ঢাকা: মশা মারতে কামান দাগার কথা সবারই জানা। তবে এটি প্রচলিত প্রবাদবাক্য হলেও দেশে মশা দমনে এখন পর্যšত্ম তেমন সফলতা পায়নি সরকার। মশা দমনে সিটি করপোরেশনের ব্যর্থতা নিয়েও কম সমালোচনা হয়নি। এরই মধ্যে ডেঙ্গু মশার প্রাদুর্ভাব যেন ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দেখা দিয়েছে। ডেঙ্গু মশা দমনে সরকার অনেকটা হিমশিম খাচ্ছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এডিসসহ মশা-মাছি দমনে দেশে একটি উৎকৃষ্ট পদ্ধতি হলো বায়োলজিক্যাল কন্ট্রোল বা প্রাকৃতিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা।
তারা বলেন, আগের দিনে মানুষ মশা নিয়ন্ত্রণে রাসায়নিক উপায়ের ওপর কম নির্ভর করত। প্রকৃতিকে কাজে লাগিয়েই তারা নিজেদের মশার কামড় থেকে রড়্গা করত। এখন সময় এসেছে মশা নিয়ন্ত্রণে এসব জ্ঞান ব্যবহারের। দেশে ২০০০ সালে প্রথম ডেঙ্গুজ্বর দেখা দেয়। দাবি করা হয়, ওই বছর ৯৩ জন মারা গেছেন। ৩ বছর পর মৃত্যুর সংখ্যা ধীরে ধীরে প্রায় শূন্যে নেমে আসে। তবে এটি আবার ২০১৮ সালে ফিরে আসে। ২০১৯ সালে ডেঙ্গু মশার প্রাদুর্ভাব ভয়াবহ আকার ধারণ করে। ২ বছর পার হতে না হতেই আবার শুরম্ন হয়েছে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবারের প্রাদুর্ভাব ২০১৯ সালের ভয়াবহতাকেও হার মানাচ্ছে। তবে সরকার এটি নিয়ন্ত্রণে জন্য বসে নেই। সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, রাজধানীসহ দেশের ৫০ জেলায় ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে। এটি আশঙ্কাজনক হারে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। তবে আশার কথা হচ্ছে, এর চিকিৎসারও পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রয়েছে। তিনি এ-ও উলেস্নখ করেন, শুধু চিকিৎসার মাধ্যমে ডেঙ্গু মোকাবিলা সম্ভব নয়। এজন্য সিটি করপোরেশনসহ স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে আরো জোরালোভাবে কাজ করতে হবে। একইসঙ্গে সাধারণ মানুষকে আরো বেশি সচেতন ও দায়িত্ববান হতে হবে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাসায়নিক পদ্ধতির পাশাপাশি বায়োলজিক্যাল কন্ট্রোলে ডেঙ্গু মশা প্রতিরোধ করা সম্ভব। এ পদ্ধতিতে গাঁদাফুল, তুলসীপাতা, পুদিনাপাতা, ব্যাজল, সিট্রোনেলা, লেমন গ্রাস, ল্যাভেন্ডার ইত্যাদি উদ্ভিদ ব্যবহারে কার্যকরভাবে এডিস মশা প্রতিরোধ করা সম্ভব। পাশাপাশি গাপ্পিমাছও মশার নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা রাখে।
তারা বলেন, মশা-মাছির উপদ্রব দেশে নতুন নয়। সুদূর প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ মশা নিয়ন্ত্রণে নানা পদ্ধতি ব্যবহার করে আসছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু মশার প্রাদুর্ভাব মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এবার থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে, যা ডেঙ্গুর জন্য দায়ী এডিস মশার প্রজননের জন্য সহায়ক। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অনেক সময় পরিবেশই এ ভাইরাসগুলো সংক্রমণের সহায়ক হয়ে ওঠে। আর এ বছর ডেঙ্গু আক্রাšত্মরা শক সিন্ড্রোমে মারা যাচ্ছেন বেশি। স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহম্মেদ কামরম্নজ্জামান মজুমদার বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন ও জীববৈচিত্র্যের প্রভাবে মশার বংশবি¯ত্মার হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী তাপাত্রা চরমে উঠেছে, ফলে মশাবি¯ত্মার বৃদ্ধি পেয়েছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, বায়োজিক্যাল কন্ট্রোল পদ্ধতি অর্থাৎ এসব উদ্ভিদের ব্যবহারের মাধ্যমে এডিস মশা প্রতিরোধ করা সম্ভব। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গাঁদাফুল দেশে একটি সহজলভ্য গাছ। প্রায় সব জায়গায় পাওয়া যায়। অথচ এটি মশা তাড়াতে দারম্নণ কার্যকর। এ ফুলের মনোমগ্ধকর ঘ্রাণে এটি সবার কাছে প্রিয় বটে, কিন্তু এ ফুলের রেণু ও পাপড়ি থেকে নিঃসৃত বিশেষ গন্ধ মশার জন্য অসহনীয়। ঘরে গাঁদাফুল রাখলে মশা-মাছি থাকে না। আবার ঠান্ডাজনিত সর্দির প্রকোপ থেকে রড়্গা পেতে অনেকে বাড়িতে তুলসীগাছ রোপণ করে থাকেন। এ গাছের ঔষধিগুণ ছাড়াও মশা নিয়ন্ত্রণে এটি বেশ কাজ করে থাকে। অধ্যাপক মজুমদার বলেন, ২০০৯ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে পুদিনার তেল মশার লার্ভার জন্য খুবই বিষাক্ত। এটি মশার ডিম সরবরাহের হার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এর তীব্র গন্ধ মশা দূরীকরণের বেশ ভূমিকা রাখে। অথচ আমরা অনেকেই পুদিনাপাতা সালাদ হিসেবে ব্যবহার করে থাকি। কিন্তু এটি মশা দূরে রাখতে সাহায্য করে থাকে। আর ব্যাজল হলো পুদিনাপাতা বা ধনেপাতার মতোই সুগন্ধযুক্ত লতাগুল্ম। ব্যাজলের পাতা খাবারের স্বাদ বাড়ানোর জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তবে এ গাছ মশা তাড়ানোর কাজ করে থাকে। কারণ ব্যাজলের গন্ধ মশা সহ্য করতে পারে না। সিট্রোনেলা এক ধরনের ঘাস জাতীয় উদ্ভিদ। এটি ৫-৬ ফুট পর্যšত্ম লম্বা হয়ে থাকে। এ ঘাস থেঁতলে তেল বা রস বের করে পানিতে মিশিয়ে ঘর মুছলে মশার উপদ্রব কমে।
ল্যাভেন্ডার এক ধরনের সুগন্ধি গাছ। এতে বেগুনি রঙের ফুল ধরে, যার সুগন্ধ মশার অপছন্দ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব উদ্ভিদ ছোট আকারের তাই সহজেই ঘরের আঙিনায় ফুলবাগানে বড় বাগানের ধারে, বারান্দা কিংবা জানালার পাশে টবে লাগানো যায়। ব্যাজল গাছের জন্য প্রচুর পানি ও সূর্যের আলো দরকার। যেখানে আলো আর পানি বেশি থাকবে, এটি সেখানে লাগাতে হবে। এ গাছে দেয়া পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখতে হবে। সিট্রোনেলা গাছেও পানি নিষ্কাশন ও আলোর ব্যবস্থা রাখতে হবে। তবে পুদিনা গাছকে সরাসরি সূর্যের আলো থেকে দূরে রাখতে হবে।
তারা বলেন, এসব গাছ টবে অন্য গাছের সঙ্গে লাগানো হয়, তবে ভুলবশত টবে যে পানি জমে থাকে, সেখানে আর মশার বংশবি¯ত্মার করতে পারবে না। ফলে একদিকে যেমন মশার উপদ্রব কমবে, তেমনি ঘর বা চারপাশের পরিবেশ সুন্দর থাকবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এসব গাছ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তারা বলেন, গাপ্পি মাছও মশার নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা রাখে। এ মাছ ছোট আকারের। কম অক্সিজেনযুক্ত ও অপেড়্গাকৃত দূষিত পানিতেও এ মাছ বেঁচে থাকতে পারে। এ মাছের গড় আয়ু ৩ থেকে ৪ বছর হয়ে থাকে। মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এ মাছ প্রতি ঘণ্টায় ২০০ মশার লার্ভা খেয়ে ফেলতে পারে। ডোবানালা, পুকুর, সুইমিংপুল, ড্রেন অ্যাকুরিয়ামের মধ্যেও এ মাছ চাষ করা যায়। এতে মশার উপদ্রব কমে।
গাপ্পি মাছ মশার জীবনচক্রের সব অবস্থাতেই (ডিম, শুক্রমূক, কীট এবং পূর্ণাঙ্গ মশা) খেয়ে ফেলতে পারে। আবার ঘরে ধূপ দেয়া হলে মশা থাকে না। অনেকে ঘরের মধ্যে নিমগাছের ডাল রেখে দেন। কখনো কখনো আবার নিম গাছের ডাল পোড়ানো হয় মশা তাড়াতে। আগের দিনে মশার উৎপাত থেকে মুক্তির জন্য বদ্ধঘরে কর্পূর পোড়ানো হতো। কর্পূর মশা তাড়াতে একটি কার্যকর উপাদান। এটি মশা তাড়াতে দীর্ঘসময় কাজ করে। গ্রামের মানুষ খোসাছাড়া রসুন বা রসুনমিশ্রিত পানি মশার বিষাক্ততা থেকে রড়্গার জন্য ব্যবহার করতেন। আগের দিনে মানুষ মশা নিয়ন্ত্রণে রাসায়নিক উপায়ের ওপর কম নির্ভর করত। প্রকৃতিকে কাজে লাগিয়েই তারা নিজেদের মশার কামড় থেকে রড়্গা করত। এখন সময় এসেছ মশা নিয়ন্ত্রণে এসব জ্ঞান ব্যবহারের।
ভোরের আকাশ/আসা
মন্তব্য