-->

করোনা সিন্ডেমিকের মধ্যে ডেঙ্গুর প্রকোপ

শাহীন রহমান
করোনা সিন্ডেমিকের মধ্যে ডেঙ্গুর প্রকোপ

ঢাকা: চিকুনগুনিয়া, ডেঙ্গু, করোনা হয়ে আবার ডেঙ্গু সার্কেলে ঘুরপাক খাচ্ছে দেশ। ২০১৭ সাল থেকে চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ দেখা দেয়। ১৯ সালে ডেঙ্গু। সর্বশেষ করোনা সিন্ডেমিক সারা বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছে।

 

স্বাস্থ্য অধিপ্তরের দেয়া তথ্যমতে, ২০২০ সালের মার্চের পর থেকে এখন পর্যন্ত (গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত) দেশে করোনা আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা ২০ লাখ ৩৩ হাজার ৬৬২ জন। এতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ২৯ হাজার ৪১১ জন। করোনা সিন্ডেমিকের মধ্যে আবার দেখা দিয়েছে ডেঙ্গুর প্রকোপ।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা সিন্ডেমিকের উৎস নিয়ে বিতর্ক থাকলেও চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গুর প্রকোপের পেছনে রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঘটনা। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এবার থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে, যা ডেঙ্গুর জন্য দায়ী এডিস মশা প্রজননের জন্য সহায়ক। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অনেক সময় পরিবেশই এই ভাইরাসগুলো সংক্রমণের সহায়ক হয়ে ওঠে। আর এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্তরা শক সিন্ড্রোমে মারা যাচ্ছেন বেশি। কারণ তারা দেরিতে হাসপাতালে যাচ্ছেন। মেডিকেলের ভাষায়, শরীরের ভেতরে রক্তক্ষরণকে শক সিন্ড্রোম বলা হয়।

 

চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ দেখা দেয় ২০১৭ সালে। ওই বছর রাজধানীতে নতুন এক ধরনের জ্বর ছড়িয়ে পড়ে। জ্বর শেষে রোগীকে অনেক দিন ধরে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। হাতে-পায়ে ব্যথা নিয়ে কর্মক্ষম মানুষের দীর্ঘদিন ঘরে বন্দি থাকতে হয়েছিল। শিশু থেকে বৃদ্ধ কেউই এ রোগ থেকে বাদ পড়েননি। পরে চিকিৎসরা এই জ্বরকে চিকুনগুনিয়া বলে শনাক্ত করে।

 

সরকারের রোগতত্ত্ব ও রোগনিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের দেয়া তথ্য অনুযায়ী ২০১৭ সালের মে মাস থেকে মাত্র সাড়ে চার মাসে ঢাকায় বিভিন্ন হাসপাতালে চিকুনগুনিয়ার চিকিৎসা নিয়েছে ১৩ হাজার আটশ’র বেশি মানুষ। এর বাইরে দুই সিটি করপোরেশনে চিকিৎসা সেবা নিয়েছে অনেকে। তবে এমন বহু মানুষ আছেন যারা চিকিৎসা নেই, জেনে হাসপাতাল বা চিকিৎসকের দ্বারস্থ হয়নি। ওই বছর চিকুনগুনিয়া নানা বয়সের মানুষের মাঝে যেভাবে ছড়িয়ে পড়ে, তা রীতিমতো আতঙ্কজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। একই পরিবারের একাধিক মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হন।

 

এ ঘটনার স্মৃতিচারণ করে ঢাকার এক বাসিন্দা বলেন, হাঁটতে পারছিলাম না, বসতে পারছিলাম না। নামাজও পড়তে পারছিলাম না। হাতে, আঙুলে, পায়ে, পায়ের তলা, গাঁটে গাঁটে প্রচণ্ড ব্যথা। দাঁড়ালে বসতে পারিনি, বসলে শুতে পারিনি- এমন অবস্থা। এমনকি প্রস্রাব-পায়খানা করতে কমোডে বা প্যানে বসতেও কষ্ট হচ্ছিল। আমি ভয় পেয়ে গেলাম, ভাবলাম আমি কি পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে গেলাম?

 

২০১৮ সালে শুরু হয় ভয়াবহ ডেঙ্গুজ্বরের প্রকোপ, যা সারাদেশের মানুষকে আতঙ্কিত করে তোলে। ২০১৯ সালে দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি মহামারি আকার ধারণ করে। ওই বছর আগস্টের শেষে এক দিনে সারাদেশে প্রায় ২ হাজার জনের ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হওয়ার খবর দেয় সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নির্ণয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। এমনও ঘটনা ঘটেছে যে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে মৃত এক সন্তানকে পিতা সমাহিত করার জন্য গ্রামে নিয়ে গেছেন। অন্য সন্তানকে হাসপাতালে দেখাশোনা করছিলেন মা।

 

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নির্ণয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এর দেয়া তথ্যমতে ২০১৯ সালে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব মূলত এপ্রিল মাসে শুরু হয়। ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব সমগ্র বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল।

 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মতে,  ২০১৯ সালের ১ আগস্ট পর্যন্ত ১৪ জন মারা যায়। বেসরকারি হিসাব মতে, একশজনের বেশি মৃত্যু হয়েছিল। এ ছাড়া ১৯ হাজার ৫১৩ জন আক্রান্ত হয়, যার বেশিরভাগই শিশু। সরকারি তথ্যে প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ৭১ জন ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হওয়ার খবর দেয়া হয়। আক্রান্ত অঞ্চলের মধ্যে ঢাকা জেলা এবং ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়। দেশে ২০০০ সালে সর্বপ্রথম ডেঙ্গুজ্বর দেখা দেয়। দাবি করা হয়েছিল সেই বছর ৯৩ জন মারা গেছে। ৩ বছর পরে মৃত্যুর সংখ্যা ধীরে ধীরে প্রায় শূন্যে নেমে আসে। তবে এটি আবার ২০১৮ সালে ফিরে আসে, এতে ২৬ জন মারা যায় এবং ১০ হাজার ১৪৮ জন আক্রান্ত হয়। ২০১৮-এর আগে সর্বোচ্চ আক্রান্ত লোকের সংখ্যা ছিল ২০০২ সালে ৬ হাজার ২৩২ জন। এ বছর আরও ভয়াবহ রূপ নিয়ে ফিরেছে ডেঙ্গু।

 

করোনা; যা কোভিড-১৯ নামে পরিচিত। এর উৎসস্থান হিসেবে চীনের উহান শহর বেশ পরিচিত। অভিযোগ রয়েছে, চীনের উহানের একটি গবেষণা ল্যাব থেকে এটি বাইরে ছড়িয়ে পড়ে। পরে সারাবিশ্বেই সিন্ডেমিক আকার ধারণ করে। বাদ যায়নি বাংলাদেশও।

 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, শুক্রবার পর্যন্ত সারাবিশ্বে করোনায় আক্রান্ত হয়েছে ৬৩ কোটি ২১ লাখ ৫০ হাজার ৯৭০ জন। মৃত্যু হয়েছে ৬৫ লাখ ৮০ হাজার ১৮২ জনের। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী দেশে এখন পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ২০ লাখ ৩৩ হাজার ৬৬২ জন। আর এই রোগে মারা গেছেন ২৯ হাজার ৪১১ জন।

 

২০১৯ সালে চীনের উহানে করোনার উৎপত্তি। দেশে এ রোগে প্রথম শনাক্ত হয় ২০২০ সালের ৮ মার্চ। ওই দিন প্রথমবারের মতো তিনজন আক্রান্ত বলে খবর দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ১৮ মার্চ এই রোগে প্রথম একজনের মৃত্যু হয়। রাজধানীর টোলারবাগের একজন বাসিন্দা করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রথম মৃত্যুবরণ করেন। বর্তমানে করোনায় ভয়াবহতা অনেকটা কমেছে। কাজকর্ম স্বাভাবিক হয়েছে। কিন্তু এই রোগ থেকে প্রতিরোধের উপায় হিসেবে সারাদেশে কয়েক দফায় সরকারকে লকডাউন দিতে হয়েছিল।

 

করোনা সিন্ডেমিকের মধ্যে দেশে দেখা দিয়েছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। গত সেপ্টেম্বর থেকেই শুরু হয়েছে। বর্তমানে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। ডেঙ্গু এখন চরম আতঙ্কের পর্যায়ে পৌঁছেছে। দেশে অক্টোবর মাসের ১৫ দিনে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৩৪ জন মারা গেছেন। গত সেপ্টেম্বর মাসে ৩০ দিনে মারা গেছেন ২৪ জন। এমন পরিস্থিতিতে ডেঙ্গু এখন চরম আতঙ্কজনক পর্যায়ে আছে।

 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২১ অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২৯ হাজার ১০৭ জন। এর মধ্যে সুস্থ হয়ে ২৫ হাজার ৭৯০ জন হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন। এ বছর ২১ জুন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে প্রথম মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। এ বছর ১ জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ১১০ জনের।

 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক আহমেদুল কবির বলেন, এবার ডেঙ্গু আক্রান্তদের অধিকাংশ ডেন-থ্রি সেরোটাইপ বা ডেঙ্গুর ‘তৃতীয়’ ধরনে আক্রান্ত। কোথাও কোথাও ডেন-ফোরের উপস্থিতও পাওয়া যাচ্ছে বলে তিনি জানান। মূলত যারা আগে এক বা একাধিকবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন, তারা ডেন-থ্রি এবং ডেন-ফোরে আক্রান্ত হচ্ছেন। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই পরিস্থিতি জটিল রূপ নেয়ায় রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হচ্ছে। যারা মারা যাচ্ছেন, তাদের বেশিরভাগই ডেন-থ্রি ও ডেন-ফোরে আক্রান্ত বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।

 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এই অতিরিক্ত মহাপরিচালক জানিয়েছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আগে যেখানে ডেঙ্গু হয়নি, সেখানেও এখন ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। তাছাড়া হাসপাতালে আসা বেশিরভাগ রোগী আগেও এক বা একাধিকবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ছিলেন। তাই এবারের লক্ষণগুলো প্রকট।

 

ভোরের আকাশ/আসা

মন্তব্য

Beta version