ঢাকা: অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে অভিযান নিয়ে চলছে লুকোচুরি খেলা! ঘোষণা দিয়ে অভিযানে নেমে সফলতা পাচ্ছে না স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঘোষণা দিয়ে কয়েকদিনের অভিযানে অবৈধ ও অনিবন্ধিত চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম থামানো যাবে না। থানা থেকে বিভাগীয় পর্যায় পর্যন্ত নিয়মিত অভিযান চালাতে হবে। বন্ধ করে দেয়া অবৈধ প্রতিষ্ঠান আবার চালু করা হয়েছে কিনা তা মনিটরিং করতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসন ও প্রভাবশালীদের যোগসাজশে অবৈধ প্রতিষ্ঠানগুলো দেদার ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অভিযান এবং পরবর্তী অবস্থা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সরকারি নির্দেশনা মানছেন না অনিবন্ধিত চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের মালিকরা। গত আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে ঢাকঢোল পিটিয়ে অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে কয়েক দফা অভিযানে নামে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। কিন্তু বিগত বছরগুলোর অভিযানের মতোই এবারো তেমন সফলতা আসেনি। অভিযানে বন্ধ করে দেয়া চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোর পূর্ণাঙ্গ তালিকা পর্যন্ত প্রকাশ করতে পারেনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। অবৈধ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে কঠোর নির্দেশনা বহুবার দিয়েছে অধিদপ্তর। কিন্তু তাদের গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নে হতাশ হয়েছে দেশবাসী। নির্দেশনা দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেন সংশ্লিষ্টরা। বছরের পর বছর ধরে অনিবন্ধিত অসংখ্য চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। তাই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমন নির্দেশনার ওপর দেশবাসী আস্থা রাখতে পারছে না বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন বিশেষজ্ঞরা।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সারাদেশে অলিগলিতে চিকিৎসাসেবার নামে অবাধে অবৈধ ব্যবসা করে যাচ্ছে অসংখ্য অনিবন্ধিত হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক। এসব অবৈধ প্রতিষ্ঠানে সরকারি নিয়ন্ত্রণ থাকে না। বিভিন্ন সময় দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা ও অবৈধ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের মালিকদের যোগসাজশ ও লেনদেনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। কোথাও কোথাও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের অনুমোদন নিয়ে সাজিয়ে বসেছে হাসপাতাল ও ক্লিনিকের ব্যবসা। ভর্তি করা হয় রোগী। ভাড়া করে আনা হয় চিকিৎসক। মানহীন আইসিইউ সাজিয়ে চালায় রমরমা বাণিজ্য। এমন ফাঁদে পড়ে নানা হয়রানির শিকার হয়ে আসছে অনেক রোগী। সাইনবোর্ডসর্বস্ব এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়মনীতির বালাই নেই।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আরো জানান, জবাবদিহি না থাকায় অবৈধ ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে চলে অরাজকতা। থাকে না মানবতার উপস্থিতি। এসব সেন্টারে হাতুড়ে টেকনিশিয়ান দ্বারাই চালানো হয় রোগ নির্ণয়ের যাবতীয় পরীক্ষা। তারা মনগড়া রিপোর্ট তৈরি করে ঠকাচ্ছে নিরীহ মানুষকে। একই রোগ পরীক্ষায় একেকটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে একেক রকম রিপোর্ট পাওয়ার অনেক ঘটনা রয়েছে। রোগী মারার কারখানা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে অনেক ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এসব সেন্টার থেকে প্রাপ্ত রিপোর্ট নিয়ে রোগী ও তাদের স্বজনরা চরম বিভ্রান্তিতে পড়েন। নানা সমালোচনার মধ্যেও সরকারি হাসপাতালের একশ্রেণির ডাক্তারের সহায়তায় ডায়াগনস্টিক সেন্টার মালিকদের যথেচ্ছ টেস্টবাণিজ্য চলছে বছরের পর বছর। ডায়াগনস্টিক প্রতারণার শিকার মানুষজন বারবার অভিযোগ তুলেও প্রতিকার পাচ্ছেন না।
সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে অবৈধ বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক বন্ধ করা প্রসঙ্গে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সাংবাদিকদের বলেন, যেসব স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান সঠিক নিয়মে সেবা দেয় না, তাদের কাজ করতে দেবে না সরকার। জনগণের স্বাস্থ্য নিয়ে কেউ ছিনিমিনি খেলবে, ব্যবসা করবে, এটি তারা হতে দেবেন না।
কাগজে-কলমে বন্ধ থাকলেও বাস্তবে অনেক বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক চলছে। সাংবাদিকদের দেয়া এমন তথ্যের পরিপ্রেক্ষিতে জাহিদ মালেক বলেন, আমরা সেটা দেখব। যেগুলো সঠিক যন্ত্রপাতি ও জনবল না থাকার কারণে বন্ধ করা হয়েছে, সেগুলো যদি আবারো তা পূরণ না করে থাকে, তাহলে বন্ধ রাখা হবে, বন্ধ করে দেয়া হবে। কোনো প্রতিষ্ঠানকে যে কারণে বন্ধ করা হয়েছিল, সেগুলো পূরণ না করে যদি আবার শুরু করে, তাহলে বন্ধ করার ব্যবস্থা হবে বলে জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
আগের অভিযানে যেসব চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হয়েছিল, সেগুলোর মধ্যে কোনোটা এবারের অভিযানের সময় চালু অবস্থায় পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) বেলায়েত হোসেন বলেন, অনেকগুলোই পাওয়া গেছে। সেগুলো আবার বন্ধ করে দিয়েছি। তিন মাস আগে আমরা যে অভিযান চালিয়েছিলাম তখন সাড়ে ১৬শ অবৈধ হাসপাতাল ও ক্লিনিক বন্ধ করে দিয়েছিলাম। আর এবারের অভিযানে সাড়ে আটশ অবৈধ হাসপাতাল ও ক্লিনিক বন্ধ করেছি। এগুলো আমরা নজরদারির মধ্যেই রেখেছি বলে জানান পরিচালক।
অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার উচ্ছেদকরণে সরকারের কঠোর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন বাংলাদেশ ফার্মাসিউটিক্যালস কাউন্সিলের সাবেক সভাপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক। তিনি ভোরের আকাশকে বলেন, অভিযুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা উচিত। অবৈধভাবে গড়ে ওঠা শত শত হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার দেশের স্বাস্থ্যসেবার জন্য চরম হুমকি। ওইসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অনৈতিক কাজ সম্পাদনের অভিযোগও পাওয়া যায়।
তিনি আরো বলেন, দেশের ভালো ভালো, হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক উঠিয়ে দেয়া ঠিক হবে না। তবে ওই প্রতিষ্ঠানগুলোরও উচিত চিকিৎসাসেবা দেয়ার সময় মানবিক দিক বিবেচনা করা। রোগীদের কাছ থেকে চড়া ফি আদায় করা ঠিক হবে না। দেশের ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মধ্যে খারাপের সংখ্যাই বেশি বলে তিনি মনে করেন। নির্ধারিত ফি আদায়ের ব্যাপারে অধ্যাপক আ ব ম ফারুক আরো বলেন, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ভাগ করে ফি নির্ধারণ করা উচিত। আর বিভিন্ন ক্লিনিকে সরকারি ডাক্তারের সঙ্গে রোগী পাচারের প্রথা বন্ধ করার দাবি জানান তিনি।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব ভোরের আকাশকে বলেন, অবৈধ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে এ ধরনের নির্দেশনা বহুবার দিয়েছে অধিদপ্তর। কিন্তু তাদের গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নে হতাশ হয়েছে দেশবাসী। নির্দেশনা দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেন সংশ্লিষ্টরা। বছরের পর বছর ধরে অনিবন্ধিত অসংখ্য চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। দেশের নিরাপদ জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি ভেবে দেশের অবৈধ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত বলে জানান ডা. রশিদ-ই মাহবুব।
ভোরের আকাশ/আসা
মন্তব্য