শহিদুল ইসলাম সাহেদ: ছেলে লাঙল নিয়ে মাঠে যাবে। সূর্য ওঠার আগেই ছেলেকে খাইয়ে মাঠে পাঠাতে হবে। এ কারণেই কুয়াশাঢাকা ভোরে আগুন জ্বালিয়ে ভাত রান্নায় ব্যস্ত সত্তর বছর বয়সি সবুরা। রান্না শেষে মাটির চুলায় আগুন পোহাতে গিয়ে বিপদ ডেকে আনেন তিনি। তার কাপড়ে আগুন লেগে তা মুহূর্তেই সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে।
দগ্ধ হয় শরীরের ৬৫ শতাংশ। এখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন এই বৃদ্ধা। শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন তিনি। তার শরীর এতটাই দগ্ধ হয়েছে, ক্যামেরাবন্দি করার মতো অবস্থায় নেই। ঘটনাটি ঘটে গত ১ জানুয়ারি লালমনিরহাটের আজিতমারী থানার বড় কমলাবাড়ী গ্রামে।
শীতের আগুন পোহানোই শুধু সবুরার জন্য কাল হয়নি, এরকম সামান্য অসতর্কতায় সারা দেশেই দগ্ধ হচ্ছেন অনেকেই। শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট সূত্রে জানা গেছে, গত এক বছরে দগ্ধ হয়েছেন প্রায় ১ লাখ মানুষ। এদের কেউ আগুনে পুড়েছেন, কেউ গরম পানিতে দগ্ধ হয়েছেন। শীতে গোসলের জন্য পানি গরম ও পানি এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যাওয়ার সময় ঘটছে এসব দুর্ঘটনা। এ ধরনের সমস্যা নিয়ে ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ রোগী ঢাকা মেডিকেল কলেজ বার্ন ইউনিটে ভর্তি হতে দেখা গেছে।
শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের প্রধান সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন ভোরের আকাশকে জানান, শীতের মধ্যে পোড়ার সংখ্যা বেড়ে যায়। এর প্রধান কারণ গরম পানি দিয়ে গোসল ও শীত নিবারণে আগুন পোহাতে গিয়ে। আমাদের সবার বাসায় গিজার্ড না থাকায় আগুনে পানি গরম করতে হয়। সেই গরম পানি পাতিলে করে বাথরুমে যাওয়ার পথে শিশুর গায়ে পড়ে দগ্ধের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। সবাই একটু সচেতন হলে এ দুর্ঘটনা থেকে বাঁচতে পারবে।
এদিকে নরসিংদী জেলার মাধবদী থানার বিরামপুর গ্রামের গৃহিণী শাহনাজ বেগম (৩৫)। প্রচন্ড শীত নিবারণে গ্যাসের চুলায় আগুন পোহাতে গিয়ে পুরো শরীর আগুনে পুড়ে যায়। স্বামী ফারুক জানান, দুই ছেলেকে সামলানোর পর শাহানাজ রাতে প্রচন্ড শীতে কাবু হয়ে একটু শীত নিবারণের জন্য রান্নাঘরে যান। গ্যাসের জ¦ালানো চুলায় আগুন পোহাতে গিয়ে প্রথমে তার কাপড়ে আগুন লেগে যায়। ঘরে কেউ আসার আগেই সেই কাপড়ের আগুন ছড়িয়ে গোটা শরীর পুড়ে যায়। শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের জরুরি বিভাগে চিকিৎসাধীন শাহনাজ। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, তার শরীরের ৪৫ থেকে ৫০ শতাংশ পুড়ে গেছে।
শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের রেসিডেন্ট সার্জন ডা. এস এম আউয়াল হোসেন ভোরের আকাশকে জানান, শীত এলেই আগুনে পোড়ার সংখ্যা বেড়ে যায়। জানুয়ারি মাসে প্রতিদিন স্কাল্ড, ফ্লেম, ফিকশন বার্নজনিত সমস্যা নিয়ে ২২ থেকে ৩০ জন রোগী আসে চিকিৎসা নিতে। তাদের মধ্যে স্কাল্ড বা তরল জাতীয় দ্রব্য পড়ে দগ্ধ রোগী বেশি। গরম পানি, গরম দুধ, গরম তেল ইত্যাদি তরল দ্রব্য দিয়ে পোড়াকেই স্কাল্ড বার্ন বলা হয়। সাধারণত এই স্কাল্ড বার্নে দগ্ধ ৫৫ থেকে ৬০ শতাংশ রোগীর মধ্যে ৯০ শতাংশ রোগী শিশু।
এর বাইরে ৩০ শতাংশ ফ্লেম বার্ন বা আগুনে পোড়া বার্ন বলা হয়। আগুনে পোড়ার মধ্যে ছেঁক নিতে গিয়ে বা আগুন পোহাতে গিয়ে পোড়া, সিলিন্ডার ব্লাস্ট, গ্যাস পাইপ লিকেজ থেকে আগুনে পোড়া, এসি ব্লাস্ট ইত্যাদি কারণে সৃষ্ট জাতীয় আগুনে ইনহেলেন্স বা শ্বাস জনিত বার্ন বেশি হয়। কিন্তু আগুনে পোড়াদের মধ্য বেশিরভাগ রোগীই মহিলা। বাকি ৯ থেকে ১০ শতাংশ বৈদ্যুতিক পোড়া, কেমিক্যাল বার্ন, ফিকশন বা অ্যাক্সিডেন্টজনিত পোড়া। এই ধরনের বার্নে বেশিরভাগ পুরুষ রোগী হয়ে থাকে। ফ্লেম বার্নের ক্ষেত্রে নারীই বেশি।
শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট থেকে পাওয়া তথ্যমতে, বিভিন্নভাবে দগ্ধ হয়ে গত এক বছরে চিকিৎসা নিয়েছেন ৮৯ হাজার ৬৭৩ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৪৮ হাজার ৭৩৭ জন এবং নারী ৪০ হাজার ৯৩৬ জন। দগ্ধদের মধ্যে গুরুতর হয়ে দীর্ঘদিন ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন ৬ হাজার ৪২৮ জন।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য