ময়মনসিংহ মেডিকেল

এক সপ্তাহে ৯৬ শিশুর মৃত্যু, ধারণ ক্ষমতার চেয়ে ভর্তি ৯ গুণ

আরিফ সাওন, ঢাকা ও জাহাঙ্গীর আলম, ময়মনসিংহ
এক সপ্তাহে ৯৬ শিশুর মৃত্যু, ধারণ ক্ষমতার চেয়ে ভর্তি ৯ গুণ

আরিফ সাওন, ঢাকা ও জাহাঙ্গীর আলম, ময়মনসিংহ: ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ (মমেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৯৬ শিশুর মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। গত এক সপ্তাহে মৃত ৯৬ শিশুর মধ্যে ৭৪টিই নবজাতক। যাদের বয়স ১ থেকে ২৮ দিনের মধ্যে। এত মৃত্যুর ঘটনা ঘটলেও এ বিষয়ে অবগত নয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। জেলা সিভিল সার্জন বলছেন, এত মৃত্যুর বিষয়ে তিনিও বোধগম্য নন। তবে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক বলছেন, বেশিরভাগ নবজাতক মারা যাচ্ছে জন্মগত সমস্যার কারণে।

 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ (মমেক) হাসপাতালের নবজাতক ও শিশু ওয়ার্ডে ৫০ জনের ধারণ ক্ষমতা থাকলেও সোমবার দুপুর ১টা পর্যন্ত ভর্তি ছিল ৪৪১ জন, যা ধারণ ক্ষমতার চেয়ে ৯ গুণ বেশি।

 

শুধু গত ২৪ ঘণ্টায় বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে ১৫৫ শিশু ভর্তি হয়েছে বলে জানিয়েছেন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. বিশ^জিৎ চৌধুরী।

 

জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার থেকে রোগীর চাপ বেশি। বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা থেকে শনিবার সকাল ১০টা পর্যন্ত ভর্তি হয় ৬২৩ জন। এত বেশি রোগী আসায় পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ৫০ জন ছাড়া অন্য রোগীদের বারান্দা ও মেঝেতে বিছানা পেতে সেখানে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। সংকট দেখা দিয়েছে চিকিৎসকদের। চিকিৎসায় সন্তুষ্ট না হয়ে অনেকেই চলে যাচ্ছেন বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে। আর যাদের সামর্থ্য বা সাধ্য নেই, তারাই থাকছেন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

 

সরেজমিন হাসপাতালের নবজাতক ও শিশু ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, নবজাতক ওয়ার্ডে ৫০ শয্যার বিপরীতে ২০৪ নবজাতককে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। ওয়ার্ডের বাইরে বারান্দায় দুশ্চিন্তা নিয়ে অপেক্ষা করছেন অভিভাবকরা ।

 

জাহানারা নামের এক অভিভাবক দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেন, ‘গত চার দিন ধরে নবজাতক নিয়ে ভর্তি আছি। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে ১২টার মধ্যে সিনিয়র চিকিৎসক এসে দেখে পরামর্শ দেন।’ তিনি অভিযোগ করে বলেন, বৃহস্পতিবার বিকেল থেকেই চিকিৎসক সংকট দেখা দেয়। ইন্টার্নি চিকিৎসক কিংবা দু-একজন জুনিয়র চিকিৎসক থাকলেও তাদের কাছ থেকে সবসময় পরামর্শ পাওয়া যায় না। যোগাযোগ করলে বলা হয় নার্সদের সঙ্গে কথা বলেন।

 

জয়নাল আবেদীন নামে আরেক অভিভাবক অভিযোগ করে বলেন, আমার ছেলের বয়স দুই মাস। ৫ দিন আগে তাকে ভর্তি করিয়েছি। নিয়মিত প্রস্রাব করছে না। শুক্রবার সারাদিন কোনো চিকিৎসক ছিল না। বৃহস্পতিবার বিকেল থেকেই অনেক রোগী ছুটি না নিয়ে বেসরকারি হাসপাতালে চলে গেছেন। শুক্রবার চিকিৎসক না থাকায় শিশুদের স্বজনরা শিশুদের নিয়ে চিন্তিত থাকেন।

 

সোমবার দুপুরে নবজাতক (এনআইসিইউ) বিভাগের চিকিৎসক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. নজরুল ইসলাম দৈনিক ভোরের আকাশকে জানান, গত ২৯ নভেম্বর থেকে ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত এক সপ্তাহে নবজাতক ওয়ার্ডে (এসআইসিইউ) এক হাজার ৩৫৩ শিশু ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে ৭৪ নবজাতকের মৃত্যু হয়েছে। হাসপাতালের নতুন ভবনের ছয়তলার ৩০ ও ৩১ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিয়েছে দুই হাজার ৮৭৭ শিশু। এর মধ্যে মারা গেছে ২২ জন। বর্তমানে (সোমবার দুপুর ১টা) ৪৪১ শিশু চিকিৎসাধীন।

 

ময়মনসিংহ সিভিল সার্জন ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, উপজেলায় পর্যায়ে মৃত্যুর কোনো খবর নেই। কিন্তু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এত মৃত্যু হচ্ছে কেন আমার বোধগম্য না। কয়েকদিন আগে আমি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নবজাতক ও শিশু ওয়ার্ডের প্রধান নজরুল ইসলাম স্যারের সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি আমার স্যার। তিনি বলেছেন, অনেক সময় দেখা যায় বিভিন্ন এলাকা থেকে ক্রিটিক্যাল অবস্থায় রোগী পাঠায়, শিশুদের যখন নিয়ে আসে তখন অনেক সময় দেখা যায় অক্সিজেন দিয়ে পাঠায় না। এক্ষেত্রে তাদের সাসটেইন করানো কঠিন হয়ে পড়ে।

 

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. বিশ্বজিৎ চৌধুরী বলেন, এ সময়ে প্রতিবছর রোগী বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে ঠাণ্ডাজনিত সমস্যা শিশুদের বেশি হয়। তিনি বলেন, এটা আমাদের কাছে নতুন নয়। আমরা সম্মিলিতভাবে পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছি।

 

এ বিষয়ে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল গোলাম কিবরিয়া বলেন, গড় হিসেবে ঢাকা-সিলেটের তুলনায় ময়মনসিংহে নবজাতক মৃত্যুর হার অনেক কম। যেসব নবজাতক মারা যাচ্ছে, তাদের বেশিরভাগ জন্মগত সমস্যার কারণে। বাড়িতে এবং বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে ডেলিভারি করানো নবজাতকদের এ সমস্যাটা বেশি।

 

তিনি বলেন, শয্যার তুলনায় নবজাতক এবং শিশু ওয়ার্ডে অতিরিক্ত রোগী ভর্তি থাকায় প্রতিনিয়ত সেবা দিতে আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। তারপরও আমরা কোনো রোগীকে ফেরত না পাঠিয়ে ভর্তি করে সাধ্যমতো সেবা দেয়ার চেষ্টা করছি।

 

এক সপ্তাহে এক মেডিকেলে এত নবজাতকের মৃত্যু হলেও এ বিষয়ে কিছু জানে না স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার খুরশীদ আলম বলেন, ‘ময়মনসিংহ থেকে এ বিষয়ে আমাদের এখনো অবহিত করা হয়নি। আমি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ (মমেক) হাসপাতালের পরিচালকের সঙ্গে কথা বলে এখনই যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করছি।’

 

ভোরের আকাশ/আসা

মন্তব্য