে আর চিকিৎসা করা সম্ভব হবে না। আমরা আশঙ্কা করছি, একটা সময় আসবেÑ আমরা যদি এ সমস্যাগুলো বন্ধ না করি, তাহলে অতি সাধারণ সংক্রমণে মানুষ মারা যাবে।
অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে ওঠার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের বিজ্ঞ চিকিৎসকরাও। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ ভোরের আকাশকে বলেন, অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ বিশ্বব্যাপী অত্যন্ত সমাদৃত এবং চিকিৎসাক্ষেত্রে যার অবদান অবিস্মরণীয়। দুঃখের বিষয় হলেও সত্য, অপব্যবহারের কারণে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের ক্ষমতা কোনো কোনো জীবাণু ধ্বংসের ক্ষেত্রে অকার্যকর হয়ে যাচ্ছে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশেও অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার কম নয়। মানুষ কোনো রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হলেই প্রাথমিকভাবে তার নিকটবর্তী দোকান থেকে ওষুধ কিনে খেতে পারে। ওষুধ কিনতে কোনো বাধ্যবাধকতা না থাকায় এবং ডাক্তারের কোনো প্রেসক্রিপশন না লাগায় মানুষ সহজেই এ কাজ করছে। এটি হচ্ছে জনসচেতনতার অভাবে। ফলে অপরিমিত ও মাত্রাহীন ওষুধ খাওয়ার ফলে এর জীবাণুনাশক ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
অ্যান্টিবায়োটিকের অকার্যকারিতা রোধে এখনই ব্যবস্থা নেওয়া দরকার জানিয়ে রুহুল হক বলেন, এ বিষয়ে আইন আছে। কিন্তু আইন প্রয়োগ করাটাই হচ্ছে কঠিন কাজ। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের লোকবল বাড়ানো হলে এ বিষয়ে কিছুটা উন্নতি হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ ভোরের আকাশকে বলেন, অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের কারণে ২০৫০ সালে করোনার চেয়ে বেশি সংকটে পড়বে দেশ। মাত্রাতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ফলে ২০৫০ সালে দেশে করোনায় মৃত্যুর চেয়ে দ্বিগুণ মানুষের মৃত্যু হতে পারে। সবার স্বার্থে মাত্রাতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার রোধ করতে হবে। যততত্র অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি বন্ধ করতে হবে। রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া যাতে কোনো ফার্মেসি অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ বিক্রি করতে না পারে, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের এগিয়ে আসতে হবে।
মন্তব্য