-->
শিরোনাম

প্রভাবশালীদের তদবিরের চাপে সরকারি হাসপাতাল

নিখিল মানখিন
প্রভাবশালীদের তদবিরের চাপে সরকারি হাসপাতাল

ঢাকা: বাড়তি সুবিধা পেতে প্রভাবশালীদের তদবিরের চাপে থাকে সরকারি হাসপাতাল। এতে ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক চিকিৎসাসেবা। অসহায় ও দরিদ্রদের জন্য তদবির করার কেউ থাকে না। সরকারি হাসপাতালের বিনামূল্যের চিকিৎসাসেবা অনেকটা তদবিরবাজদের দখলে থাকে। প্রভাবশালীদের তদবির সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয় সরকারি হাসপাতালের কর্তাব্যক্তিদের। রাজধানীর সরকারি হাসপাতালগুলো সরেজমিন পরিদর্শনে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।

 

সরেজমিনে দেখা গেছে, হাসপাতালের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের প্রতিদিন তাৎক্ষণিক বাড়তি চিকিৎসা সুবিধা পেতে সুপারিশ ও তদবিরের মুখোমুখি হতে হয়। প্রভাবশালীদের তালিকায় রাজনীতিবিদ, মন্ত্রী-এমপি এবং আমলাদের সংখ্যাই বেশি। এ ছাড়া নানান সম্পর্কের ভিত্তিতেও তদবির চলে। সরকারি হাসপাতালের উচ্চমূল্যের সুবিধা বিশেষ করে আইসিইউ, কেবিন, ব্যয়বহুল পরীক্ষা ও চিকিৎসা উপকরণ এবং সেবাযত্ন অনেকটা নানা কৌশলে তদবিরবাজদের দখলে চলে যায়।

 

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের স্বাস্থ্য খাতের সেবা-বৈষম্য প্রকট হচ্ছে। সামাজিক অবস্থান ও শ্রেণি-বৈষম্যের কারণে ধনী ও দরিদ্ররা সরকারি ব্যবস্থাপনায় একই ধরনের সেবা পান না। অনেক ক্ষেত্রে সব শ্রেণির মানুষের সরকারি ব্যবস্থাপনার সেবা পাওয়ার ধরন ও মান এক নয়। আবার দরিদ্ররা অর্থের অভাবে বেসরকারি সেবাও পাচ্ছেন না। সামাজিক বৈষম্যের কারণে দরিদ্র পরিবারে স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় বেশি হতে পারে। যার আর্থিক অবস্থা ভালো, সব ব্যবস্থাপনার সেবা তার জন্য ভালো। যার আর্থিক অবস্থা খারাপ তার জন্য কোনো ব্যবস্থাপনাই নেই।

 

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আরো বলছেন, দেশের ক্ষুদ্র আয়তন ও সীমিত সম্পদের বিপরীতে রয়েছে জনসংখ্যার বিস্ফোরণ। ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে রয়েছে আকাশচুম্বী বৈষম্য। স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি ও ভোগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন শ্রেণির জনগোষ্ঠীর মধ্যে বড় ধরনের পার্থক্য রয়েছে। কিছু কিছু অসমতা এতটাই তীব্র ও প্রতিকূল যে, সমষ্টিগতভাবে তা দেশের অগ্রগতির অন্তরায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য খাতে অর্জিত সাফল্য টিকিয়ে রাখাই কষ্টকর বলে মন্তব্য করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। গত ২৭ সেপ্টেম্বর সড়ক দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত হন মো. আবুল কাশেম (৩৩)। ফলোআপ করাতে এসেছেন জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল)। গুলশান থানার নদ্দা এলাকায় তার বাসা। একটি ফ্যাক্টরিতে সিকিউরিটি গার্ডের কাজ করেন তিনি।

 

পরিবারটির আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। আবুল কাশেমের ছেলে মো. ইয়াকুব আলী ভোরের আকাশকে জানান, গত ২৫ আগস্ট বাবাকে রাজধানীর পঙ্গু হাসাপাতালের জরুরি বিভাগে নেয়া হয়। এক ওয়ার্ডবয়কে কিছু টাকা দিয়ে বাবাকে গণওয়ার্ডে ভর্তি করানো হয়। বেডে নয়, দুই বেডের মাঝখানেই বাবাকে শুয়ে দেয়া হয়। গণওয়ার্ডে থাকার সময় তেমন কোনো চিকিৎসাসেবা দেয়া হয়নি। তীব্র যন্ত্রণায় দিন পার করেছেন বাবা। আর্থিক সামর্থ্য না থাকায় বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারিনি। চার দিন পর গণওয়ার্ড থেকে নির্ধারিত ওয়ার্ডে বাবাকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেও ডাক্তার ও নার্সদের ভালো আচরণ পাইনি। অনেক কাকুতি-মিনতি করে বাবাকে অপারেশন করানোর সুযোগ পেয়েছি বলে জানান মো. ইয়াকুব আলী।

 

একই হাসপাতালে এক ঘণ্টার ব্যবধানে বিপরীত চিত্র পাওয়া গেছে প্রভাবশালী পরিবারের রোগীর ক্ষেত্রে। অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে এলো অ্যাডভোকেট আব্দুস সাত্তারকে। পড়ে গিয়ে একটি পা ও একটি হাত ভেঙে গেছে তার। নগরীর শুক্রাবাদ এলাকায় তার বাড়ি। একটি রাজনৈতিক দলের ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতা। রোগীর লোকজনের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেলাম না। তবে রোগীর চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা লক্ষ্য করতে ভুল করিনি। স্বল্প সময়ের মধ্যে জরুরি বিভাগের কাজ সম্পন্ন করে রোগীকে সোজা নির্ধারিত ওয়ার্ডে পাঠিয়ে দেয়া হয়। তাকে গণওয়ার্ডে রাখা হয়নি। কেবিনে রাখার জন্য দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিয়েছেন রোগীর লোকজন। মো. আবুল কাশেম ও অ্যাডভোকেট আব্দুস সাত্তার দুজনই রোগী, কিন্তু তাদের চিকিৎসাসেবা প্রদানের ক্ষেত্রে দেখা গেছে ভিন্ন ভিন্ন ব্যবস্থাপনা। এভাবে প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে প্রতিদিন ধনী ও দরিদ্রদের চিকিৎসেবা প্রদানে সরকারি ব্যবস্থাপনায় সামাজিক অবস্থান ও শ্রেণি- বৈষম্যভেদে পার্থক্যের চিত্র ফুটে উঠেছে।

 

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সম্প্রতি পরিচালিত এক গবেষণা প্রতিবেদনেও দেশের স্বাস্থ্য খাতের সেবা-বৈষম্য ফুটে উঠেছে। রাজধানীর ৩ হাজার ১০০ পরিবারের ১২ হাজারের বেশি ব্যক্তির অসুস্থতা, স্বাস্থ্যসেবা নেয়ার ধরন ও ব্যয় বিশ্লেষণের ভিত্তিতে বিআইডিএস গবেষকরা জানান, দেশের স্বাস্থ্য খাতে বৈষম্য প্রকট হচ্ছে। স্বাস্থ্যসেবা খাতে রাজধানীর বাসিন্দাদের গড় মাসিক ব্যয় আয়ের ৮ শতাংশ। তার মধ্যে অতিদরিদ্র পরিবারগুলোর ব্যয় হচ্ছে মাসিক আয়ের ৩৩ শতাংশ। দরিদ্র পরিবার ব্যয় করছে ১৩ শতাংশ। তাছাড়া মধ্যম আয়ের পরিবার ৮ দশমিক ৩ শতাংশ, ধনীরা ৭ দশমিক ৪ ও অতিধনীরা ৫ দশমিক ২ শতাংশ মাসিক আয় স্বাস্থ্যসেবার জন্য ব্যয় করছে। চর্মরোগ, নিউমোনিয়া, ডেঙ্গু, গুটিবসন্ত, টাইফয়েড, জ¦রের মতো সংক্রামক ও অসংক্রামক তীব্র অসুস্থতা, ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, গ্যাস্ট্রিক, আলসার, অ্যাজমা, হৃদরোগ, কিডনি রোগ, রক্তস্বল্পতা, জন্ডিস, ক্যান্সারের মতো দীর্ঘমেয়াদি এবং কোমর্বিডিটিতে আক্রান্তদের তথ্য গবেষণার আওতায় আনা হয়েছে।

 

গবেষকদের অন্যতম এবং বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ ড. আবদুর রাজ্জাক সরকার জানান, গবেষণায় মূলত রাজধানীর নাগরিকদের স্বাস্থ্যসেবার বাড়তি ব্যয় দেখার চেষ্টা করা হয়েছে। সরকারিভাবে যে সুবিধা রয়েছে তার বাইরে চিকিৎসা, ওষুধ, রোগ নির্ণয় ও যাতায়াত খরচ ওই বাড়তি ব্যয়ের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। হতদরিদ্র পরিবারের আয়ের অনুপাতে খরচের হার সবচেয়ে বেশি। ওসব পরিবারের আয়ের এক-তৃতীয়াংশই স্বাস্থ্যসেবার বাড়তি খরচ হয়। আর হতদরিদ্র পরিবারগুলো খরচ মেটাতে গিয়ে প্রায়ই বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ছে। চিকিৎসাসেবা গ্রহণে পদে পদে তাদের প্রতিকূল পরিস্থিতিরি মুখোমুখি হতে হচ্ছে।

 

জাতীয় স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব জানান, সামাজিক অবস্থান ও শ্রেণি-বৈষম্যের কারণে ধনী ও দরিদ্ররা সরকারি ব্যবস্থাপনায় একই ধরনের সেবা পান না। অনেক ক্ষেত্রেই সব শ্রেণির মানুষের সরকারি ব্যবস্থাপনার সেবা পাওয়ার ধরন ও মান এক নয়। আবার ওই দরিদ্ররা অর্থের অভাবে বেসরকারি সেবাও পাচ্ছেন না। সামাজিক বৈষম্যের কারণে দরিদ্র পরিবারে স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় বেশি হতে পারে। যার আর্থিক অবস্থা ভালো, সব ব্যবস্থাপনার সেবা তার জন্য ভালো। যার আর্থিক অবস্থা খারাপ তার জন্য কোনো ব্যবস্থাপনাই নেই।

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক ড. মুনীরউদ্দিন আহমদ বলেন, দরিদ্রদের বিড়ম্বনার শেষ নেই। অসহায়, নিরীহ, দরিদ্র মানুষ সুস্থতা ও বেঁচে থাকার তাগিদে ছুটে যান সরকারি হাসপাতালে ন্যূনতম চিকিৎসা লাভের আশায়। বহির্বিভাগের রোগীরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও চিকিৎসকের দেখা পান না। চিকিৎসক পেলেও ওষুধ-পথ্য পান না। রোগীদের গাঁটের পয়সা খরচ করে দোকান থেকে বেশিরভাগ ওষুধ কিনতে হয়। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রথম দিন থেকেই রোগীরা অবজ্ঞা, অবহেলা, অযত্ন ও দুর্ব্যবহারের শিকার হন বলে মন্তব্য করেন ড. মুনীরউদ্দিন আহমদ।

 

স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের(স্বাচিপ) মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ ভোরের আকাশকে বলেন, নামমাত্র খরচে বিভিন্ন জটিল রোগের চিকিৎসা পাওয়া যায় সরকারি হাসপাতালে। একই রোগের চিকিৎসা পেতে বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে গুনতে হয় অনেক বেশি টাকা। তিনি আরো জানান, প্রভাবশালীদের তদবির সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয় সরকারি হাসপাতালের কর্তাব্যক্তিদের। তবে দরিদ্র ও অসহায় রোগীদের অধিকাংশই সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা সুবিধা পেয়ে থাকেন। প্রভাবশালীদের কিছু সুবিধা দেয়া হলেও সাধারণ রোগীদের চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত করা হয়।

 

ভোরের আকাশ/আসা

মন্তব্য

Beta version