গ্রাম ছাড়াতে উদগ্রীব থাকেন সরকারি চিকিৎসকরা

নিখিল মানখিন
গ্রাম ছাড়াতে উদগ্রীব থাকেন সরকারি চিকিৎসকরা

নিখিল মানখিন: পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি লাভের জন্য পড়াশোনার পরিবেশ ও সুযোগ-সুবিধা নেই। ডিগ্রি অর্জন না করলে পদোন্নতি লাভের সুযোগ কম থাকে। প্রাইভেট প্র্যাকটিসের মাধ্যমে অর্থোপার্জনের সুযোগও কম। দক্ষতা অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসা অবকাঠামো নেই। গ্রামে অবস্থান করলে বড় চিকিৎসক হিসেবে পরিচিতি লাভের সুযোগ থাকে না।

 

রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের অহেতুক হস্তক্ষেপ। চিকিৎসকদের আবাসিক সুযোগ-সুবিধা পর্যাপ্ত নয়। গ্রামের মানুষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারেন না। সন্তানদের লেখাপড়া করানোর জন্য থানা পর্যায়ে ভালো স্কুল থাকে না। থানা ও গ্রাম পর্যায়ে যেতে আগ্রহ না থাকার পেছনে দৈনিক ভোরের আকাশকে এসব কারণ তুলে ধরেছেন অনেক সরকারি চিকিৎসক।

 

ভাগ্য বিড়ম্বনার শিকার হয়ে দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে গ্রামে অবস্থান করে চিকিৎসাসেবা প্রদান করে আসছেন ডা. মো. সাইফুল মিয়া। বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে মেডিকেল অফিসার হিসেবে কাজে যোগদান করেন। এখন তার বয়স ৫০ বছর পেরিয়ে গেছে। চাকরি জীবনের গত ১৮ বছরে তার পদোন্নতি হয়নি। মেডিকেল অফিসার হিসেবেই রয়ে গেছেন তিনি।

 

বর্তমানে তিনি ময়মনসিংহ বিভাগের একটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আছেন। গ্রামে থাকার কারণেই তার এমন অবস্থা বলে আক্ষেপ করেছেন ডা. মো. সাইফুল মিয়া। তিনি ভোরের আকাশকে জানান, চিকিৎসকদের গ্রামে আসতে না চাওয়ার পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। গ্রামে থাকার কারণে তিনি ঠিকমত পড়াশোনা করতে পারেননি।

 

পদোন্নতির পরীক্ষাগুলোয় সন্তোষজনক ফল আসেনি। অনেক সময় পাবলিক সার্ভিস কমিশনের বিভিন্ন বিজ্ঞপ্তি ও তথ্য যথাসময়ে পাননি। ফলে পদোন্নতির অনেক পরীক্ষায় তার অংশগ্রহণ করা হয়নি। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন তিনি। ১৮ বছর ধরে মেডিকেল অফিসার হয়েই আছেন। তিনি আরো জানান, থানা পর্যায়ে দক্ষতা বাড়ানোর সুযোগ-সুবিধা নেই।

 

গাইনির ওপর এক বছরের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন তিনি। অনুশীলনের চিকিৎসা অবকাঠামো না থাকায় প্রশিক্ষণে অর্জিত অভিজ্ঞতা তিনি ভুলে যেতে বসেছেন। গ্রামে থাকলে শহরের তুলনায় বেশি সময় সেবা দিতে হয়। গ্রামে থাকলে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করে অর্থোপার্জনের সুযোগও কম। আর উচ্চ ডিগ্রি গ্রহণের বিষয়টি চিন্তাই করা যায় না। দীর্ঘ ১৮ বছর গ্রামে সেবা দিলাম, বিনিময়ে কী পেলাম? ডা. সাইফুল মিয়ার চোখে মুখে ফুটে উঠে তার কর্মজীবনের কষ্ট ও আক্ষেপ।

 

গ্রামে থাকলে চিকিৎসকদের পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি এবং দক্ষতা অর্জনের ক্ষেত্রে সমস্যা হয় বলে মনে করেন ময়মনসিংহ বিভাগের আরেক উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত মেডিকেল অফিসার ডা. উজ্জ্বল সরকার। তিনি ভোরের আকাশকে জানান, থানা পর্যায়ে অবস্থান করে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি নেয়ার কোনো সুযোগ থাকে না। ডেপুটেশনে গিয়ে জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ের মেডিকেল কলেজগুলো থেকে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি অর্জন করতে হয়। বছরের পর বছর ধরে গ্রামে অবস্থান করলে লেখাপড়ার প্রতি আর মনোযোগ থাকে না।

 

তাছাড়া গ্রামে অবস্থা করে মেডিকেলের মতো জটিল বিষয়ে লেখাপড়া সম্ভব না। এতে জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে কর্মরত চিকিৎসকরা অনেক দূর এগিয়ে থাকে। পদোন্নতির ক্ষেত্রে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধার দিকে থেকে পিছিয়ে পড়েন গ্রামের চিকিৎসকরা। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আধুনিক মেডিকেল উপকরণ থাকে না। জটিল রোগী চিকিৎসা দেয়ার ব্যবস্থা না থাকায় অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগও নেই। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা থাকলে তাদের কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার সুযোগ হতো বলে আক্ষেপ প্রকাশ করেন ডা. উজ্জ্বল সরকার।

 

স্থানীয় প্রভাবশালী ও দলীয় নেতাকর্মীদের অশোভন আচরণ ও অতিরিক্ত ক্ষমতা প্রয়োগের কারণে অনেক চিকিৎসক গ্রামে থাকতে চায় না বলে অভিযোগ করেছেন কেউ কেউ।

 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ময়মনসিংহ জেলার একটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত এক চিকিৎসক ভোরের আকাশকে জানান, গ্রামে ন্যূনতম সম্মান পান না চিকিৎসকরা। স্থানীয় প্রভাবশালী ও দলীয় নেতাকর্মীরা অকারণে অশোভন আচরণ করেন। বাসায় গিয়ে চিকিৎসা দিয়ে আসতেও চিকিৎসকদের বাধ্য করেন অনেক নেতা। নিজেদের মনের মতো চিকিৎসা না পেলে শুরু করেন দুর্ব্যবহার। এমন পরিবেশে গ্রামে দুই বছর পার করাটাই অনেকের জন্য বেদনাদায়ক হয়ে উঠে বলে জানান ওই চিকিৎসক।

 

ডা. বেলায়েত হোসেন কর্মরত আছেন ময়মনসিংহ বিভাগের একটি উপজেলা স্বাস্থ্যকমপ্লেক্সে। তিনি ভোরের আকাশকে বলেন, পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি না থাকলে পদোন্নতি ঘটে না। থানা পর্যায়ে লেখাপড়ার পরিবেশ নেই। জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে থাকলে বিভিন্ন বেসরকারি মেডিকেল কলেজ, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকা যায়। এসব জায়গায় সম্পৃক্ত থাকলে খুব দ্রুত পরিচিতি ঘটে। দক্ষতা প্রমাণ করা এবং শেখার সুযোগও বেশি থাকে।

 

তিনি আরো জানান, থানা পর্যায়ে আবাসিক সমস্যা রয়েই যায়। নিরাপত্তা জোরদার থাকে না। যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করেও গ্রামের মানুষের মন জয় করা যায় না। অনেকেই ভুল বুঝে চিকিৎসকদের কষ্ট দিয়ে থাকেন বলে জানান ডা. বেলায়েত হোসেন। গ্রামে থাকার ব্যাপারে মানসিকতা পরিবর্তন করার ওপর জোর দিয়েছেন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সাবেক মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এম আজিজ। তিনি ভোরের আকাশকে বলেন, অনেকেই শহুরে জীবনযাপনে অভ্যস্ত। তারা গ্রামীণ পরিবেশে খাপ খাওয়াতে পারেন না। এখানে শহুরে জীবনের সুযোগ-সুবিধা থাকে না।

 

যেসব চিকিসক শহুরে ও গ্রামীণ জীবনের মধ্যে তুলনা করেন, তাদের পক্ষে গ্রামে অবস্থান করা কঠিন হয়ে পড়ে। ডা. আজিজ স্বীকার করেন, থানা পর্যায়ে দক্ষতা অর্জনের জন্য বইপুস্তক, গাইড, রোগী নেই। জটিল রোগী চিকিৎসা দেয়ার সুযোগ নেই। বিশেষজ্ঞ শ্রেণির কেউ থাকেন না। বিশেষজ্ঞ হওয়ার পরই গ্রামে ফিরে যান না। বড় ধরনের সার্জারি করানো হয় না। অ্যানেস্থেসিয়ার ব্যবস্থা নেই। পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি অর্জনের প্রস্তুতিতে সমস্যা হয় বলে স্বীকার করেন ডা. আজিজ।

 

স্বাচিপের বর্তমান মহাসচিব, বাংলাদেশ প্রাইভেট প্র্যাক্টিশনার্স ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ডা. মো. জামাল উদ্দিন চৌধুরী ভোরের আকাশকে বলেন, চিকিৎসকদের শহরে ও গ্রামে একই বেতন। কিন্তু সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে রয়েছে অনেক পার্থক্য। গ্রামে কর্মরত চিকিৎসকদের বিদেশ যাওয়ার সুযোগ থাকে না। পদোন্নতি পাওয়ার ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়েন। প্রাইভেট চেম্বারে রোগী দেখে অর্থ আয়ের সুযোগ কম। রোগী প্রতি পাওয়া যায় মাত্র ৩০ টাকা থেকে ১০০ টাকা। প্রথম শ্রেণির অফিসার হিসেবে মর্যাদা পাওয়া যায় না। শুধু মুখে নয়, গ্রামে অবস্থানরত চিকিৎসকদের জন্য কাগজে-কলমে বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা করার দরকার বলে মনে করেন ডা. জামাল উদ্দিন চৌধুরী।

 

তিনি আরো বলেন, ঢাকার বাইরের চিকিৎসকদের দায়িত্বে অবহেলার জন্য শুধু সাময়িক বরখাস্ত করেই বর্তমান অবস্থার সমাধান মিলবে না। এ চিকিৎসকদের পেশায় উৎসাহিত এবং গ্রামে থাকায় আগ্রহী করতে হলে চিকিৎসকদের জন্য ‘প্রমোটিভ টায়ার’ তৈরি করতে হবে। তাদের কয়েক ধাপে সাইক্লিক অর্ডারে পদোন্নতির ব্যবস্থা করতে হবে। রোগীদের আস্থা ফেরাতে চালু করতে হবে ‘রেফারেন্স সিস্টেম’। বন্ধ করতে হবে গ্রামীণ কোয়াক চিকিৎসকদের ব্যবসা।

 

উপজেলা হাসপাতালগুলোয় আধুনিক যন্ত্রপাতির সমন্বয়ে এ চিকিৎসকদের দক্ষতা বাড়াতে হবে। চিকিৎসকদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে বিসিএস পরীক্ষায় মেডিকেল সায়েন্সবিষয়ক শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সেই সঙ্গে চিকিৎসকদের দলবাজিও বন্ধ করতে হবে।

 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম ভোরের আকাশকে বলেন, গ্রামে থাকার ব্যাপারে চিকিৎসকদের মানসিকতার অনেক পরিবর্তন এসেছে। নির্ধারিত দুই বছর পার হওয়ার পরও অনেকে গ্রামে কাজ করে যাচ্ছেন। চিকিৎসকদের গ্রামে থাকতে না চাওয়ার সমস্যাটি বর্তমানে অনেক হ্রাস পেয়েছে বলে জানান মহাপরিচালক।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য