-->

আর্সেনিক ঝুঁকিতে দেশের প্রায় ৭ কোটি মানুষ

নিখিল মানখিন
আর্সেনিক ঝুঁকিতে দেশের প্রায় ৭ কোটি মানুষ

নিখিল মানখিন: আর্সেনিকমুক্তকরণে সফলতা পাচ্ছে দেশ। গত ২০ বছরে দেশে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিকযুক্ত নলকূপের সংখ্যা অর্ধেকে নেমেছে। তবে এখনো দেশের ১৪ শতাংশ নলকূপের পানিতে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক রয়েছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জীবন বাঁচানোর পানি আজ জনস্বাস্থ্যের জন্য চরম হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ভূ-উপরিভাগের পানি পড়েছে দূষণের কবলে। আর ভূগর্ভস্থ পানি হয়ে পড়ছে আর্সেনিকযুক্ত। আর্সেনিকের কারণে ডায়রিয়া, আমাশয়, কলেরা, চর্মরোগ, কিডনি, লিভার ও নানা সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। শুধু স্বাস্থ্য জটিলতা সৃষ্টি নয়, নদীমাতৃক বাংলাদেশে খাবার পানিসহ গৃহস্থালি কাজে ব্যবহার উপযোগী পানির সংকট তীব্রতর হয়ে উঠছে।

 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, নিরাপদ পানির ব্যবস্থা না করে নতুন নতুন আর্সেকোসিস রোগীর সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে না। আর্সেনিক প্রতিরোধে চিকিৎসাসহ নানা ধরনের সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। কিন্তু আর্সেনিকের ঝুঁকি রয়েই যাচ্ছে। নতুন রোগী সৃষ্টির মাত্রা কমাতে পারছি না। প্রায় ৭ কোটি মানুষ কোনো না কোনোভাবে আর্সেনিক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। দেশের শতকরা ৯৭ ভাগ মানুষ নলকূপের পানি পান করে। কিন্তু এসব নলকূপের পানিতেই ধরা পড়ছে আর্সেনিক। একবার আর্সেনিক পানি খেলে ৬ মাস থেকে ২০ বছর পরও আর্সেনিকে আক্রান্ত হতে পারে। দেশে ৬০ হাজারের বেশি আর্সেনিক আক্রান্ত রোগী তালিকাভুক্ত হয়েছে।

 

আর্সেনিকমুক্তকরণে সফলতা : জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, দেশের নলকূপের আর্সেনিক পরীক্ষা করা হয়েছিল ২০০৩ সালে। তখন দেশের ২৯ শতাংশ নলকূপের পানিতে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক পাওয়া যায়। এরপর ২০ বছরে কোনো সমীক্ষা হয়নি। ফলে দেশের কত সংখ্যক নলকূপে এখন সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি আর্সেনিক রয়েছে, সেটি বোঝা যাচ্ছে না।

 

২০১৯ সালে ‘পানি সরবরাহে আর্সেনিক ঝুঁকি নিরসন’ নামের একটি প্রকল্প হাতে নেয় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। পার্বত্য জেলাগুলোসহ ১০টি জেলা ছাড়া বাকি ৫৪ জেলায় কমবেশি আর্সেনিকের প্রকোপ রয়েছে। এ প্রকল্পের অধীনে দেশের ৫৪ জেলার নলকূপের পানিতে আর্সেনিকের উপস্থিতি আছে কিনা, তা পরীক্ষা করা হয়েছে।

 

প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, ২০২১ সালের মাঝামাঝি থেকে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশের ৩ হাজার ২০০টি ইউনিয়নের নলকূপ পরীক্ষা করা হয়। ৫৪ লাখ ৩০ হাজার ৮৮০টি নলকূপ পরীক্ষা করে ৭ লাখ ৫৫ হাজার ৫৪৮টি নলকূপে নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি আর্সেনিক পাওয়া যায়, শতাংশের হিসাবে যা ১৩ দশমিক ৯১ শতাংশ।

 

প্রকল্পের পরিচালক বিধান চন্দ্র দে বলেন, গত ২০ বছরে আর্সেনিক দূষণের পরিস্থিতি অনেকটা ভালো হয়েছে। অগভীর নলকূপের সংখ্যা কমেছে। লোকজন আর্সেনিক বিষয়ে আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন।

 

সমীক্ষায় দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি গোপালগঞ্জ জেলার ৫২ দশমিক ৫৭ শতাংশ নলকূপে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক রয়েছে। চাঁদপুরের ৫১ দশমিক ৩৫, কুমিল্লার ৪৪ দশমিক ৯১, সাতক্ষীরার ৪০ দশমিক ৮৫ এবং লক্ষ্মীপুরের ৩৪ দশমিক ২২ শতাংশ নলকূপে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক পাওয়া গেছে। সবচেয়ে কম আর্সেনিকযুক্ত নলকূপ রয়েছে দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, নওগাঁ, নাটোর, রংপুর ও গাজীপুর জেলায়।

 

গবেষণায় বলা হয়, আর্সেনিক মূলত একপ্রকার রাসায়নিক উপাদান। পানিতে স্বল্প মাত্রায় আর্সেনিক সবসময়ই থাকে। যখন এই মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয়ে যায়, তখন মানবদেহে নানা রোগের উপসর্গ তৈরি করে।

 

৬৪ জেলার পানিতেই অতিমাত্রায় আর্সেনিক : গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের ৬৪ জেলার মধ্যে প্রায় সবগুলোতেই মাটির নিচের পানিতে অধিক মাত্রায় আর্সেনিক রয়েছে। সে অনুসারে দেশের প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষ ক্রনিক আর্সেনিকোসিস ঝুঁকিতে রয়েছে। যেখানে আমাদের মোট জনসংখ্যা ধরা হয় ১৬ কোটি এবং বাংলাদেশে লক্ষাধিক আর্সেনিক আক্রান্ত রোগী রয়েছে, যাদের চূড়ান্ত পর্যায়ে ক্যান্সার। সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) পরিচালিত আর্সেনিক নিয়ে এক গবেষণায় উঠে এসেছে এসব তথ্য।

 

বিএসএমএমইউ পরিচালিত গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলে পাওয়া গেছে আর্সেনিকোসিসে রক্তশূন্যতা ৫৭ দশমিক ৭ শতাংশ, শারীরিক দুর্বলতা ১২ দশমিক ৯ শতাংশ, স্নায়ুতন্ত্রের সমস্যা ৭ দশমিক ৬ শতাংশ, শ্বসনতন্ত্রের সমস্যা ৬ দশমিক ২ শতাংশ, পরিপাকতন্ত্রের সমস্যা ৬ দশমিক ৯ শতাংশ, হৃদরোগজনিত সমস্যা ৩ দশমিক ৫ শতাংশ রোগীর মাঝে পাওয়া গেছে। শুধু তাই নয়, আর্সেনিকোসিস আক্রান্ত রোগীদের মাঝে বন্ধ্যত্ব বিদ্যমান। আবার বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ অঙ্গ যেমন লিভার, ব্লাডার ক্যান্সারও পাওয়া গেছে।

বর্তমানে ৮১ দশমিক ১ শতাংশ রোগী আর্সেনিক সহনীয় মাত্রার পানি পান করছে। অথচ তারা আর্সেনিকজনিত বিভিন্ন প্রকার রোগের লক্ষণ ও ক্যান্সার নিয়ে চিকিৎসকদের কাছে আসছেন। দিন দিন সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় আর্সেনিক সমস্যা প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে। তাই প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে, কীভাবে আমরা আর্সেনিক সংক্রান্ত জটিলতার মুখোমুখি হবো এবং এর কার্যকরী প্রতিকার করব?

 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৬০ দশকে প্রতি লিটার পানিতে আর্সেনিকের সহনীয় মাত্রা নির্ধারণ করে দশমিক শূন্য ৫ মিলিগ্রামে। এরপর ১৯৯৩ সালে তা দশমিক শূন্য ১ মিলিগ্রামে কমিয়ে আনা হয়। কিন্তু বাংলাদেশ ১৯৬৩ সালের সেই মাত্রা আর পরিবর্তন করেনি। বাংলাদেশ সরকার নির্ধারিত মান অনুযায়ী, প্রতি লিটার পানিতে দশমিক শূন্য ৫ মিলিগ্রামের বেশি আর্সেনিক থাকলে সে পানি পান করা কিংবা রান্নার কাজে ব্যবহার করা যাবে না।

 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) ২০১৯ সালের গুচ্ছ জরিপের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ১১ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষ আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করে। সেই হিসাবে প্রায় ২ কোটি মানুষ আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করছে।

 

ভোরের আকাশ/আসা

মন্তব্য

Beta version